লন্ডন মেয়র সাদিক খান
‘একজন ইংরেজ, মুসলিম ও ইউরোপীয় হিসেবে আমি গর্বিত’
সম্প্রতি ব্রিটেনের এলবিসি মিডিয়ায় সম্প্রচারিত এক লেখায় লন্ডনের মেয়র স্যার সাদিক খান বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। এই নিবন্ধে তাঁর বহুস্তরীয় পরিচয় নিয়ে আলোচনা করে তিনি লিখেছেন, গত বুধবার আমরা অনেকেই সেন্ট জর্জ দিবস উপলক্ষে গর্বের সাথে ইংলিশ পতাকা ওড়িয়েছি। লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে আয়োজিত এই পরিবার-বান্ধব উৎসবে আমরা শ্রদ্ধা জানিয়েছিলাম ইংল্যান্ডের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি। তিনি লিখেছেন, লন্ডনের মেয়র এবং একজন গর্বিত ও দেশপ্রেমিক ইংলিশম্যান হিসেবে আমি সর্বদা এ নিয়ে আবেগাশ্রয়ী যে, আমাদের রাজধানী শুধুমাত্র সেন্ট জর্জ দিবসকে শুধু স্বীকৃতিই দেয় না, বরং জীবন পদ্ধতিতে তাকে ধারণ করে। ছোটবেলায় সেন্ট জর্জের পতাকার আশেপাশে থাকা আমার জন্য সবসময় স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয় ছিলো না। তিনি স্মরণ করেন, কীভাবে তাঁর শৈশবে সেন্ট জর্জের পতাকা (ইংল্যান্ডের পতাকা) কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠীর দ্বারা অপব্যবহৃত হতো, যা তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলত। তবে ১৯৯৬ সালের ইউরো ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ইংল্যান্ডের জয়ের সময়, এই পতাকা একটি ঐক্যের প্রতীক হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
সেটা এমন এক সময় ছিলো যখন প্রথমে ন্যাশনাল ফ্রন্ট, অত:পর বিএনপি মিছিলে ছিলো এবং মাঝে মাঝে মনে হতো যে আমাদের পতাকা তাদের আত্মগত হয়ে গেছে।
কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সবকিছু বদলে গিয়েছিলো ইউরো ‘৯৬ এর এক গৌরবোজ্জ্বল গ্রীষ্মে। ওয়েম্বিলিতে ইংল্যান্ডের হাতে ডাচদের ৪-১ গোলে বিপর্যস্ত হওয়া দেখার কথা আমি কখনো ভুলবো না। সেটা ছিলো এক রোমাঞ্চকর পরিবেশনা, যা আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে আনে। খেলার শেষ বাঁশির পর আমরা দশ হাজার মানুষ উৎসাহের সাথে রেডক্রস নাড়িয়ে, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ‘ফুটবল ঘরে ফিরছে’ বলে শ্লোগান দিতে থাকি।
সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিলো যেনো আমাদের পতাকা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে এবং জাতীয় ঐক্যের একটি প্রতীক হিসেবে পুন:নির্মাণ করা হয়েছে, যা গুটিকয়েক ঘৃনা সৃষ্টিকারীর নয় বরং এর মালিক শোভন সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ। এর পরবর্তী বছরগুলোতে আমরা একটি দেশ হিসেবে নি:সন্দেহে প্রকৃত সামাজিক অগ্রগতি অর্জন করেছিলাম। আমরা হয়ে ওঠেছিলাম অধিকতর উদার এবং ইংলিশ হিসেবে জাতীয় পরিচয় অনুধাবনে অন্তর্ভূক্তিমূলক। ক্রমবর্ধমানভাবে আমরা বুঝতে শুরু করেছিলাম যে, আমাদের জনগনের একাধিক পরিচয় থাকতে পারে। যেমন- আমি একজন লন্ডনবাসী ও একজন ইংরেজ হতে পেরে যেমন গর্বিত তেমনি পাকিস্তানী ও এশীয় ঐতিহ্যের অধিকারী এবং একজন ইউরোপী ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী হতে পেরে গৌরবান্বিত। আমার দৃষ্টিতে এসব পরিচয় সাংঘর্ষিক নয়।
এগুলো আমাদেরকে আমরা যা তা বানিয়েছে দেশপ্রেম ও বহুত্ববাদের মধ্যে কোন বিরোধ বা উত্তেজনা নেই। ব্রিটিশ জনগন এই ধারনা বহু আগেই গ্রহণ করেছে এবং এটা বিস্ময়কর কিছু নয়। আমরা সবাই জানি, জুড বেলিংহ্যাম, বুকায়ো সাকা, মার্কস র্যাশফোর্ড, লোরেন জেমস, ইনি অ্যালুকো এবং কেলি হোমস প্রত্যেকে আমাদের দেশের প্রতিনিত্বি করতে পারে, ইংলিশ হতে পারে এবং প্রত্যেকে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে গর্বিত বোধ করতে পারে। কিন্তু ঋষি সুনাকের নিখাঁদ ইংরেজ ভদ্রলোক হওয়ার মতবাদ হতাশাব্যঞ্জক। এভাবে কিছু রাজনীতিবিদ, নেতাসহ অন্যান্যরা প্রগতিশীল দেশপ্রেমের পরিবর্তে পপুলিষ্ট ডান ও উগ্র ডানপন্থীদের উর্বর ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছেন। আমাদের দেশ শেক্সপিয়ার ও স্টর্মজির দেশ, জেন অস্টেন ও অ্যান্টনি জশুয়ার দেশ। আধুনিক ইংল্যান্ড বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্ম, ইতিহাস ও প্রভাবের একটি সমষ্টি, যা গনতন্ত্র, শালীনতা, ন্যায়পরতা ও শ্রদ্ধার মূল্যবোধ দ্বারা আবদ্ধ।
এটি এমন একটি জায়গা যেখানে আমাদের পতাকা, আমাদের পারিবারিক ইতিহাস, আমাদের বাড়ি ও আমাদের ঐতিহ্যের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বাধ্য করা হয় না, এটা এমন একটি দেশ যা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস নিয়ে গর্বিত, তার এনএইচএস ও মূখ্য কর্মীদের নিয়ে গর্বিত এবং তার বৈচিত্র ও অন্তর্ভূক্তিমূলক নীতির জন্য গর্বিত। মেয়র সাদিক খান নিবন্ধের উপসংহারে এসে দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করেন, ‘আমার বিশ্বাস, নীরব সংখ্যাগরিষ্টরা সর্বদা বিষাক্ত জনপ্রিয়তার পরিবর্তে সঠিক দেশপ্রেমকে বেছে নেবে। এটা আমাদের ডিএনএ’ তে আছে এবং এটি আমার ইংরেজ হিসেবে গর্বের একটি কারণ।