‘কপি-পেষ্ট’ করে জ্যামাইকান ব্যক্তিকে হোম অফিসের চিঠি

জ্যামাইকান ব্যক্তির জীবন ‘ইরাকে’ কেন নিরাপদ নয় তা জানতে চান ইমিগ্রেশন অফিসার

এমএফএ জামান: কপি-পেস্টের জনক ল্যারি টেসলার পৃথিবী ত্যাগ করলেও তার অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে হয়তো ব্রিটেনের হোম অফিস একজনের চিঠি আরেকজনকে কপি-পেষ্ট করে পাঠাচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও এটি চরম বাস্তব সত্য। ৪৯ বছর বয়স্ক জ্যামাইকান ব্যক্তি ওনেল ওয়ারফেলের ব্রিটেনে থাকার অনুমতি প্রত্যাখান করা হয়। এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তিনি কেন ইরাকে নিরাপদ নয় তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

ওনেল ওয়ারফেল ২০০২ সাল থেকে ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন। গত ৩ বছর যাবৎ তিনি ৫৬ বছর বয়স্ক ক্যারেন ম্যাককুইনের সাথে একই বাসায় বসবাস করছেন। ক্যারেন বিগত কয়েক বছর যাবৎ ক্যান্সার রোগে ভুগছেন এবং কিডনি পরিবর্তনের অপেক্ষা আছেন। মূলত ক্যারেন এই সংকটময় মুহুর্তে দেখভালের জন্য তার সঙ্গী ওনেল উপর পুরটাই নির্ভরশীল।
কিন্তু হোম অফিস ওনেল ওয়ারফেলের ভিসা আবেদন নাকচ করে বলে, তিনি একজন ইরাকী নাগরিক এবং তার সাথে ক্যারেন ম্যাককুইনের সম্পর্কটি ভূয়া। এই ব্যাপারে ওনেল ওয়ারফেলের ইমিগ্রেশন সলিসিটর নাগা কান্দিয়াহ তার মন্তব্যে গার্ডিয়ানকে বলেন, হোম অফিসের এই আচরণ আমাকে সত্যিই শংকিত করে তুলেছে। তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার মক্কেল ওনেলের আবেদনটি খারিজ করছে। তবে এই ভিসা আবেদনটি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে যেন কেচোঁ খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা হয়েছে।
হোম অফিস তাদের পত্রে ওনেলকে বলেছে, তুমি দাবী করেছো ইরাকে তোমার জীবন হুমকির সম্মুখীন। তোমাকে মেরে ফেলা হতে পারে কিন্তু এ বিষয়ে কোন ধরণের প্রমাণ তুমি দিতে ব্যর্থ হয়েছো। এছাড়া ক্যারেন ম্যাককুইনের সাথে তোমার সম্পর্ককে আমরা ভূয়া মনে করছি কারণ ক্যারেনের সাথে তুমি একই বাসায় থাকলেও, বাসা ভাড়ার চুক্তিতে তোমার নাম উল্লেখ নেই। তাই তোমার আবেদন আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়।

‘‘হোম অফিসের এধরণের ভুল কখনোই গ্রহণযোগ্য নয় যে, আমাকে বলবে আমি একজন ইরাকী নাগরিক। আমার ভিসার আবেদনটি তারা হয়তো ভালো করে দেখেই নি বরং একজন ইরাকী ব্যক্তির চিঠি কপি-পেষ্ট করে আর আমার নাম লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে।’’

সলিসিটর নাগা কান্দিয়াহ বলেন, ওনেলের আবেদন নাকচ করে ৩ অক্টোবর ২০১৯, কিন্তু হোম অফিস এই চিঠি ২২ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে রেকর্ড ডেলিভারী করে পাঠায়। এরই মধ্যে তার ১৪ দিনের আপিলের সময় শেষ হয়ে যায়। এর ফলে তিনি তার আইনী অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এছাড়া ওনেলকে ইরাকে ফেরত যাবার জন্য বলা হয়েছে কিন্তু তিনি কখনো ঐ দেশে যাননি। এর মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয় যে, হোম অফিসের কর্মকর্তা কোনো একজন ইরাকী ব্যক্তির চিঠি থেকে কপি-পেষ্ট করে শুধু নামটি পরিবর্তন করে তার মক্কেলকে এই চিঠি পাঠিয়েছে। তবে হোম অফিস প্রতিনিয়ত লোকদের সাথে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আবেদনকারীর জীবনের ঝুকিঁকে উপেক্ষা করছে। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের এই আচরণ একজন মানুষের জীবনকে ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। হোম অফিসের ভিসা শাখার অদক্ষ কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়না। তাই তাদের অভিবাসন আইন সম্পর্কে কোন হিতাহিত জ্ঞান নেই; আর এটি শুধু একজন মানুষের জীবনকে শেষ করে দিচ্ছেই না বরং এতে জনগণের টেক্সের টাকার অপচয় আর আইনজীবিদের মূল্যবান সময় নষ্ট করা হচ্ছে।
গার্ডিয়ান পত্রিকা ওনেল ওয়ারফেলের ভিসা নাকচের কারণ যেমন হোম অফিস কি উদ্দেশ্যমূলকভাবে চিঠি যথাসময়ে পাঠায়নি, কেন ইরাকের বিষয়টি আসলো, কেন ক্যারেনের সাথে তার সম্পর্ককে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি ইত্যাদি বিষয়গুলো বিস্তারিত জানার জন্য হোম অফিসের সাথে যোগাযোগ করলেও আজ অবধি (গার্ডিয়ানের রিপোর্ট সময় পর্যন্ত) এর কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

এই অবিচারের শিকার ওনেল ওয়ারফেল তার ক্ষোভ প্রকাশ করে গার্ডিয়ানকে বলেন, হোম অফিসের এধরণের ভুল কখনোই গ্রহণযোগ্য নয় যে, আমাকে বলবে আমি একজন ইরাকী নাগরিক। আমার ভিসার আবেদনটি তারা হয়তো ভালো করে দেখেই নি বরং একজন ইরাকী ব্যক্তির চিঠি কপি-পেষ্ট করে আর আমার নাম লিখে পাঠিয়ে দিয়েছে। তদুপরি আমার সাথে ক্যারেন ম্যাককুইনের সম্পর্ককে তারা ভূয়া হিসেবে উপস্থাপন করেছে। আমাকে মাসের পর মাস ডিটেনশন সেন্টারে বন্দী রাখা হয়েছিলো। সেখানে বন্দী থাকায় আমার মা‘র মৃত্যুর সময় আমি তার পাশে থাকতে পারি নি। পরে ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে নিয়ে যায়।
কিন্তু আমি বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছি কারণ আমার সাথে ক্যারেনের সম্পর্ককে হোম অফিস ভূয়া বলে দাবী করেছে। আমি খুবই খুশি হবো যদি হোম অফিসের কর্মকর্তারা দু‘সপ্তাহের জন্য আমার আর ক্যারেনের সাথে বসবাস করেন। কারণ তারা সরাসরি দেখতে পারবেন আমরা দু‘জন কিভাবে রান্না করি, চলাফেরা করি, একসাথে ঘুমাই। আমি একজন সৎ মানুষ যে একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু হোম অফিসের কর্মকর্তাদের কপি-পেষ্টের অবিচার আমার সব স্বপ্নকে ধুলিষ্যাৎ করে দিয়েছে।
ওনেল ওয়ারফেলের সঙ্গী ক্যারেন ম্যাককুইন বলেন, একজন বৃটিশ নাগরিক হিসেবে হোম অফিসের এই সিদ্ধান্তে আমি সত্যিই ক্ষুব্ধ। আমার সঙ্গী ওনেল একজন সত্যিকারের ভালো মনের মানুষ যে সবসময় অন্যের ভালো চায়, অপরের উপকার করে। আমি একজন ক্যান্সারের রোগী কিন্তু তার যত্ন এবং ভালোবাসা আমাকে আবার নতুন করে বাচাঁর স্বপ্ন জাগিয়েছে। দীর্ঘদিন তার ভিসা জটিলতার বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে গিয়ে আমরা মানষিক এবং শারিরীকভাবে ভেঙে পড়েছি। আর এটি বুঝতে পারলাম যে শুধু ওনেল নয়, একজন বৃটিশ নাগরিক হিসেবে আমার জীবনটাও ইমিগ্রেশনের নিয়মের গ্যাড়াকলে আজ নিষ্পেষিত এবং নিয়ন্ত্রিত।
উল্লেখ্য, ওনেল ওয়ারফেলের মতো অনেক ব্যক্তি এবং পরিবার প্রতিনিয়ত হোম অফিসের অদক্ষ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের দ্বারা আইনের অপব্যবহারের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু ভোক্তভোগীরা তাদের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না এই ভয়ে যে, যদি আবার নতুন কোন আইনী গ্যাড়াকলে পড়তে হয়। ভিসার আবেদন একবার নাকচ করলে তাদের অনেকেরই পুনরায় আবেদনের খরচটুকু দেবার সামর্থ্য নেই। গার্ডিয়ান পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রায়ই হোম অফিস ইচ্ছাকৃতভাবে ভিসার আবেদন নাকচ করে কারণ ঐ ব্যক্তি কিংবা পরিবার পুনরায় আবেদন করলে নতুন করে আবেদনের ফি জমা দিতে হবে। আর এই খাত থেকে হোম অফিসের লাভের পরিমাণ প্রায় ৮০০%।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button