কুরবানি: জাতীয় কবির দৃষ্টিতে

॥ এক ॥
শেখ দরবার আলম: ইসলামকে আমাদের সাম্য ও সহাবস্থানের কবি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোনো অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম হিসাবে দেখেননি। ইসলামকে তিনি দেখেছিলেন একটা কাক্সিক্ষত জীবনব্যবস্থা হিসাবে। ইসলাম তার কাছে ছিল একটা পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল তার কাছে একটা প্রিয় আশ্রয়। সহজ-সরল মনে চিন্তা-ভাবনা করে ইসলামকে তিনি একটা আশ্রয় হিসাবেই পেয়েছিলেন।

তিনি অত্যন্ত সৎ ও সংবেদনশীল মনের মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত স্পর্শকাতর মনের মানুষ ছিলেন তিনি। এই স্পর্শকাতর মন নিয়েই তিনি ইসলামকে দেখেছিলেন। এই স্পর্শকাতর মন নিয়ে দেখার কারণে ইসলামের মধ্যে তিনি মানুষের আর্থ-সাংস্কৃতিক, সামাজিক সমস্ত সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছিলেন। সাম্য ও সহাবস্থানকামী এই ইসলামী জীবনব্যবস্থাটা লক্ষ্য করেই তিনি আল্লাহকে ভালোবেসেছেন, আল্লাহর রসূল (সা.)কে ভালোবেসেছেন। বৈরী পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে জীবন ধারণ করেও বারংবার বলেছেন যে, তিনি ‘আল্লাহর বান্দা’ এবং ‘নবীর উম্মত’; কিন্তু তিনি কবি সকলের। ঈদ প্রসঙ্গেও তিনি স্মরণ করেছেন ইসলামী জীবনব্যবস্থার কথা। কেননা, ইসলামী জীবনব্যবস্থার মধ্যেই তো আছে মানুষের ইনসাফ পাওয়া সংস্থান, সাম্য ও সহাবস্থানের নীতিতে মানুষ হিসাবে মানুষের বাঁচার সংস্থান। ইসলাম তার কাছে কোনো যান্ত্রিক ধর্মাচারণ ছিল না।
ইসলামকে যদি আমরা অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম হিসাবে দেখি, ইসলাম যদি আমাদের অনুভূতিহীনতার কারণে নিছক যান্ত্রিক ধর্মাচরণ হয়ে ওঠে তাহলে তো ইসলাম মানুষের মনে, গণমনে তার আবেদন হারাবে। তখন তো ইসলাম মানুষের কাছে একটা আশ্রয় হিসাবে আর থাকবে না। কিন্তু ইসলামকে তো কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের আশ্রয় হিসাবেই দেখতে চেয়েছেন। ব্যবহারিক জীবনে ইসলামের যে অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা সেটাই কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।
॥ দুই ॥
আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে কোনো উপলক্ষে যখনই ইসলামের কথা লিখেছেন বা বলেছেন তখনই সে উপলক্ষে ইসলামের অপরিহার্য প্রয়োজনীয় শিক্ষার দিকটি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেছেন। একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
আল্ জাইমার ডিজিজে কবি পরবর্তী সারা জীবনের জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ার বছর দেড়েক আগের কথা। কবি তখন থাকতেন কলকাতার ১৫/৪ শ্যামবাজার স্ট্রীটের ভাড়া বাসায়। ঘরে তার পট্্স ডিজিজে শয্যাশায়ী স্ত্রী। ঘরে শাশুড়ি গিরিবালা সেন গুপ্তা আছেন। তাদের স্বধর্মী আত্মীয়-পরিজনও থাকেন। সেই ভাড়া বাড়িতে শাশুড়ি গিরিবালা দেবীর জন্য একটা পূজার ঘর আছে। কবির পরিবারের লোকদের ধর্ম বিশ্বাস কবির শাশুড়ি কবি পরিবারে থাকাকালে এত প্রবল ছিল যে, পট্্স ডিজিজে অসুস্থ কবি-পত্নীর বিজ্ঞানসম্মত মেডিকেল ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। ধর্মগুরু বরদাচরণ মজুমদারের হাতে ধর্মীয় পদ্ধতিতে চিকিৎসা করার ভার অর্পণ করা হয়েছিল। প্রথম থেকেই এ বিষয়েও কবি তাদের বিশ্বাসে এবং অনুভূতিতে আঘাত না করার নীতি গ্রহণ করে চলতেন। বরদাচরণ মজুমদারের প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভক্তি প্রদর্শনের মূল কারণটা ছিল এখানেই। তাছাড়া অন্য ধর্মীয় সমাজের মানুষদের সম্বোধন ও কবি তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করেই চলতেন। এটা কবি তার জীবনে একটা নীতি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।
নাট্য মঞ্চ, বেতার, বিভিন্ন গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানী, বিভিন্ন চলচ্চিত্র কোম্পানী, বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িকী, বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থা, এ রকম হিন্দুপ্রধান যেসব কর্মক্ষেত্রে কবিকে যেতে হতো সেসব জায়গায়ও কবি তাদের ধর্মবিশ্বাস, ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেই কথা বলতেন এবং চলতেন।
ঘরে-বাইরে প্রতিবেশী সমাজের মানুষদের ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি সাম্য ও সহাবস্থানের দৃষ্টিতে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে চলে অন্তরে তিনি ইসলামের প্রতি যে গভীর মমত্ববোধ পোষণ করতেন সেটা তার ইসলাম সম্পর্কিত লেখায় অনুভব করা যায়। বক্তব্য উপস্থাপনের ভঙ্গিতে এবং তার কথা ও লেখায় শ্রোতার-পাঠকের মন ছোঁয়। তখন উপলব্ধি করা যায় যে, কত গভীরভাবে ইসলামকে তিনি ভালোবাসতেন। তার লেখা ইসলামী গান কেবল সঠিক সুর-তাল সমৃদ্ধ নয়, সঠিক বাণী সমৃদ্ধ, সঠিক শব্দ ও শব্দ বিন্যাস সমৃদ্ধ। উপলব্ধি করা যায় যে, সে বাণী, সে শব্দ তার অন্তর থেকে এসেছে।
নজরুল প্রতিবেশী সমাজের জন্যও অনেক কিছু লিখেছিলেন। ইসলামের জন্য তিনি যা লিখেছিলেন তাতে পুরো ইসলামী সভ্যতাটাই উঠে এসেছে। ঘরে-বাইরে যে পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে তিনি জীবন ধারণ করেছেন তাতে এটা খুবই বিস্ময়কর বলেই মনে হয়।
১৯৭৪ এই ১৪ই আগস্টের পর থেকে সুবিধাভোগী মুসলিম পরিবারের অনেক সন্তান অনুশীলন সমিতির সভ্য মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যদের, যুগান্তর দলের সভ্যদের ও এরকম অন্যান্য আধাসামরিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী তপ্ত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনের সভ্যদের প্রভাবে এবং অনুশীলন সমিতির সভ্য মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সোস্যালিস্ট পার্টির অনুশীলন সমিতির সভ্যদের, যুগান্তর দলের সভ্যদেরও এ রকম অন্যান্য আধাসামরিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদী তপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠনের সভ্যদের প্রভাবে ইসলামকে যখন প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসাবে খুব সহজেই দেখতে পেয়েছেন, তখন ওই পরিবেশে ইসলামের প্রতি নজরুলের আকৃষ্ট হয়ে থাকাটা বিস্ময়কর বটে!
এই বিস্ময়কর প্রতিভাবান মানুষটিকে আমরা উপযুক্ত মর্যাদায় ধারণ করতে পারিনি। সহাবস্থানের প্রয়োজনে তিনি শ্যামা সঙ্গীত লেখায় আমরা তাকে পল্লী সাধক বলতেও কুণ্ঠিত হইনি।
আমি সে সময়কার পরিবেশ-পরিস্থিতির কথা কিছুটা উল্লেখ করলাম। এর পর আলজাইমার্স ডিজিজে কবি পরবর্তী জীবনের জন্য অসুস্থ হয়ে নির্বাক ও নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার বছর দেড়েক আগে ঈদুজ্জোহা উপলক্ষে কোরবানীর ঈদ উপলক্ষে তার বক্তব্যের বিষয়ে আসব।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, কলকাতায় কবি সে সময়ে থাকতেন ১৫/৪ শ্যামবাজার স্ট্রীটের বাসায়। সে সময় ঈদুজ্জোহার তারিখটা ছিল ৯ই জানুয়ারি ১৯৪১ (২৫ শে পৌষ ১৩৪৭ : ১০ই জেলহজ্জ ১৩৫৯ হিজরী) তারিখ বৃহস্পতিবার। এই ঈদুজ্জোহা উপলক্ষে কলকাতার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি ঈদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন এবং ওই ঈদ সম্মেলনে কবিকে সভাপতির দায়িত্বভার পালন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির ওই ঈদ সম্মেলনে সভাপতির অধিবেশনে সাম্য ও সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুরুতেই তার কথাগুলো এভাবে বলেছিলেন:
‘আজকের ঈদ সম্মেলনে আমাকে আপনারা সভাপতি নির্বাচিত করে গৌরব দান করেছেন, এ জন্য আমি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সমিতির কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আপনাদেরকে ‘ঈদ মোবারক হো’ বলে প্রথমেই অভিনন্দিত করছি।’
ঈদুজ্জোহা উপলক্ষে অর্থাৎ কোরবানীর ঈদ উপলক্ষে কবি যে কথাগুলো বলেছিলেন, সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে হবে। কবি বলেছিলেন:
‘ঈদের উৎসব আনন্দের উৎসব, ত্যাগের উৎসব। আল্লাহর রাহে সবকিছু কোরবানী করার ইঙ্গিতই এই উৎসব বয়ে এনেছে। কোরআনের সূরা বাকারায় এই কোরবানীর কথা রয়েছে এবং সূরা নূরের ভিতর উল্লেখিত জয়তুন ও রওগণের যেসব কথা রয়েছে, তার অর্থ সকলকে আমি অনুধাবন করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। কোরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহর নামে সকল ঐশ্বর্য, সকল সম্পদ কোরবানী করতে হবে। একটা গরু কোরবানী করেই সবকে ফাঁকি দেয়া যেতে পারে কিন্তু আল্লাহকে ফাঁকি দেয়া সম্ভবপর নয়।
‘সকল ঐশ্বর্য, সকল বিভূতি আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দিতে হবে। ধনীর দৌলতে, জ্ঞানীর জ্ঞানভাণ্ডারে সকল মানুষের সমান অধিকার রয়েছে। এ নীতি স্বীকার করেই ইসলাম জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছে। আজ জগতের রাজনীতির বিপ্লবী আন্দোলনগুলোর যদি ইতিহাস আলোচনা করে দেখা যায়, তবে বেশ বুঝা যায় যে, সাম্যবাদ সমাজতন্ত্রবাদের উৎসমূল ইসলামেই নিহিত রয়েছে। আমার ক্ষুধার অন্নে তোমার অধিকার না থাকতে পারে, কিন্তু আমার উদ্বৃত্ত অর্থে তোমার নিশ্চয়ই দাবি আছে, এ শিক্ষা ইসলামের। জগতের আর কোনো ধর্ম এত বড় শিক্ষা মানুষের জন্য নিয়ে আসেনি। ঈদের শিক্ষার এটাই সত্যিকার অর্থ।’
॥ তিন ॥
কবি কাজী নজরুল ইসলাম অর্থনৈতিক সাম্য, সামাজিক সাম্য ও বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক, সাংষ্কৃতিক, শিক্ষাগত আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের নীতিতে প্রতিবেশী সমাজের জন্য অজস্র কীর্তন, ভজন ও শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অজস্র পৌরাণিক উপাদান তার সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন। (১০-এর পাতায় দেখুন)
(৯-এর পাতার পর)
তারপরও তার ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে কারো মনে যাতে কোনো ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি না হয় সে জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় লিখে গেছেন যে, তিনি ‘আল্লাহর বান্দা’ ‘নবীর উম্মত’ কিন্তু তিনি কবি সবার। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও অঞ্চল, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, ইহুদী, জৈন, পারসি, শিখ নির্বিশেষে সবার।
তিনি তার মুসলিম পরিচয়টা অস্বীকার করাটা তো অনেক দূরের কথা, আড়ালও করেননি। কেন অস্বীকার করেননি, কেন আড়াল করেননি সে প্রশ্নের জবাব তিনি ইসলামকে কিভাবে দেখেছেন সেই দেখার মধ্যে স্পষ্ট। ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে ভালোবেসেই তিনি আল্লাহকে এবং আল্লাহর রাসূল (সা.)কে ভালোবেসেছিলেন।
ব্যবহারিক জীবনে ইসলামের শিক্ষাকে তুলে ধরার ব্যাপারটাকে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। আমি নিজে ইসলামকে উপলব্ধি করতে শিখেছি মূলত কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য সঙ্গীতের মাধ্যমে। ইসলাম সম্পর্কে কবি কাজী নজরুল ইসলামের মূল্যায়ন অত্যন্ত স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন।
এদেশের কিছু সুবিধাভোগী লোক আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার লোভে এবং প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা চিরস্থায়ী করার আকাক্সক্ষায় এ দেশের মুসলমানদের মুসলিম পরিচয় মুছে ফেলে বাঙালি পরিচয় আরোপ করার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের অব্যবহিত পর থেকে। এই পরিবেশ পরিস্থিতিতে অনেক বঞ্চনার শিকার হয়েও গঠনমূলক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দিই।
নজরুল প্রেরণা পেতেন ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে। আমার নিজেরও প্রেরণা পাওয়ার জায়গা ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
একটা সময়ের কথা বলছি: কবি তখন থাকতেন সম্ভবত কলকাতার ৫৩/জি হরি ঘোষ স্ট্রীটের ভাড়া বাসায়। সেখান থেকে গিয়ে সিরাজগঞ্জের নাট্যভজনে ৫ই নভেম্বর ১৯৩২ (১৯ শে কার্তিক ১৩৩৯; ৫ই রজব ১৯৫১ হিজরী) তারিখ শনিবার এবং এরপর দিন ৬ই নভেম্বর ১৯৩২ (২০ শে কার্তিক ১৩৩৯; ৬ই রজব ১৩৫১) তারিখ রবিবার জগদ্বাত্রী পূজার দিন অনুষ্ঠিত দু’দিনব্যাপী বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের সভাপতির অভিভাষণে সব শেষে কবি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় খুবই খোলাখুলিই বলেছিলেন।
‘আমরা চাই সিদ্দিকের সাচ্চাই, ওমরের শৌর্য ও মহানুভবতা, আলির জুলফিকার, হাসান-হোসেনের ত্যাগ ও সহনশীলতা। আমরা চাই খালেদ-মুসা-তারেকের তরবারি, বেলালের প্রেম। এসব গুণ যদি অর্জন করতে পারি, তবে জগতে যাহারা অপরাজেয় তাহাদের সহিত আমাদের নামও সসম্মানে উচ্চারিত হইবে।’
ইসলামকে ভালোবেসে কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামের ইতিহাসকে স্মরণ করার অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে প্রেরণা পাওয়ার অনেক কিছুই আছে।
২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭ (১০ই ফাল্গুন ১৩৪৩ জেলহজ্ব ১৩৫৫ হিজরী) তারিখ সোমবার ছিল বকরিদ, ঈদুজ্জোহা। এর দু’দিন আগে ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীতে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণে শেষের দিকে কবি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন:
‘তোমাদের কর্তব্য সম্মিলিত হওয়া। যে ইখাওয়াৎ সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব, যে একতা ছিল মুসলিমের আদর্শ, যার জোরে মুসলিম জাতি এক শতাব্দীর মধ্যে পৃথিবী জয় করেছিল, আজ আমাদের সে একতা নেই, হিংসায়, ঈর্ষায়, কলহে, ঐক্যহীন, বিচ্ছিন্ন। দেয়ালের পর দেয়াল তুলে আমরা ভেদ-বিভেদের জিন্দাখানা সৃষ্টি করেছি; কত তার নাম, সিয়া, সুন্নি, শেখ, সৈয়দ, মোগল, পাঠান, হানাফী, শাফী, হাম্বলী, মালেকী, লা-মজহাবী, ওহাবী ও আরও কত শত শত দল। এই শত দলকে একটি বোঁটায়, একটি মৃণালের বন্ধনে বাঁধতে পার তোমরাই।’
॥ চার ॥
১৯৩৮ খ্রী. কোরবানীর ঈদের দু’দিন আগে ১০ই ফেব্রুয়ারী ১৯৩৮ )২৭শে মাঘ ১৩৪৪: ৮ই জিলহজ্জ ১৩৫৬ হিজরী) তারিখ বৃহস্পতিবার কলকাতার ৫ নম্বর ম্যাঙ্গে লেনে দৈনিক ‘কৃষক’ পত্রিকার অফিস-গৃহে জনসাহিত্য-সংসদের শুভ উদ্বোধনের সভাপতির অভিভাষণে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক জায়গায় বলেছিলেন:
‘হজরত ওমর, হজরত আলী, এঁরা অর্ধেক পৃথিবী শাসন করেছেন, কিন্তু নিজেরা কুঁড়েঘরে থেকেছেন, ছেঁড়া কাপড় পরেছেন, সেলাই করে, কেতাব লিখে সেই রোজগারে দিনাতিপাত করেছেন। ক্ষিধেয় পেটে পাথর বেঁধে থেকেছেন; তবু রাজকোষের টাকায় বিলাসিতা করেন নি। এমন ত্যাগীদের লোকে বিশ্বাস করবে না কেন?
“কওমের সত্যিকার কল্যাণ করতে হলে ত্যাগ করতে হবে হযরত ইব্রাহীমের মতো।
“দু’দিন বাদে কোরবানী ঈদ আসছে ঈদের নামাজ আমাদের শিখিয়েছে, সত্যিকার কোরবানী করলেই মিলবে নিত্যানন্দ। আমরা গরু-ছাগল কোরবানী করে খোদাকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করছি। তাতে করে আমরা নিজেদেরকেই ফাঁকি দিচ্ছি। আমাদের মনের ভিতরে যেসব পাপ, অন্যায়, স্বার্থপরতা ও কুসংস্কারের গরু-ছাগল- যা আমাদের সৎবৃত্তির ঘাস খেয়ে আমাদের মনকে মরুভ’মি করে ফেলেছে, আসলে কোরবানী করতে হবে সেই সব গরু-ছাগলের। হযরত ইব্রাহীম নিজের প্রাণতুল্য পুত্রকে কোরবানী করেছিরেন বলেই তিনি নিত্যানন্দের অধিকারী হয়েছিলেন। আমরা তা করিনি বলেই আমরা কোরবানী শেষ করেই চিড়িয়াখানায় যাই তামাসা দেখতে। আমি বলি, ঈদ করে যারা চিড়িয়াখানায় যায়, তারা চিড়িয়াখানায় থেকে যায় না কেন?
“এমনি ত্যাগের ভিতর দিয়ে জনগণকে যারা আপনার করে নিতে পারবে তারাই হবে জনগণের নায়ক।
॥ পাঁচ ॥
ইসলামের সব কিছু সম্পর্কেই সাম্য ও সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল প্রগাঢ় বিশ্বাস, পরিপূর্ণ আস্থা, গভীর মমত্ববোধ। তিনি পুরোপুরিই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ছিলেন। বিজ্ঞান সম্মত পন্থা এবং যুক্তিবোধ মেনে চলাটা পছন্দ করতেন। কিন্তু আল্লাহর প্রত্যাদেশের সমষ্টি যে কোরআন শরীফ এবং হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া-সাল্লামের উপদেশ, পরামর্শ এবং জীবনাদর্শের কথা আছে যে হাদীস শরীফে, সেই কোরআন শরীফের এবং হাদীস শরীফের কোনো কিছুর ব্যাপারে তিনি কখনো কোনো দিন কোনো আপত্তি প্রকাশ করেননি। এক কথায়, ইসলামের প্রতি তার ছিল নিঃশর্ত আনুগত্য কোনো দিন। এই কোরবানীর ঈদ প্রসঙ্গেই একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং তার সুহৃদ মুজফফর আহমদ যখন কলকাতায় দৈনিক নবযুগ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন এবং থাকতেন

কলকাতার ৬ নম্বর টার্নার স্ট্রিটের বাড়ির নিচতলায় সে সময়ে ২৬ শে আগস্ট ১৯২০ (১০ ই ভাদ্র ১৩২৭ : ১১ ই জেলহজ্জ ১৩৩৮ হিজরি) তারিখ বৃহস্পতিবার ছিল ঈদুজ্জোহা। কবির বয়স তখন মাত্র একুশ বছর তিন মাস। দৈনিক নবযুগের অন্যতম সহযোগী সম্পাদক মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে তখন এক সঙ্গে থাকেন।
এই ঈদের আগেই প্রতিবেশী সমাজের মাসিক সবুজপত্রের ১৩২৭ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ সংখ্যা তরীকুল আলম ছদ্মনামে মুসলমান ঘরের এক বিপথগামী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলোক ‘আজ ঈদ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধে ‘কোরবানী’কে অযথা ‘নিষ্ঠুরতার অভিনয়’ বলে অভিহিত করে ইসলামে বিশ্বাসী মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে এবং ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে যারা মুসলমানদেরকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে এবং মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা মুছে ফেলে হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা আরোপ করে এক জাতিতত্ত্ব কায়েম করতে চান তাদের প্রিয়পাত্র হয়ে ‘মুক্তমনা’ , ‘প্রগতিশীল’ এ রকম সব অভিধায় অভিহিত হওয়ার খায়েশ পোষণ করেছিলেন।
তরীকুল আলম ছদ্মনামের এই উচ্চাকাক্সক্ষী বিপথগামী, অধঃপতিত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলোকের আসল নাম ছিল তা’লীমুদ্দীন আহমদ। রংপুরের বিখ্যাত উকিল, কুসরআনের বঙ্গানুবাদক মৌলবী তসলীমুদ্দীন আহমদ সাহেবের এমএ পাস করা ছেলে ছিলেন তিনি। জমিদার-ব্যারিস্টার প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সবুজ পত্রে’র শ্রাবণ ১৩২৭ (জুলাই-আগস্ট ১৯২০ : শওয়াল-জেলহজ্জ ১৩৩৮)-এর সংখ্যায় অযথা অবিবেচকের মতো সে সময়কার হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অসচেতন ও অসংগঠিত সমাজহীন মুসলমান সমাজের অধিকার বঞ্চিত ও মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসে এবং ধর্মানুভ’তিতে অযথা আঘাত দিয়ে অবিবেচকের মতো ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের কাছে ‘প্রগতিশীল’ ও ‘মুক্তবুদ্ধির লোক’ বলে খেতাব পাওয়ার লোভে তিনি লিখেছিলেন :
…. আজ এই আনন্দ-উৎসবে আনন্দের চেয়ে বিষাদের ভাগই মনের ওপর চাপ দিচ্ছে বেশি করে। যেদিকে তাকাচ্ছি, সেই দিকে কেবল নিষ্ঠুরতা অভিনয়। অতীত এবং বর্তমানের ইতিহাস চোখের সামনে অগণিত জীবের রক্তে ভিজে লাল হয়ে দেখা দিচ্ছে। এই লাল রঙে আকাশে-বাতাসে চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে- যেন সমস্ত প্রকৃতি তার রক্তনেত্রের ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে পৃথিবী বিভীষিকা করে তুলেছে। প্রাণ একেবারে হাঁপিয়ে উঠছে।’
লক্ষণীয় যে, কথাগুলো হিন্দুঘরের সন্তানদের কারো লেখা নয়। অহিংসা যাদের পরম ধর্ম সেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কারো লেখা নয়। ১৭৫৭-এর ২৩ শে জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের পর থেকে গত একশ’ তেষট্টি বছর যাবত সাধারণভাবে যারা ক্রুসেডের চেতনাসম্পন্ন সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাতীয়তাবাদী খ্রিস্টান সমাজের প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত হওয়ার কারণে চাকরি-বাকরি ও জমি-জমা থেকে উৎখাত হয়ে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকা ও সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে অধিকার বঞ্চিত হয়ে হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অসচেতন ও অসংগঠিত সমাজহীন সমাজের মানুষ হিসেবে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন যে মুসলমানরা তাদেরই প্রায় সদ্য সুবিধা পাওয়া একজনের লেখা!
এই বিপথগামী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভদ্রলোকের অজ্ঞতাপ্রসূত ও অপরিণামদর্শী বক্তব্যের প্রতিবাদে সাম্য ও সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন তার বিখ্যাত ‘কোরবানী’ কবিতা। কবিতাটি ছাপা হয়েছিল এর ঠিক পরের মাসেই অর্থাৎ ভাদ্র ১৩২৭ (আগস্ট-সেপ্টেম্বর ১৯২০ : জেলহজ্জ ১৩৩৮-মহররৃম ১৩৩৯)-এর মাসিক ‘মোসলেম ভারতে’র ১ম বর্ষ : ১ম খণ্ড : ৫ম সংখ্যা ২৮৯ পৃষ্ঠায়। যিনি প্রতিবেশী সমাজের জন্য অজস্র ভজন, কীর্তন, শ্যামা সংগীত লিখেছেন, যিনি তার সাহিত্য ও সংগীতে অমুসলিমদের অজস্র পৌরাণিক উপাদানাদি ব্যবহার করেছেন, এই ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্যবাদী সাহিত্যের এবং সাম্যবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের অন্যতম জনক যিনি, সেই সাম্য ও সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি এই ‘কোরবানী’ কবিতায় অত্যন্ত দৃঢ় ও স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন :
‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন!
দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন!
ধ্বনি ওঠে রনি দূর বাণীর,-
আজিকার এ খুন কোরবানীর!
দুম্বা-শির রুম-বাসীর
শহীদের শির-সেরা আজি। -রহমান কি রুদ্র নন?
ব্যস! চুপ খামোশ রোদন!
আজ শোর ওঠে জোর ‘খুন দে, জান দে, শির দে বৎস’ শোন!
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!’
॥ ছয় ॥
কেবল ইসলামী জীবন ব্যবস্থার প্রতি নয়, মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল গভীর মমত্ববোধ, অপরিসীম মমত্ববোধ! মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ছিল তার মানসিক আশ্রয় পাওয়ার জায়গা, মানসিক সুস্থিতি ফিরে পাওয়ার জায়গা, প্রেরণা পাওয়ার জায়গা। আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার এবং আত্মবিশ্বাসে স্থিত থাকারও জায়গা। দানবীর হাজী মোহাম্মদ মহসীন (১৭৩২-১৮১২), স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৭ অক্টোবর ১৮১৭ থেকে ২৭ শে মার্চ ১৮৯৮), নবাব আবদুল লতিফ (১৮২৬ থেকে ১০ই জুলাই ১৮৯৩) এবং জাস্টিস সৈয়দ আমীর আলী (৮ই এপ্রিল ১৮৪৯ থেকে ৯ই আগস্ট ১৯২৮) ও এটা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই ১৭৫৭’র ২৩ শে জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের সময় থেকে ১৮৯৩ পর্যন্ত মুসলমানরা একশ’ তেত্রিশ বছর যাবত যে সময়টা মূলত নিঃসঙ্গ এবং এককভাবে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ করে ইংরেজ উৎখাতের ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছিলেন সে সময়ে এরা মুসলমানদেরকে জ্ঞানচর্চার পথে ফিরিয়ে এনে দেশের ভবিষ্যৎ শাসন ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুতি গ্রহণের কাজে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
দানবীর হাজী মোহাম্মদ মহসীন (১৭৩২-১৮১২) তার বিরাট সম্পত্তি ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে উইল করে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করার এবং জ্ঞানচর্চার জন্য দান করে গিয়েছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৭ই অক্টোবর ১৮৯৭ থেকে ২৭ শে মার্চ ১৮৯৮) ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে সায়েন্টিফিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করে সারা পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই উর্দু ভাষায় অনুবাদ করার এবং ইংরেজি শিক্ষায় মুসলমানদেরকে শিক্ষিত করে ইংরেজ আমলের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এই একই লক্ষ্যে নবাব আবদুল লতিফ (১৮২৬ থেকে ১০ই জুলাই ১৮৯৩) ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ২রা এপ্রিল সে সময়কার ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায় ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ২রা এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত মোহামেডান লিটারেরী সোসাইটির মাধ্যমে এবং কলকাতা মুসলিম সাহিত্য সমিতির মাধ্যমে মুসলমানদেরকে ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা গ্রহণের ও জ্ঞানচর্চার কাজে উৎসাহিত করেছিলেন। জাস্টিস সৈয়দ আমীর আলী (৮ ই এপ্রিল ১৮৪৯ থেকে ৯ আগস্ট ১৯২৮) বিশেষ করে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে মুসলমানদের শিক্ষার এবং কর্ম সংস্থানের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ও সফল প্রয়াস চালিয়েছিলেন। বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার সুযোগ এখানে না থাকলেও উল্লেখ করা দরকার যে, এরা সবাই ছিলেন মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা বজায় রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী মানুষ। এদেরই অবদানের ফলে রংপুরের তসলীমুদ্দীন আহমদ সাহেবের মতো মানুষরা ওকালতি করার এবং তা’লীমুদ্দীন আহমদ (তরীকুল আলম) সাহেবের মতো মানুষরা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরি করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তা না হলে হিন্দু ও শিখদের সহযোগিতা ছাড়াই নিঃসঙ্গ অবস্থায় ইংরেজদের সঙ্গে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ করে এদেরকেও ধ্বংস হয়ে যেতে হতো।
॥ সাত ॥
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে তখন গৃহ পরিবেশে এবং কর্মক্ষেত্রে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে জীবন ধারণ করতে হতো মূলত হিন্দুদের মধ্যেই। সাম্য ও বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের সহাবস্থানের নীতিতে হিন্দুদের ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি, হিন্দুদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি, হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরার প্রতি, হিন্দুদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতিসত্তার প্রতি কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছিল শ্রদ্ধাবোধ। সব মানুষের সব অধিকারের প্রতিই তার ছিল শ্রদ্ধাবোধ। অন্য ধর্মীয় সমাজের মানুষদের ধর্মানুভ’তিকে নজরুল যে আন্তরিকভাবে কতখানি শ্রদ্ধা করতেন সে বিষয়ে নির্দ্বিধায় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে খোলাখুলি সাক্ষ্য দেবে তার লেখা কীর্তন, ভজন, শ্যামা সংগীত এবং তার সংগীতে ও সাহিত্যে ব্যবহৃত অন্যান্য ধর্মীয় সমাজের অজস্র পৌরাণিক উপাদান। এহেন অবদান কেবল কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য-সংগীতেই পাওয়া যাবে। অন্য কোথাও নয়।
তিনি জানতেন যে, বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রতিবেশী বড় সমাজের সাহিত্যে, সংগীতে, নাটকে, কাব্যে, উপন্যাসে, ছোট গল্পে, ইতিহাস বিষয়ক লেখায় এবং সাংবাদিক রচনায় হিন্দু জাতির পুনরুজ্জীবন ঘটাতে এবং হিন্দু জাতির সুযোগ-সুবিধা চিরস্থায়ী করতে হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছিল মুসলমানদেরকে। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা ক্রমে মুছে ফেলে হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা ক্রমে আরোপ করার অর্থাৎ ক্রমে এক জাতিতত্ত্ব আরোপ করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত ও হিন্দু সমাজের জাতীয়তাবাদী মহলের তরফে নেয়া হয়েছিল সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্ষদে।
সাম্য ও সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও মুসলমান সমাজের মধ্যে জাগরণ এবং ইসলামের পুনর্জাগরণ অবশ্যই চেয়েছিলেন। কিন্তু হিন্দু সমাজকে, হিন্দু জাতিকে, কিংবা অন্য কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে কোনো জাতীয়তাবাদ দাঁড় করাননি। হিন্দুদের বা অন্য কোনো জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতিসত্তা মুছে ফেলে একজাতিতত্ত্ব আরো করার কোনো পরিকল্পনাও গ্রহণ করেননি। এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেবে খোদ নজরুল সাহিত্য ও নজরুল সঙ্গীত। কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাম্য ও সহাবস্থানের নীতিতে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে কবিতা, গান, নাটক, নাটিকা ইত্যাদি রচনা করে সে সময়কার বেতার, গ্রামোফোন রেকর্ডসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করেছেন। এসব নিয়ে অন্তত মুসলমান সমাজে সে আমলে একটা জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সদস্য হওয়ার সুযোগ সে আমলে কবি কাজী নজরুল ইসলামের না থাকলেও ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে তার বিভিন্ন রকমের লেখা সাধারণভাবে মুসলমানদেরকে এবং বিশেষভাবে মুসলিম যুবকদের অনুপ্রাণিত করত। সাধারণভাবে মুসলমানরা, মুসলিম যুবকরা কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভালোবাসতেন। অনেক আবেগ নিয়ে অত্যন্ত গভীরভাবেই ভালোবাসতেন।
॥ আট ॥
সাতচল্লিশের মধ্য আগস্ট পূর্ববর্তী প্রায় ষাট বছর মুসলিম প্রধান অবিভক্ত বাংলার মুসলমানরা মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্বা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতনতার এবং সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্টের পর হিন্দু সমাজ প্রধান ভারতীয় উপমহাদেশের হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, অসচেতন ও অসংগঠিত মুসলিম প্রধান দেশে তা মার খেয়ে গেল মুসলমানপ্রধান দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী প্রধান মুসলিমপ্রধান প্রদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্বার বিরুদ্ধে ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এবং অঞ্চল ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দাঁড় করানোর ফলে। এভাবেই মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংষ্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্বা ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্টের পর খোদ মুসলিমপ্রধান দেশে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী মহলের কাছে অচ্ছুৎ হয়ে গেল। উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা, সচেতনতা ও চিন্তাভাবনার অভাবে মুসলিম জনসাধারণ তা বুঝতে পারেননি। এই অবস্থায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘কোরবানী’র মত মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্বা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত হিন্দু সমাজপ্রধান ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশেও স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়নি। পাঠ্য হয়েছে তরীকুল আলম ছদ্মনামে তা’লীমুদ্দীন আহমদের লেখা যে প্রবন্ধটির বিরুদ্ধে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘কোরবানী’ শিরোনামে কবিতা লিখেছিলেন সেই প্রবন্ধটি। প্রমাণিত হলো, মুসলমানরা মুসলিমপ্রধান দেশটিকে উপযুক্ত মর্যাদায় ধারণ করতে পারেননি।
১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত খোদ পাকিস্তান আমলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের এম.এ. ক্লাসে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং ওই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্বা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত পাঠ্য হতে পারেনি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা সাহিত্য-সঙ্গীতও অবশ্য পাঠ্য হতে পারেনি। পাঠ্য হতে পেরেছিল কেবল হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং ওই পরম্পরা ভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্বা সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত। ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ ও ‘বৈষ্ণব পদাবলী’ ও অবশ্য পাঠ্য ছিল ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত খোদ পাকিস্তান আমলেও।
অর্থনৈতিক সাম্য, সামাজিক সাম্য ও ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের নীতিতে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরা ভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্বা চর্চার অংশ হিসেবে সাম্য ও সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য-সঙ্গীতের চর্চার সংস্থান ভারতীয় উপমহাদেশের সবখানের স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে উপযুক্ত মর্যাদায় থাকা উচিত।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button