প্রথম শরণার্থী পাইলট হওয়ার পথে মায়া গজল

২০১১ সালের মার্চে যখন আমার বয়স ১১, তখন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ অনুষ্ঠানের পর সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা সরকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে দেশ। ২০১৩ সালের দিকে হেঁটে স্কুলে যাওয়া আর নিরাপদ ছিলো না, বোমা বর্ষণের শিকার হওয়ার ভয়ে। যুদ্ধ এড়ানোর জন্য আমি তিনবার স্কুল পরিবর্তন করি। কিছুদিন আমি মোটেই স্কুলে যাইনি যখন আমরা বিস্ফোরণ ও হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

সেটা ছিলো ভীতিকর এবং আমি সর্বাদ বন্ধুবান্ধবদের ও পরিবারকে বিদায় জানাতম, হয়তো সেটাই শেষ দেখা হতে পারে বলে। আমার পিতার কাপড়ের ব্যবসা আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি তুরস্কে কাজ করতে যান। এরপর যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানে ২০১৪ সালে তার আশ্রয় মঞ্জুর করা হয়।
আমরা ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত আমার পিতাকে অত্যন্ত মিস করি। পরে আমার মা, ভাইদের ও আমাকে ভিসা দেয়া হলে, আমরা তার কাছে চলে যাই। আমরা আমাদের ব্যাগগুলো গুছিয়ে নেই এবং ভগ্নহৃদয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। জানাশোনা ভালোবাসার মানুষজনকে বিদায় জানাই এজন্য যে, হয়তো তাদের সাথে আর কখনো দেখা না-ও হতে পারে।
২০১৫ সালের ১৭ মার্চ আমার চাচা আমাদেরকে গাড়ি চালিয়ে বৈরুতে নিয়ে যান। এরপর আমরা বিমানে তুরস্ক যাই। সেখান থেকে বার্মিংহামের উদ্দেশে অন্য একটি বিমানে আরোহণ করি।

২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর, আমার মা ও আমি সপ্তাহান্তে লন্ডনে বেড়াতে যাই। হিথ্রোর নিকটে একটি হোটেলে অবস্থান করি, যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা বিমানের ওঠা-নামা দেখি। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, একদিন আমি নিজে বিমান চালাবো।

যুক্তরাজ্যে আসার দীর্ঘ একটি বছর পর আমার পিতাকে দেখতে পেয়ে আমার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। যখন আমরা বার্মিংহামে আমাদের ফ্লাটে এসে ওঠি, সেটা হ্যারি পটারের মতো ফিল্মে দেখা ইংল্যান্ডের মতো ছিলো না।
মায়া বলেন, ২০১৫ সালে ব্রিটেনে আসার পর প্রথম তিনি নিজেকে নিঃসঙ্গ এবং বিভ্রান্তিকর অনুভব করেন। কিন্তু এখন তিনি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন।
মায়া বলেন, আমি অত্যন্ত ধূসর ও বিভ্রান্ত অনুভব করি। আমার প্রথম দিনটি ছিলো ভীতিকর। আমাকে স্কুলে বেসিক ইংলিশ শিখতে হচ্ছিলো কিন্তু বার্মিংহামের উচ্চারণ বুঝতে পারছিলাম না। আমার মাথা ঝিমঝিম করছিলো।
এক সপ্তাহ পর আমি সিক্স-ফরমের জন্য আবেদন করতে শুরু করি। কিন্তু ভালো গ্রেডলাভ সত্বেও তারা আমার সিরীয় মাধ্যমিক শিক্ষার সার্টিফিকেটসমূহের স্বীকৃতি না দেওয়ায় আমি তিনবার প্রত্যাখ্যাত হই।
যখন আমি স্কুলে আবেদনের জন্য বাড়িতে অবস্থান করছিলাম, তখন নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকি। তাই আমার চাচা, তিনিও যুক্তরাজ্যে চলে আসেন, আমাকে ‘দ্য চিলড্রেনস সোসাইটি’র স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার পরামর্শ দেন, যারা ব্রিটেনে অরক্ষিত তরুণদের সাথে কাজ করছে।

আমি অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থিত হতে শুরু করি এবং একজন শরণার্থী হিসেবে লোকের প্রশ্নের জবাব প্রদান করি। ব্রিটিশ লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলতে ভালো লাগে, তারা আমার কাহিনী শুনতে অত্যন্ত আগ্রহ দেখায়।
শেষ পর্যন্ত আমি ২ বছরের একটি বিটেক ইঞ্জিনীয়ারিং ন্যাশনাল ডিপ্লোমায় গৃহীত হই এবং সেপ্টেম্বর মাসে আমার প্রথম দিবসে আমি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে আমার সঙ্গীদের সাথে কথাবার্তা বলি, অধিকাংশই গ্রহণযোগ্য হয় এবং এতে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।
২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর, আমার মা ও আমি সপ্তাহান্তে লন্ডনে বেড়াতে যাই। হিথ্রোর নিকটে একটি হোটেলে অবস্থান করি, যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা বিমানের ওঠা-নামা দেখি। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে, একদিন আমি নিজে বিমান চালাবো।
আমি দ্য চিলড্রেনস সোসাইটিতে আমার কর্মকান্ড চালিয়ে যাই এবং ২০১৭ সালের মে মাসে আমাকে সেন্ট জেমসেজ প্যালেসে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যেখানে প্রিন্স হ্যারি ও প্রিন্স উইলিয়াম আমাকে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের জন্য ‘দ্য ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করেন। তারা তরুণ শরণার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন।

তখন থেকে আমি ৩৫ ঘন্টা বিমান চালিয়েছি কিন্তু একজন বাণিজ্যিক পাইলট হতে হলে আমাকে হাজার ঘন্টা উড়তে হবে এবং এটা এতো ব্যয়বহুল যে আমি স্কলারশীপ খুঁজতে শুরু করি। একদিন আমি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমান চালাতে চাই।

ঐ গ্রীষ্মকালে আমার বিটেক-এ আমাকে একটি ডিসটিংশন দেয়া হয় এবং পাইলট বিষয়ে পড়াশোনাসহ বিমান চলাচল প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনার জন্য লন্ডনের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটিতে গ্রহন করা হয়। এতে আমার পিতামাতা রোমাঞ্চ বোধ করেন এবং ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে যখন আমি শুরু করি, তখন আমার ইংলিশ এতোটা ভালো ছিলো যে, আমি সহজেই বন্ধুবান্ধব পেয়ে যাই।
পরের বছর জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশন আমাকে একটি টেডক্স আলোচনায় আমন্ত্রণ জানায় ‘শরণার্থীদের জন্য খাদ্যের মতোই শিক্ষা এতো গুরুত্বপূর্ণ কেনো’-এ বিষয়ে বক্তব্য রাখার জন্য। প্রায় ৯শ’ লোক দাঁড়িয়ে আমাকে অভিনন্দন জানায়। আমি জানতাম একজন ভীত সন্ত্রস্ত বালিকা হিসেবে যুক্তরাজ্যে আগমনের সময় থেকে দীর্ঘপথ আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি আমার প্রথম ওড়ার শিক্ষা গ্রহণ করি। নভেম্বর মাসে প্রথম বারের মতো আমি হালকা উড়ার কাজ করি। সেটা ছিলো জগতের সেরা অনুভূতি।
তখন থেকে আমি ৩৫ ঘন্টা বিমান চালিয়েছি কিন্তু একজন বাণিজ্যিক পাইলট হতে হলে আমাকে হাজার ঘন্টা উড়তে হবে এবং এটা এতো ব্যয়বহুল যে আমি স্কলারশীপ খুঁজতে শুরু করি। একদিন আমি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমান চালাতে চাই।
আজ ব্রিটেন আমার বাড়ি এবং আমি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করবো। এটা লোকজনের ঐসব ধারনাকে চ্যালেঞ্জ করার একটি সুযোগ-আমি একজন নারী, একজন মুসলিম এবং একজন শরণার্থী। কিন্তু একদিন আমি বলতে চাই, আমি বিশ্বের প্রথম সিরীয় শরণার্থী পাইলট। -দ্য সান ডট কো ডট ইউকে

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button