ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতির বাস্তব ফলাফল কী
আগামী সেপ্টেম্বর মাসে, ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে—যা এর আগে স্পেন, নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ডসহ কয়েকটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ এবং একই পথে এগোনো যুক্তরাজ্যের পরবর্তী পদক্ষেপ বা সংযোজন। এখন পর্যন্ত মোট ১০টি ইইউ সদস্য রাষ্ট্র ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২৪ জুলাই এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে তুলে ধরেন এবং বলেন, ফ্রান্স “ইসরায়েলি, ফিলিস্তিনি এবং ইউরোপীয় ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের” সঙ্গে একত্রে শান্তির সম্ভাবনা দেখাতে চায়।
কিন্তু ম্যাক্রোঁর এই বক্তব্য, আগের বহু বিবৃতির মতোই, একটি কেন্দ্রীয় সত্যকে উপেক্ষা করে: কেবলমাত্র স্বীকৃতি কখনোই ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা ইসরায়েলের দখলদারিত্ব অবসানের কাছাকাছিও নিয়ে যায়নি। এটি আরও বেদনাদায়ক, বিশেষত যুক্তরাজ্যের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে বিবেচনা করলে—ব্যালফোর ঘোষণাপত্র ও ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের মাধ্যমে ইসরায়েলের বীজ বপনের মধ্য দিয়ে যে সংঘাত শুরু হয়েছিল, তার সমাধান আজও অধরা।
বাস্তবতা হলো: জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেও, এখনো এটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নয় এবং জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদও পায়নি। ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর স্বীকৃতি আসতে থাকে, কিন্তু সেখানেই থেমে যায়। খুব কম দেশই বাস্তবিক পদক্ষেপ নিয়েছে এই স্বীকৃতিকে প্রকৃত সার্বভৌমত্বে রূপ দিতে। ফলাফল হলো: কয়েক দশকের ফাঁপা ঘোষণা—যা ইসরায়েলকে তাদের দখলদারিত্ব আরও মজবুত করার সুযোগ দিয়েছে, যখন বিশ্ব কেবল প্রতীকী নীতিকথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
এই ব্যর্থতার মূল কারণ একটি বিপজ্জনক ভুল ধারণা: কাগজে স্বীকৃতি দেওয়াটাকেই যেন উদ্দেশ্য মনে করা, বাস্তব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে একটি পদক্ষেপ নয়। প্রায় সব জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্র, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও, দুই-রাষ্ট্র সমাধান সমর্থনের কথা বলে, অথচ তারা ইসরায়েলের হাতে সেই সমাধানকে ধ্বংস হতে দেয়। বর্তমান ইসরায়েলি সরকার এমন এক রাজনৈতিক প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছে যার মূল লক্ষ্য হলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তাঁর রাজনৈতিক জীবন গড়েছেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে অস্বীকার করার উপর ভিত্তি করে, এবং বর্তমানে তাঁর ক্ষমতা টিকে আছে এই কঠোর অবস্থান বজায় রাখার উপর। গাজায় আমরা দেখেছি তিনি কেমন নেতা—একজন প্রতিশোধপরায়ণ রাজনীতিবিদ, যার আন্তর্জাতিক মতামত, ফিলিস্তিনিদের জীবন বা এমনকি ইসরায়েলের ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই।
প্রশ্ন এখন আর এটি নয় যে, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে কি না—প্রশ্ন হলো, সেই স্বীকৃতি কী ফল দেবে। বহুবার দেখা গেছে, সরকারগুলো এ ধরনের স্বীকৃতিকে কেবল একটি প্রতীকী অবস্থান গ্রহণের উপায় হিসেবে ব্যবহার করেছে, কিন্তু প্রকৃত দখলদারিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে ব্যর্থ হয়েছে—যা ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালত দ্বারা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে, এবং যা জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রসমূহের জন্য বাধ্যতামূলক।
যদি স্বীকৃতির সঙ্গে বাস্তব পদক্ষেপ না থাকে যা ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্ব মেনে চলতে বাধ্য করে, তবে তা নিছক রাজনৈতিক নাটক ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমাদের লক্ষ্য হতে হবে শুধুমাত্র কাগজে স্বীকৃতি নয়, বরং একটি সার্বভৌম, টেকসই, সংযুক্ত এবং প্রকৃত স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন। এমন রাষ্ট্র কোনও রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে জন্মাবে না। এর জন্য প্রয়োজন বড় পরাশক্তিগুলোর সমন্বিত ও স্থায়ী চাপ, যেন একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ইসরায়েলকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নিতে বাধ্য করা যায়।
সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে, যেখানে ১২৫টির বেশি জাতিসংঘ সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা স্পষ্ট হয়: সৌদি আরব কখনোই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না, যতক্ষণ না একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতি পায়।
সৌদি আরবের এই অবস্থান নেতানিয়াহুর জন্য একটি বড় রাজনৈতিক ও নৈতিক পরাজয়। আব্রাহাম চুক্তির আদলে রিয়াদের সঙ্গে একটি কূটনৈতিক সমঝোতা অর্জনের যে আশা ইসরায়েল করেছিল, তা কার্যত ধূলিসাৎ হলো। নিউ ইয়র্ক ঘোষণাপত্র সেই আশায় পানি ঢেলে দেয়।
এই বাস্তবতা স্পষ্ট করে যে, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া ভূমিকা এখন অবসান হওয়া দরকার। গত কয়েক দশকে ওয়াশিংটনের পক্ষপাতদুষ্ট মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা শান্তির কোনও বাস্তব ফল আনেনি। এখন সময় এসেছে এই প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সক্রিয় ও স্বাধীন ভূমিকা নিশ্চিত করার—বিশেষত ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের। যেমন আমি আমার সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে বলেছি, ইউরোপের উচিত একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা যা আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, যুক্তরাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর অনুকরণ করে নয়।
একটি বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক কৌশল এখন অপরিহার্য—যা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান অচলাবস্থা ভাঙতে সহায়তা করবে।
ইসরায়েলকে স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে যে, সে আর আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং তার প্রতিটি কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে।
কিছু দেশ যেমন ইতালি, দাবি করে যে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে স্বীকৃতি প্রদান অযৌক্তিক। কিন্তু এই যুক্তি ঐতিহাসিকভাবে ভ্রান্ত। দক্ষিণ সুদান ২০১১ সালে স্বীকৃতি পেয়েছিল, যদিও তখনও তার রাজনৈতিক অবকাঠামো পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। পূর্ব তিমুর বা এমনকি ইসরায়েল নিজেও তখন স্বীকৃতি পেয়েছিল, যখন তাদের চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারিত হয়নি।
এইসব উদাহরণ প্রমাণ করে যে, স্বীকৃতি একটি পুরস্কার নয় বরং একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ—যা রাষ্ট্র নির্মাণ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথে গতি সৃষ্টি করে। -ড. মুস্তাফা ফেতৌরি
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



