বিদায়ের পালা: আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় ৮২২ বিলিয়ন ডলার

মে মাসের মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়বে পাঁচ হাজার মার্কিন সেনা

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানদের শান্তি চুক্তির প্রশংসা করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পাশাপাশি জানিয়ে দিয়েছেন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে চান তিনি। শান্তি চুক্তি নিয়ে ট্রাম্প বলেন, আমাদের লোকজনকে দেশে ফিরিয়ে আনার সময় হয়েছে। আগামী মে মাসের মধ্যে পাঁচ হাজার মার্কিন সেনা আফগানিস্তান ত্যাগ করবে। এছাড়া অদূর ভবিষ্যতে তালেবান নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শান্তি চুক্তি মেনে চললে আগামী ১৪ মাসের মধ্যে সকল সেনা সদস্যকে আফগানিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানিয়েছে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট। আফগানিস্তান যুদ্ধে প্রায় ২ হাজার ৪শ মার্কিন সেনা নিহত হয়েছেন। দায়িত্ব পালন শেষে প্রায় ১২ হাজার সেনাসদস্য ইতিমধ্যে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেছেন।

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, তালেবানদের উৎখাত করতে ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সরকারের হিসাব বলছে, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দেশটিতে এক লাখ মার্কিন সেনা ছিল, যার কারণে বছরে যুদ্ধের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের লক্ষ্য সরাসরি সামরিক অভিযান থেকে সরিয়ে আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণে বেশি মনোনিবেশ করার পর ব্যয় বেশ কমে আসে।
২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে বার্ষিক ব্যয় নেমে দাঁড়ায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে জানা যায়, এ বছর ব্যয় হয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের হিসাব মতে, ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক ব্যয় হয়েছে ৭৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এর সাথে, মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি এবং অন্য সরকারি সংস্থাগুলোর সাথে মিলে ৪৪ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন ধরণের পুননির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় করেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী সব মিলিয়ে ২০০১ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৮২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হয়েছে।
কিন্তু এতে পাকিস্তানে যে ব্যয় হয়েছে তার হিসাব ধরা হয়নি, যাকে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালানোর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির যুদ্ধ প্রকল্পের ব্যয় বা কষ্ট অব ওয়্যার প্রজেক্ট নামে এক স্বতন্ত্র গবেষণায় দাবি করা হয়, আফগান যুদ্ধে ব্যয়ের যে সরকারি হিসাব দেখানো হয়েছে তা যথেষ্ট কম দেখানো হয়েছে। এতে বলা হয় যে, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের জন্য কংগ্রেস এক ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ তহবিল অনুমোদন করেছে। এই প্রকল্পের সহ-পরিচালক নেটা ক্রফোর্ড বলেন, এই ব্যয়ের মধ্যে যুদ্ধ ফেরত সেনাদের জন্য করা ব্যয়, যুদ্ধ সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের বিভিন্ন বিভাগে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে এবং সংঘর্ষে অর্থায়নের জন্য নেয়া ঋণের সুদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।এসব কিছু যোগ করা হলে ব্যয় অন্তত দুই ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে, তিনি বলেন।

আগামী ১৪ মাসের মধ্যে সকল সেনা সদস্যকে আফগানিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানিয়েছে ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট। আফগানিস্তান যুদ্ধে প্রায় ২ হাজার ৪শ মার্কিন সেনা নিহত হয়েছেন। দায়িত্ব পালন শেষে প্রায় ১২ হাজার সেনাসদস্য ইতিমধ্যে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেছেন।

বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে জঙ্গি বিরোধী অভিযানে এবং মার্কিন সেনাদের জন্য বিভিন্ন ব্যয় যেমন খাদ্য, পোশাক, চিকিৎসা সেবা, বিশেষ ভাতা এবং অন্য সুবিধার যোগান দিতে। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, গত ১৭ বছরে আফগানিস্তানে যে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তার ১৬ শতাংশ বা প্রায় ১৩৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে পুননির্মাণ প্রচেষ্টায়। এবং এর অর্ধেক ব্যয় করা হয়েছে আফগান নিরাপত্তা বাহিনী বাহিনী যেমন আফগান জাতীয় সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর পুনর্গঠনে। বাকি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে মূলত শাসন এবং অবকাঠামো বিনির্মাণ, অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তা এবং মাদক বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণে। ২০০২ সাল থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাদক বিরোধী প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গড়ে দিনে ১.৫ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে। কিন্তু জাতিসংঘের হিসাব বলছে, ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি এলাকা জুড়ে আফিমের পপি চাষ করা হয়েছে।
২০১৭ সালে, পুনর্নির্মাণ প্রকল্প পর্যবেক্ষন করে এমন মার্কিন সংস্থাসমূহ বলছে, গত ১১ বছরে ১৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নষ্ট হয়েছে, “অপচয়, জালিয়াতি এবং অপব্যবহারের কারণে”। তবে এই সংখ্যাটিও অপচয় হওয়া অর্থের “একটি অংশ মাত্র” বলে উল্লেখ করেছে তারা। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ “প্রায় ক্ষেত্রেই সংঘাত বাড়িয়েছে, দুর্নীতির জন্ম দিয়েছে এবং জঙ্গিবাদে সমর্থন জুগিয়েছে।”
২০০১ সালে তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর পর ২৩০০ মার্কিন সেনা নিহত হয়েছে এবং ২০,৬৬০ সেনা আহত হয়েছে। সরকারি হিসাব মতে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর নাগাদ আফগানিস্তানে ছিল প্রায় ১৩ হাজার মার্কিন সেনা। কিন্তু প্রায় ১১ হাজার মার্কিন নাগরিক আফগানিস্তানে থেকে ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেছে। আফগান সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক নাগরিকদের নিহত হওয়ার তুলনায় মার্কিন সেনাদের নিহত হওয়ার সংখ্যা বরাবরই কম ছিল।
প্রেসিডেন্ট ঘানি গত বছর বলেন, ২০১৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৪৫ হাজারের বেশি সদস্য নিহত হয়েছে। নিহতের সংখ্যা প্রকাশ করার মিস্টার ঘানির এই সিদ্ধান্ত কিছুটা অস্বাভাবিক, কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগান সরকার সাধারণত হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করে না। যাই হোক, কিছু সংবাদ মাধ্যম তাদের প্রতিবেদনে বলেছে যে, গত কয়েক বছরে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের নিহত হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। গড়ে প্রতিদিন ৩০-৪০ জন নিহত হয় বলে জানানো হয়। আফগানিস্তানে থাকা জাতিসংঘের সংস্থা ইউনাইটেড নেশন অ্যাসিসটেন্স মিশন ইন আফগানিস্তান বা উনামা বলছে, ২০০৯ সালে তারা হিসাব শুরু করার পর এ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button