গরু নিয়ে যুদ্ধ চলছে ভারতে

ভারতে পশু রক্ষা আন্দোলন ও গরু সুরক্ষা সংঘের অত্যাচারে পশু ব্যবসায়ী কিংবা চোরাচালানকারী কেউই গরু নিচ্ছে না। বিক্রি না হওয়ায় গ্রামবাসীরা অনাকাক্সিক্ষত গরুগুলো মুক্ত ভাবে ছেড়ে দিচ্ছেন। যার ফলে গ্রামাঞ্চলে, শহরতলী, এমনকি শহরগুলিতেও গরুর সংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে। এতে প্রাণীগুলোর উপরে সহিংসতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, উত্তরপ্রদেশের এক অফিসে কয়েকটি গরু ঢুকে পড়েছে। সবাই ব্যস্ত গরু সামলাতে। পরে এক কিশোর লাঠি দিয়ে গরুগুলোকে মারতে মারতে বের করে দেয়।
গত সপ্তাহে আলীগড়ের কৃষকদের প্রতিবাদ প্রতিবেশী মথুরাতেও ছড়িয়ে যায়। গত ২৮ ডিসেম্বর, বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা অতিষ্ঠ হয়ে সেখানকার স্কুল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভ্রাম্যমাণ গবাদি পশুগুলো আটকে রাখে, এতে শিশুরা ক্লাস না করেই ফিরে যেতে বাধ্য হয়। আলীগড়ে বিরক্ত কৃষকরা ১২ টি স্কুলে ৮০০ গরু আটকে রাখে। বাচ্চাদের সেদিন ছুটি দিতে বাধ্য হয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।
আলীগড়ের মকামপুরের এক কৃষক অভিমন্যু সিং জানান, ‘গত বছর বেওয়ারিশ গরুগুলো আমার ২০ বিঘার বেশি জমির গম ধ্বংস করেছে, এতে এবার আমি বাধ্য হয়ে আলু রোপণ করি। এখন, গরুর অত্যাচারে এটাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করায় অভিমন্যু ও অন্যান্য গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করেছে।

আরেক চাষী অনিরুধ কৃমার বলেন, ‘কসাইখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেওয়ারিশ গরু বৃদ্ধি পেয়েছে। গরু বাঁচাতে এটি একটি ভাল পদক্ষেপ ছিল, কিন্তু সেগুলোকে আশ্রয় প্রদানের জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। প্রাণীগুলো আমাদের ফসল ধ্বংস করছে। আমরা এমনকি তারের বেড়া ব্যবহার করতে পারছি না কারণ এতে গরুগুলো আহত হলে সংঘ আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করবে, হয়তো আমাদেরকে এজন্য মারতেও পারে।’
গরুর অত্যাচারে মানুষও মরছে। লক্ষীপুরের খেরির দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী পারুল ভার্মা ২০১৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর সাইকেলে চালিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে গরুর আক্রমণে মারা যায়। ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর, টহল দেয়ার সময় গরুর আক্রমনে আঘাত পেয়ে মারা যান অনিল প্রতাপ সিং নামে এক পুলিশ সদস্য। একই বছর আগস্টে, গরু ফসল খেয়ে ফেলেছে শুনে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়ে মারা যান হামিরপুরের এক কৃষক। জুলাই মাসে গরু নিয়ে সংঘর্ষে উত্তর প্রদেশের বস্তিতে প্রতিবেশীর গুলিতে নিহত হন এক কৃষক।
২০১৭ সালে আগ্রার কারমনা গ্রামে এক ভয়ঙ্কর নৃশংস ঘটনা ঘটে। বাচ্চা উৎপাদনে অক্ষম হওয়ায় তাড়িয়ে দেয়া ১৫ টি গরু ও ষাড়ের উপর এসিড দিয়ে আক্রমণ করা হয়। ২৭ ডিসেম্বর, আলীগড়ের একটি খালের কাছে প্রায় এক ডজন গরু জীবন্ত চাপা দেয়া হয়।
বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, ইউপি সরকার অবৈধ কসাইখানাগুলিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং গরুর ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকার বিল পাস করায় এই অঞ্চলে গরু বেঁচা-কেনা ও পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এগুলোর সংখ্যায় অনেক বৃদ্ধি পায়।
এর আগে, কৃষকরা বাচ্চা উৎপাদনে অক্ষম গবাদি পশু ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করত, যারা সেগুলো অন্য রাজ্যে নিয়ে যেত যেখানে সেগুলো জবাইয়ের অনুমতি ছিল। এখন কৃষকরা কেবল সেগুলো তাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও, গবাদিপশু পরিবহনকারীদের উপর সংঘের সাম্প্রতিক হামলাগুলোর কারণে, অনেকেই গরু কেনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। হাথরাসের বাসিন্দা ধর্মপাল বলেন, ‘আমরা গরুগুলি এমনকি হাসপাতালে নিতেও ভয় পাই।’
এ বিষয়ে পশুচাষ মন্ত্রী এসপি সিং বাঘেল বলেন, ‘ভ্রাম্যমান গরু সংখ্যা সত্যিই বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের কাছে সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবে ২০১২ সালের গবাদিপশু শুমারী অনুযায়ী, ইউপি তে ২ কোটি গরু ছিলো।’
এই সমস্যার প্রতিক্রিয়া রাজনীতিতেও পড়েছে। ২০১৪ সালে আলওয়ার ও ভরতপুরে গরু রক্ষা সংঘের অত্যাচার সবচেয়ে বেশী ছিল। তাদের বিরুদ্ধে জনগণের রাগ দুই জায়গাতেই বিজেপি’র হারের কারণ হিসাবে দেখা হয়।
হরিয়ানার বিখ্যাত দুগ্ধ উৎপাদক ভরত হিয়ের বলেন, ‘গরু রক্ষা সংঘ অভিশাপ হয়ে গেছে। বার্ষিক মেলাতে গবাদি পশু নেয়া যাচ্ছে না। বিজেপি সরকার আশ্রয়স্থলগুলিতে যতটা সম্ভব গবাদি পশু রাখতে চেষ্টা করেছে কিন্তু মৌলিক সুবিধার অভাবে এগুলোর মৃত্যু হচ্ছে।
অল ইন্ডিয়া কিসান সভার দয়ানন্দ পুনিয়া বলেন, ‘প্রাণীদের পরিবহন আইন ও রক্ষা সংঘের কারণে অসহায় অধিকাংশ কৃষক গবাদি পশু বিক্রি করতে পারে না। আশ্রয়স্থল বানিয়ে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সমাধানের একমাত্র উপায় গবাদি পশু মেলা পুনরায় শুরু করা হয়।’

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button