‘আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার’

বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদ চেয়েছিলেন শুক্রবারের বিদায়। কবিতায় তাঁর এ আকাংখাই যেন প্রতিফলিত হলো। শুক্রবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে এই পৃথিবী ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান কবি। তাঁর মৃত্যুতে সাহিত্যাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ‘স্মৃতির মেঘলাভোরে’ কবিতায় তার এ বাসনার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কবি। তিনি লিখেছিলেন- কোনো এক শুক্রবারের ভোরবেলা মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে ডাক দিলে তিনি খুশি মনেই তার ডাকে সারা দেবেন। আনন্দের সঙ্গেই তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন। কবি আল মাহমুদের লেখা কবিতাটি তুলে ধরা হলো:

‘স্মৃতির মেঘলাভোরে’
__আল মাহমুদ

কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।
ফেলে যাচ্ছি খড়কুটো, পরিধেয়, আহার, মৈথুন–
নিরুপায় কিছু নাম, কিছু স্মৃতি কিংবা কিছু নয়;
অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে জমে আছে শোকের লেগুন
কার হাত ভাঙে চুড়ি? কে ফোঁপায়? পৃথিবী নিশ্চয়।
স্মৃতির মেঘলাভোরে শেষ ডাক ডাকছে ডাহুক
অদৃশ্য আত্মার তরী কোন ঘাটে ভিড়ল কোথায়?
কেন দোলে হৃদপিণ্ড, আমার কি ভয়ের অসুখ?
নাকি সেই শিহরণ পুলকিত মাস্তুল দোলায়!
আমার যাওয়ার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার
যদি হয় ভোরবেলা স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।

আল মাহমুদ ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম কবি। কবিতার পাশাপশি গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং শিশুসাহিত্য রচনা করেও তিনি খ্যাতির শিখর স্পর্শ করেছেন। ৫০-এর দশকের তার সমসাময়িক কবি-বন্ধুরা যখন একে একে মৃত্যুবরণ করছেন তখন কবি আল মাহমুদ বার্ধক্যজনিত নানান অসুখে থেকেছেন গৃহবন্দি। মাঝে মাঝে গিয়েছেন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। দীর্ঘদিন ধরে চোখে ভালো দেখতেন না, কানেও কম শুনতেন। তবু বিশেষ সংখ্যার জন্য তিনি অন্যের সহযোগিতা নিয়ে মুখে মুখে কবিতা রচনা করতেন। কবি আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাই স্কুলে পড়ালেখা করেন। সেই সময় থেকেই তার লেখালেখির শুরু। সেসময় তিনি মধ্যযুগীয় প্রণয়োপাখ্যান, বৈষ্ণব পদাবলি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল প্রমুখের সাহিত্য পাঠ করেন।

১৮ বছর বয়সে তার কবিতা প্রকাশিত হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, ময়ূখ, কৃত্তিবাস ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা-কলকাতার পাঠকদের কাছে তিনি সুপরিচিত হন। তার কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩), কালের কলস (১৯৬৬), সোনালী কাবিন (১৯৬৬), মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থগুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস কবি ও কোলাহল। ১৯৬৮ সালে ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’-এর জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে পান একুশে পদক।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button