কারবালা : মুসলিম বিশ্বে আপসহীন চেতনার উত্স

এহসান বিন মুজাহির:
আরবি হিজরি সনের প্রথম মাস হচ্ছে মহরম। মহরম একটি পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসেই্ ঐতিহাসিক ‘কারবালা ট্রাজেডি’ সংঘটিত হয়েছিল। মানব জাতির পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকেই নানা ঘটনাপ্রবাহের ঐতিহ্য বহন করছে এ মাস। বিশেষ করে কারবালার রক্তঝরা ঘটনার প্রেক্ষিতে মহরম মাস আরও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। দশ মহরম ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে বাতিলের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতে গিয়ে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করেন হজরত হোসাইন (রা.)। সেই শহিদী খুন, সে লহুকাতরা কতটুকু আমাদের অনুপ্রাণিত করতে পেরেছে এখন সময় এসেছে তা মূল্যায়ন করার।
মাহে মহরম এলেই আমরা হজরত হাসান ও হজরত হোসাইন (রা.)-এর কথা স্মরণ করে তাজিয়া মিছিল, র্যালি. মিলাদ-কিয়ামসহ ইত্যাদি করে থাকি। হজরত হাসান ও হজরত হোসাইন (রা.)-এর প্রেমে পাগল হয়ে হাসান-হোসাইন বলে মাতম করি। অথচ আমরা কি একবার ভেবে দেখেছি যে, আমরা যা করছি এগুলো কি শরীয়তসম্মত? এটা কি কারবালার আদর্শ? কারবালার আদর্শ তথা হোসাইনি আদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা কতটুকু চেষ্টা করছি? বক্তৃতা, লেখনি, কথাবার্তা তথা সবক্ষেত্রেই আমরা স্লোগান দিয়ে থাকি, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হায় কারবালাকে বাদ।’ কিন্ু্ত আমরা কি কারবালার আদর্শ ও শিক্ষাকে যথাযথভাবে অনুসরণ করছি, বিষয়টি বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে গভীর চিন্তা করা দরকার! তারপরও আমরা বলে থাকি, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হায়…’।
ঐতিহাসিক কারবালার সূত্রপাত : ১০ মহরম ফুরাত নদীর তীরে কারবালার মরু প্রান্তরে ঐতিহাসিক মর্মান্তিক ট্রাজেডি ‘কারবালা’ সঙ্ঘটিত হয়েছিল। দশ মহরম হযরত হোসাইন (রা.) অল্প সংখ্যক সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে জালিম শাসক ইয়াজিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন কারবালা প্রান্তরে। সেদিন মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকারাশি রক্তে রক্তাক্ত হয়েছিল। জালিম শাসক ইয়াজিদ চেয়েছিল মুসলিমজাহানের ক্ষমতা হিসেবে হযরত হোসাইনের (রা.) পক্ষ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে নিতে। যদি হোসাইন (রা.) ইয়াজিদকে মুসলিমজাহানের খলিফা হিসেবে মেনে নিতেন এবং তার কাছে নত হয়ে যেতেন তাহলে সেই কারবালা আর হতো না। কিন্তু হোসাইন (রা.) সেই ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেননি এবং তার কাছে মাথা নত তথা আপস করেননি বরং তিনি বললেন, ‘জালিম শাসকের প্রতি আনুগত্য তথা সমর্থন দেয়ার চেয়ে শহীদ হওয়াই শ্রেয়।’
নত না হওয়ার কারণেই ইয়াজিদ ক্ষুব্ধ হয়ে হজরত হোসাইনকে (রা.) হত্যার জন্য বিভিন্ন সুযোগ খুঁজতে থাকে। ইয়াজিদ ছিল অনৈতিক চরিত্রের অধিকারী। সে চেয়েছিল মুসলিম জাহানের খলিফা হতে কিন্ু্ত তার অসত্ চরিত্রের কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। অপরদিকে হজরত হোসাইন (রা.) ছিলেন নৈতিক তথা উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তিনি সব শ্রেণীর মানুষের কাছে ছিলেন সম্মানের পাত্র। কুফাবাসীরা ইয়াজিদের শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল, যার কারণে তারা হজরত ইমাম হোসাইনকে (রা.) কুফায় আসার জন্য নিমন্ত্রণ করল।
হজরত হোসাইন (রা.) কুফাবাসীদের দাওয়াত পেয়ে কুফার অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য তার ভাই মুসলিমকে কুফায় প্রেরণ করেন। হজরত মুসলিম (রা.) কুফার অনুকূল পরিবেশ প্রত্যক্ষ করে হজরত হোসাইনকে (রা.) তথায় যাওয়ার জন্য পত্র লিখলেন। পত্র প্রেরণ করার অল্পক্ষণ পরই কৃফার শাসনকর্তা হজরত মুসলিমকে হত্যা করে এবং নিমন্ত্রণকারীরা তথা কুফাবাসীরা জালিম শাসক ইয়াজিদের পক্ষে যোগদান করে। মুসলিম (রা.)-এর শাহাদতের সংবাদ না জানার কারণে তিনি পরিবারবর্গসহ অন্য সঙ্গীদের নিয়ে কুফার উদ্দেশে রওনা দেন। কুফায় পৌঁছামাত্রই পাষণ্ড ইয়াজিদ এবং তার দোসররা হজরত হোসাইন (রা.) ও তার সঙ্গী-সাথীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। হোসাইন (রা.) ইয়াজিদকে বললেন, ভাই আমরা তো এখানে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসিনি। বরং কুফাবাসীদের নিমন্ত্রণ পেয়েই এসেছি। কিন্ু্ত কুফাবাসীরা যে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এটা আমাদের জানা ছিল না। ভাই ইয়াজিদ, আপনি আমাদের ওপর আর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাবেন না, আমরা ্কুফা থেকে চলে যাব, আপনি আমাদের গন্তব্যস্থলে চলে যাওয়ার সুযোগটুকু দিন।
কিন্তু নিষ্ঠুর ইয়াজিদ হোসাইন (রা:)-এর কোনো কথায়ই কর্ণপাত করেনি বরং সে তার দল-বল নিয়ে তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায় । এত নির্যাতনের পরেও হোসাইন (রা:) কোনো প্রতিশোধ নিলেন না। ইয়াজিদকে বার বার বোঝাতে লাগলেন, দেখ আমি বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.)-এর নাতি। তুমি মুসলমান, আমিও মুসলমান। আমাদের ওপর আক্রমণ বন্ধ কর, তোমার মঙ্গল হবে। এত কিছু বলার পরেও পাষণ্ড ইয়াজিদ আক্রমণ থামায়নি। শেষ পর্যায়ে হজরত হোসাইন (রা.) তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ইয়াজিদের ওপর আক্রমণ চালালেন।
যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। উভয়ের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। হকের পক্ষে তথা হজরত হোসাইন (রা.) তার পক্ষে সৈন্য সংখ্যা মাত্র ষাট-সত্তরজন। এর মধ্যে নিষ্পাপ কচিকাঁচারা ও নারীদের সংখ্যাই ছিল বেশি। আর অপরদিকে ইয়াজিদ তথা বাতিলের সংখ্যা দ্বিগুণ বেশি। যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হজরত হোসাইন (রা.)-এর বালক শিশু আলী আজগরসহ অন্য শিশুরা পানি, পানি বলে আর্তচিত্কার করছে। পানির জন্য তারা ছটফট করছে কিন্তু পাষণ্ড ইয়াজিদ ও তার সৈন্য বাহিনী পানি দেয়া দূরের কথা বরং তারা নিষ্পাপ শিশু ও মহিলাদের ওপরও নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়ে তাদের শহীদ করে দিল। বালক-শিশুরাও তাদের সামর্থ্যের আলোকে ইয়াজিদ বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে কারবালার যুদ্ধে শরিক হলো।
দ্বীন কায়েম তথা হকের পক্ষে আন্দোলন করতে গিয়েই তিনি শাহাদত বরণ করলেন। তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে দিলেন, তবু তিনি বাতিলের সঙ্গে আপস করেননি। আপসহীনতাই ঐতিহাসিক কারবালার আদর্শ। এ কারণেই তো আমরা বলে থাকি, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হায় কারবালাকে বাদ’। কোথায় আজ কারবালার আদর্শ। ‘হায় হাসান, হায় হোসাইন’ বলে মাতম করা, তাজিয়া, র্যালি এগুলো কি কারবালার আদর্শ। হায় মুসলমান, আমরা কি ভেবে দেখেছি একবার হোসাইন (রা.) কী কারণে জীবন বিলিয়ে দিলেন। যদি ভেবে দেখতাম আর সে আদর্শ অনুযায়ী সবাই চলতাম তাহলে দৃঢ় বিশ্বাস, এতদিনে এদেশে আল্লাহর দ্বীন তথা হুকুমাত কায়েম হয়ে যেত। ইসলামের দুশমন ও জালিম শাসকরা এদেশে রাজত্ব করত না এবং বিশ্বনবী ও শান্তির ধর্মকে নিয়ে অবমাননা করার সাহস পেত না। নাস্তিক মুরতাদ ও ইয়াহুদি-খ্রিস্টানরা দুনিয়াতে নীরব-নিথর হয়ে বসে থাকত। ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে চক্রান্ত করার সুযোগ পেত না। আমরা কারবালার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণেই দেশ-বিদেশে এ অবস্থা।
কারবালা আমাদের আপসহীনতার দিকে অনুপ্রাণিত করে। দ্বীন কায়েমের সংগ্রামে উদ্বেলিত করে। কারবালাকে উপলক্ষ করে আবার একশ্রেণীর ভণ্ডরা বিভিন্ন ধরনের ফায়দা হাসিল করে। কেউ মিলাদ-কিয়াম পালনের মাধ্যমে নিজেদের পকেট গরম করে। আবার কেউ মাজারকে কেন্দ্র করে নিজেদের উদ্দেশ্য অর্জন করছে। সুপ্রিয় সচেতন পাঠক! কারবালা আমাদের জন্য অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ইতিহাস। এই কারবালা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। বিশেষ করে শরীয়তবিরোধী কর্মকাণ্ড তথা মাতম, তাজিয়া, র্যালি ইত্যাদি কার্যক্রম পরিহার করতে হবে এবং কারবালার আদর্শকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে হবে। মহান আরশের অধিপতি আল্লাহতা’লা আমাদের সবাইকে কারবালার আদর্শ বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : কলামিস্ট ও অনুবাদক

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button