তুরস্কের পাঠানো পিপিই নিয়ে পানি ঘোলা করল ব্রিটেন

২০-২৫ দিন কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ আজকে ব্রিটেনের মনে হলো যে, এগুলোর গুণগতমান ঠিক নেই

করোনা মোকাবেলায় ব্রিটিশ সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে যখন দেশের ভেতরে নানা সমালোচনা হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে তুরস্ক থেকে নেয়া কিছু মেডিকেল সামগ্রী নিয়ে পানি ঘোলা করতে ওঠেপড়ে লাগছে দেশটির সরকার ও মিডিয়া। ব্রিটিশ সরকারের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে সে দেশের পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়, তুরস্ক থেকে নেয়া চার লাখ ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী বা পিপিই যথাযথ গুণগতমানসম্পন্ন নয়। তাই তারা ওগুলো ব্যবহার না করে তুরস্কে ফেরত পাঠাবে।

যেভাবে সংবাদ উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে পাঠকের মনে হবে যে– খুবই সাধারণভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ তুরস্কের সরকার নিম্নমানের কিছু সুরক্ষাসামগ্রী পাঠিয়ে ব্রিটেনকে ধোঁকা দিয়েছে। ব্যাপারটি যদি তাই হয়, তা হলে তো মহাঅন্যায় করে ফেলেছে তুরস্ক!কিন্তু আসলে কি তাই? ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সত্যিকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আসলে এভাবে সংবাদ ছড়ানোর পেছনে আছে বহুকাল ধরে চলে আশা ব্রিটিশ চাতুর্য।
এবার মূল কথায় আসি। এপ্রিলের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্যের নার্সদের ময়লা ফেলার পলিথিনকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ(পিপিই) হিসেবে ব্যবহারের ছবি যখন সামাজিমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তখন অনেক ব্রিটিশ মিডিয়াই এ ব্যাপারে ফলাও করে সংবাদ প্রচার করে। বরিস জনসনের সরকার তখন পাগলের মতো খুঁজে এ সুরক্ষাসামগ্রী।
প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যেখানে করোনায় আক্রান্ত, সেখানে সাধারণ মানুষের সুরক্ষার বিষয়টি তো আরও পরে। কিন্তু অন্তত স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা করে সুরক্ষাসামগ্রী না দিতে পারলে তো ব্রিটেনের মান বাঁচানো দায়। ততদিনে ব্রিটিশ মিডিয়া দেশটিকে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। তখন এই দুর্দিনে পাশে দাঁড়ায় তুরস্ক। তুর্কি সরকার মার্চ মাসের ৭ তারিখ ব্রিটিশ সরকারকে দান করে এক লাখ পিপিই, এক লাখ সারজিক্যাল মাস্ক এবং ৫০ হাজার এন৯৫ মাস্ক। তুরস্ক নিজস্ব সামরিক বিমানে করে এগুলো পৌঁছে দেয় ব্রিটেনে।
মেডিকেলসামগ্রী পেয়ে ব্রিটিশ সরকার যারপরনাই খুশি হয়ে তুরস্ক থেকে আরও পিপিই নিতে এবার সেলেগনা নামের একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে। কিন্তু মার্চের ১৮ তারিখ ব্রিটিশ স্বাস্থ্য ডিপার্টমেন্ট ঘোষণা দেয় যে, তাদের স্টকে যত পিপিই আছে তা দিয়ে আর মাত্র ৪৮ ঘণ্টা চলা সম্ভব।
তখন ব্রিটিশ সরকার তুর্কি কোম্পানিটিকে চাপ দেয় সাপ্লাইগুলো তাড়াতাড়ি দেয়ার জন্য। কিন্তু কোম্পানি চুক্তিতে যে তারিখ দেয়া আছে, তার আগে দিতে পারবে না বলে জানায়। অথচ চাপের মধ্যে থাকা বরিস জনসন সরকার দেশের মধ্যে সমালোচকদের মুখ বন্ধে হুট করেই ঘোষণা দেয় যে, তুরস্ক থেকে ৮৪ টন পিপিই আসছে। ২৪ ঘণ্টা পরও যখন তুরস্ক থেকে কোনো সাপ্লাই যায়নি, তখন আবার মিডিয়া ক্ষেপে ওঠে। সরকার ঘোষণা দেয় তুরস্ক মেডিকেলসামগ্রীগুলো পাঠাতে বিলম্ব করছে।
ঘোষণাগুলো এমনভাবে আসে যেন তুরস্কের সরকার এগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে করছে। অথচ এই মাস্ক কেনার ব্যাপারে বা এগুলো সরবরাহের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার তুরস্কের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো রকম কূটনৈতিক আলোচনা করেনি। এমনকি কোম্পানিটির অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের জনগণকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য হঠাৎ করেই বিমানবাহিনীর একটি কার্গো বিমান পাঠিয়ে দেয় তুরস্কে। তাদের ঘোষিত ৮৪ টন জিনিসপত্রের জন্য পাঠানো হয় ৩৭ টন বহন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিমান।
যাই হোক, পরে শিপমেন্ট তাড়াতাড়ি ছাড়ানোর জন্য তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চাওয়া হয়। কোম্পানিটি চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারায় ঘাটতি পূরণ করতে তুরস্কের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তখন নিজস্ব ভাণ্ডার থেকে আরও প্রায় ৭০ হাজার পিপিই দান করে।
ঘটনা এখানেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু জিনিসপত্রগুলো নেয়ার প্রায় ২০-২৫ দিন কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ আজকে তাদের মনে হলো যে, এগুলোর গুণগতমান ঠিক নেই। এগুলো তুরস্কে ফেরত পাঠাতে হবে। আর ব্রিটিশ মিডিয়া লুফে নিল খবরটি। বাছবিচার না করেই ঝাঁপিয়ে পড়ল তুরস্কের গলা টিপে ধরতে।
বিষয়টি যদি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ বা স্পর্শকাতর হয়, তবে ব্রিটিশ সরকারের উচিত তুরস্ক সরকারের সঙ্গে বা ওই কোম্পানির সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করা। না কোম্পানিকে এ বিষয়ে কোনো কিছু জানানো হয়েছে, না তুরস্ক সরকারের কাছ কোনো অভিযোগ করা হয়েছে।

তুরস্ককে কাজে অকাজে, সময়ে-অসময়ে আক্রমণের বাণ ছুড়ে মারা ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এবং সে দেশের মিডিয়ার জন্য এটিই প্রথম না। ব্রেক্সিটের সময়, তুরস্কের নির্বাচনের সময়, তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার সময় এ ধরনের বহু আক্রমণ বারবার করা হয়েছে।

মোদ্দা কথা– এই পিপিইগুলো কিন্তু তুরস্ক সরকারের দেয়া পিপিই না। এমনকি ওই কোম্পানি থেকে নেয়া পিপিইগুলোও কিন্তু নেয়ার আগে আন্তর্জাতিক মান অর্থাৎ সিই এবং আইএসও সার্টিফিকেট পরখ করে দেখেই নেয়া হয়।
আমেরিকা, ইতালি, স্পেনসহ বিশ্বের প্রায় ৬০ দেশে মেডিকেলসামগ্রী পাঠিয়ে যখন সারা বিশ্বের বাহবা কুড়াচ্ছে তুরস্ক; কেউ যখন গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি, তখন পানি ঘোলা করছে ব্রিটিশ মিডিয়া।
আসলে পানি ঘোলা করার ব্যাপারে ব্রিটিশ মিডিয়া সবসময়ই যথেষ্ট পারদর্শী। আর এ ক্ষেত্রে আগুনে ঘি ঢালেন ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। করবেই-না বা কেন। যখন সরকার করোনা মোকাবেলায় নানা প্রতিজ্ঞা করেও জনগণকে কোনো সফলতাই দেখাতে পারছে না, তখন মানুষের মনোযোগ ভিন্নদিকে নিতে কৃত্রিম কোনো ইস্যু তো তৈরি করতেই হবে।
তুরস্ককে কাজে অকাজে, সময়ে-অসময়ে আক্রমণের বাণ ছুড়ে মারা ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এবং সে দেশের মিডিয়ার জন্য এটিই প্রথম না। ব্রেক্সিটের সময়, তুরস্কের নির্বাচনের সময়, তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার সময় এ ধরনের বহু আক্রমণ বারবার করা হয়েছে।
তবে হুদাই পানি ঘোলা করার পর তুরস্কে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বিষয়টি খোলাসা করেন। তুর্কি ও ইংরেজি ভাষায় একগাদা টুইট করে তিনি বলেন, ব্রিটিশ মিডিয়াতে প্রচার করা খবর অসত্য ও ভিত্তিহীন।
তিনি আরও জানান, তুরস্কের ওই কোম্পানিটি থেকে নেয়া পিপিইর প্রায় সবই গুণগতমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। খুবই অল্প কিছু পিপিই এই গুণগত মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি।
তিনি আরও নিশ্চিত করেন যে, তুরস্কের সরকারের দেয়া পিপিইগুলোর গুণগত মান নিয়ে কোন সমস্যা নেই। তিনি তার দেশের এই ক্রান্তিকালে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ায় তুরস্ককে ধন্যবাদ জানান।
লেখক: সরোয়ার আলম, আনাদলু এজেন্সির এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button