লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক: মুসলমানদের সম্পর্কে পশ্চিমের নৈতিক বিভ্রান্তি

জোহরান মামদানি নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ইসরায়েলের ডায়াসপোরা মন্ত্রী আমিছাই চিকলি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন—তা মুসলমানদের সম্পর্কে পশ্চিমের নৈতিক ভুল-বোঝাবুঝির এক ক্লাসিক উদাহরণ। চিকলি কোনো বিশেষ ইসরায়েলি উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। তার সতর্কবার্তা হচ্ছে, “নিউইয়র্ক খোলা চোখ নিয়ে সেই অতলে হাঁটছে যেখানে লন্ডন ইতিমধ্যেই পড়ে গেছে”। ঠিক একই ধরনের ডানপন্থী বক্তব্য সাদিক খান লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার সময় শোনা গিয়েছিল। কিন্তু কিছুই ভেঙে পড়েনি। লন্ডন তার বহু-সাংস্কৃতিক কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখেছে, প্রায় সব ধর্মকে আলিঙ্গন করে। খান কখনোই শুধু মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করবেন এমন দাবি করেননি। মামদানির ক্ষেত্রেও তা-ই হবে। নিউইয়র্ক কোনো অতলে পড়বে না—যেমন লন্ডন পড়েনি।
আর ট্রাম্পের সেই বক্তব্য যাতে তিনি বলেছেন, মামদানিকে সমর্থন করা ইহুদি ভোটাররা “মূর্খ”—তা আমেরিকান রাজনীতির আকাশে বিষাক্ত ধূলিকণার মতো মিলিয়ে যাবে। মামদানির বিজয়—যার সঙ্গে অন্তত আরও ৩৮ জন মুসলিম প্রার্থী বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ও পৌর পদে নির্বাচিত হয়েছেন, তা এক গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। মুসলমানরা আর আমেরিকান শহরগুলোর প্রান্তে নেই বরং সেগুলো গড়ে তুলছেন, সর্বোচ্চ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, এবং নাগরিক পরিচয়ের অর্থ পুনঃনির্ধারণ করছেন।
মামদানিকে তার স্পষ্টবাদীতা এবং বিভাজনমূলক বিতর্কে না জড়ানোই তাকে এই পরিবর্তনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি করে তুলেছে। বিজয়ী ভাষণে মামদানি বলেছেন: “আমি মুসলমান হওয়া, তরুণ হওয়া, বা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হওয়ার জন্য কখনোই ক্ষমা চাইব না।” ট্রাম্পের “মূর্খতা” নিয়ে জনপ্রিয় বক্তব্য আসলে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির গভীর এক বিভ্রান্তিকে উন্মোচিত করে—যারা মুসলমানদের ঠিকমতো বুঝতে পারে না, অথচ তারা সেই শহরগুলোর অপরিহার্য নির্মাতা যেগুলোকে তারা আজ নেতৃত্বও দিচ্ছে।
আমি একবার মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মধ্য-স্তরের কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম যিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতি প্রায়ই আরব বিশ্বের বাস্তবতা বুঝতে ব্যর্থ হয়। এই কর্মকর্তা লিবিয়াকে নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে অনর্গল কথা বলছিলেন—তার উপজাতীয় কাঠামো, ঔপনিবেশিক-বিরোধী প্রতিরোধ, এমনকি আলী সিদকি আবদুল-কাদিরের কবিতা এবং ইব্রাহিম আল-কুনি ও সাদিক আল-নাইহোমের উপন্যাস পর্যন্ত। যখন আমি কথোপকথনটি ইরাকের দিকে সরালাম, তিনিও থমকালেন না। যেন তিনি কোনো ব্রিফিং কাগজ নয়, নিজের ভেতরের নোটবই থেকে পড়ছেন।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম: “স্টেট ডিপার্টমেন্টে আপনার মতো মানুষ কতজন আছেন?” তিনি উত্তর দিলেন :“দুর্ভাগ্যজনকভাবে, খুব বেশি নয়।” তারপর আসেন মার্কিন কনসাল জোসেফ বার্টন—যিনি আরও গভীর সংকট উন্মোচন করেন: যা হচ্ছে বিবেকের সংকট।
দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি লেখায় বার্টন লিখেছিলেন: “আমি আঙ্কারায় মার্কিন দূতাবাসে কনস্যুলার অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করার সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির সব কিছু পছন্দ করতাম না। কিন্তু আমি প্রতিটি ভিসা আবেদনকারীকে ন্যায্য আচরণ করতে এবং তাদের আমেরিকান স্বপ্ন অনুসরণে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম। তারপর এলো ট্রাম্পের মুসলিম নিষেধাজ্ঞা।” হঠাৎই তার রুটিন কাজ নৈতিক সংকটে পরিণত হলো। তিনি আর স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করছিলেন না বরং ধর্মের ভিত্তিতে তা অস্বীকার করছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন: “আমার পদত্যাগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল সেই আত্মতুষ্টি ও অহঙ্কারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, যে আত্মতুষ্টি ও অহংকারের মাধ্যমে আমেরিকা মুসলমানদের ‘অন্য কিছু” ভাবে। ” বার্টন বিশ্বাস করেন, একই পরিস্থিতিতে থাকা জুনিয়র কূটনীতিকরা ঘৃণা অনুভব করবেন এবং সম্ভবত প্রতিরোধের চেষ্টা করবেন। কিন্তু তাদের বিরোধিতাও ব্যবস্থাকে বদলাতে পারবে না। সিনিয়র কর্মকর্তারা নতুন কলঙ্ক থেকে নিজেদের দূরে রাখতেই ব্যস্ত থাকবেন। ভারত ও তুরস্কে কর্মরত থাকা বার্টন পদত্যাগ করেন কারণ তিনি বুঝেছিলেন, জাতিগত বৈষম্যমূলক রাজনৈতিক প্রকল্পকে ভেতর থেকে প্রতিরোধ করা শক্তির উৎসের সঙ্গে এক ব্যর্থ সমঝোতা। তার মতো মানুষ আমরা খুব বেশি পাব না। কিন্তু বিষয়টি শুধু ভুল বোঝাবুঝি নয়—এটি এমন একটি নেতিবাচক রাজনৈতিক অহংকার, যা নিজেকে মানবতার ঊর্ধ্বে মনে করে। এর উদাহরণেরও অভাব নেই। চিকলির কল্পিত অতল থেকে ট্রাম্পের অপমানজনক মন্তব্য পর্যন্ত—এই সাংস্কৃতিক শত্রুতা বাস্তব। এটি এক সস্তা কল্পনা, যা পরিচয়কে হুমকির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে এবং এমন কল্পনা মামদানির উত্থানকে ঘিরে বিষাক্ত বক্তব্যকে খাওয়ায়। কিন্তু তার প্রচারণায় যুক্ত ৫০,০০০-এরও বেশি স্বেচ্ছাসেবীর কাছে মামদানির প্রার্থিতা ছিল এর চেয়েও বেশি কিছু। তাদের কাছে তিনি আশার বাতিঘর, যখন আমেরিকায় প্রগতিশীল রাজনীতির দিগন্ত দিন দিন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক—অতলে পড়ছে মুসলমানরা নয়, বরং এসব পশ্চিমা বয়ান, যা বারবার নৈতিক পরীক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। সাদিক খান ও জোহরান মামদানির কারণে বদলাচ্ছে না শহরগুলো বরং বদলে যাচ্ছে সেই আয়নাগুলো, যেগুলো তারা নিজেদের সামনে তুলে ধরছে। -করাম নামা, একজন ব্রিটিশ–ইরাকি লেখক। তিনি বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে An Unlicensed Weapon: Donald Trump, a Media Power Without Responsibility এবং Sick Market: Journalism in the Digital Age।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button