ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান কি নিষিদ্ধ?

বব ভাইলানের গ্লাস্টনবারি পারফরম্যান্সে “আইডিএফ-এর মৃত্যু হোক” শ্লোগানকে ঘিরে শুরু হওয়া বিতর্কটি শুধুই শিল্পীর বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়। এটি আরও গভীর কিছু উন্মোচন করেছে—বিশেষ করে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে ব্রিটেনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমা, জবাবদিহিতার অনীহা, এবং সংহতির ভাষাকে ঘৃণার প্রচার হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা।
গ্লাস্টনবারি বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক প্রতিবাদের সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ, পরিবেশ ন্যায়বিচার, দারিদ্র্যবিরোধী আন্দোলন, নারী অধিকার এবং সমতার পক্ষে বরাবরই স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে সংগীত পার্টনারশীপটি।
দ্বৈত সংগীত পার্টনারশীপের প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল ইভিস একবার বলেছিলেন, যদি কেউ গ্লাস্টনবারির রাজনীতি পছন্দ না করে, তাহলে তারা “অন্য কোথাও যেতে পারে”। দ্বৈত সংগীত পার্টনারশীপে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক এলাকা ‘লেফট ফিল্ড’ রয়েছে, যেখানে প্রতিদিন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
তবে এবারের ঘটনায় স্পষ্ট একটি দ্বিচারী দ্বৈত মানদণ্ড সামনে এসেছে। বিবিসি নির্দ্বিধায় সম্প্রচার করেছে এমন এক পারফরম্যান্স যেখানে নারীদের প্রতি অবমাননাকর ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশকারী বব ভাইলানের পারফরম্যান্স মুছে ফেলা হয়েছে। বিবিসি সেটিকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ বলে নিন্দা করে এবং দ্রুত ক্ষমা চায়।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার এটিকে “ভয়ঙ্কর ঘৃণার ভাষা” বলে অভিহিত করেন। ইসরায়েলি দূতাবাস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। বব ভাইলানের মার্কিন ভিসা বাতিল করা হয় এবং তাঁর ও আয়ারল্যান্ডের র‍্যাপার গ্রুপ ‘নীক্যাপ’-এর বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্ত শুরু হয়।
এই প্রতিক্রিয়া ছিল শুধু ভাষার জন্য নয়:
এটি ছিল একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা—যে কোনও রাজনৈতিক অবস্থান, বিশেষ করে ব্রিটেন ও পশ্চিমা জগতের ইসরায়েল সংশ্লিষ্ট ভূমিকার সমালোচনার বিরুদ্ধে মুখ বন্ধ করার একটি কৌশল।
যখন একজন শিল্পীর কঠোর শব্দচয়নের বিরুদ্ধে ঝড় ওঠে, ঠিক সেই সময়ে গাজায় খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করে হত্যা করে, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে আসে। অর্থাৎ, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চালানো সহিংসতার চেয়ে সেই সহিংসতা উন্মোচনকারী শব্দগুলিকেই অধিক বিপজ্জনক মনে করা হচ্ছে।
“ঘৃণার ভাষা” না রাজনৈতিক প্রতিবাদ?
বব ভাইলানের ভাষা শালীন ছিল না—কারণ এটি প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিবাদ কখনওই ভদ্র হয় না। কিন্তু এই শব্দগুলোকে “ঘৃণার ভাষা” বলে চিহ্নিত করা এবং একই সঙ্গে ইসরায়েলি মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে গণহত্যার আহ্বান জানালেও তার কোনো নিন্দা না করা—এটি এক ধরনের রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা।
এটি শুধু শিষ্টাচার রক্ষা নয়—এটি ইসরায়েলি দখলদার ও সহিংসতামূলক ন্যারেটিভ রক্ষার একটি কৌশল। আইডিএফ-এর বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুললেই সেই প্রতিবাদীকে ‘চরমপন্থী’, ‘বিদ্বেষপরায়ণ’ বলা হয়।
বব ভাইলানের শ্লোগান ছিল না কোনো নীতিগত প্রস্তাব। বরং এটি ছিল এক ধরনের আর্তনাদ—একটি চলমান মানবিক বিপর্যয়ের প্রতি ক্ষোভ ও উদ্বেগের প্রকাশ। গত ২১ মাসে গাজায় অধিকাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে; স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল গুঁড়িয়ে গেছে; ৫৭,৪১৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ১,৩০,০০০-জনেরও বেশি।
কারা কথা বলার অধিকার পাবে?
এই প্রতিক্রিয়া আসলে নির্ধারণ করে দেয়—কে কথা বলার অধিকার পাবে, কী ধরনের শব্দ গ্রহণযোগ্য হবে, কোন সত্য প্রকাশযোগ্য, এবং কোন জীবন রক্ষার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে।
এই বিতর্ক তখনই আরও গভীর হয় যখন ব্রিটিশ সরকার শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারী সংগঠন ‘প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে, যেখানে একইসঙ্গে দুইটি সহিংস সংগঠনের নামও ছিল। এটি যুক্তরাজ্যে মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর এক বিপজ্জনক আঘাত।
ভবিষ্যৎ সংকেত:
যদি বব ভাইলান ও নীক্যাপ-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তবে এটি শিল্পী, কর্মী ও সাধারণ জনগণের জন্য একটি ভীতিকর বার্তা হবে—প্যালেস্টাইনের পক্ষে দাঁড়ানো বা ক্ষমতাবান গোষ্ঠী দ্বারা অসমর্থিত কোনো বিষয়ে মতপ্রকাশ করা হলে সেটি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
যখন শব্দের শাস্তি যুদ্ধাপরাধ ও সম্ভাব্য গণহত্যার চেয়েও বেশি কঠোর হয়—তখন সবারই আতঙ্কিত হওয়া উচিত। কারণ এটি শুধুই একটি সংগীত পার্টনারশীপে উচ্চারিত কিছু কথার বিষয় নয়, এটি হলো: কে কথা বলার অধিকার পাবে? কোন সত্য বলা যাবে? এবং কার জীবনকে মূল্যবান মনে করা হবে? -ইসমাইল প্যাটেল, ইসমাইল প্যাটেল “The Muslim Problem: From the British Empire to Islamophobia” বইটির লেখক। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিডস-এর ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক এনজিও ফ্রেন্ডস অব আল-আকসা (Friends of Al-Aqsa)-এর চেয়ারম্যান।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button