ইসলামী বিয়ে ইংলিশ আইনে বৈধ নয় বলে ব্রিটিশ আপীল আদালতের রায়

ব্রিটিশ আপীল আদালত এই মর্মে নির্দেশনা জারি করেছে যে, ইংলিশ আইনের অধীনে মুসলিম বিবাহ বৈধ নয়। এটা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আসা হাজার হাজার নারীর প্রতি আঘাত। গত শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারী) আদালত কর্তৃক প্রদত্ত এই রায়ে নিকাহ নামে পরিচিত একটি ইসলামী বিবাহ ইংলিশ মেট্রোমোনিয়েল ল’ অর্থাৎ ইংলিশ মাতৃবিষয়ক আইনের আওতায় রয়েছে বলে হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনাকে বাতিল করা হয়েছে। আপীল আদালত নিশ্চিত করেছে যে, নিকাহ বিয়েসমূহ আইনত: ‘কোন বিয়েই নয়’। কারণ যদি বিয়ে ভেঙ্গে যায় তবে এতে স্বামী বা স্ত্রী পারিবারিক বাড়ি এবং স্বামী বা স্ত্রীর পেনশেনের মতো মেট্রমোনিয়েল সম্পদের বন্টনের জন্য আদালত সমূহের প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই।

অনেক দম্পতি আছেন যারা নিকাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আইনত: বিবাহিত বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু তাদের বিবাহ শুধুমাত্র তখনই আইনত: বৈধ হবে যদি তারা একটি অতিরিক্ত সিভিল সিরিমনির অর্থাৎ সামাজিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন। ২০১৭ সালে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে বিবাহিত প্রায় সকল মুসলিম নারী নিকাহ করেছেন এবং এর প্রায় দুই তৃতীয়াংশই একটি আলাদা সিভিল সিরিমনি পালন করেননি।

আপীল আদালতের রায়ের জবাবে ফ্যামিলি ল’ ফার্ম ফোরপিবি’র চার্লস হেইল কিউসি বলেন, এর মানে হচ্ছে অনেকের তাদের ‘বিবাহের’ ব্যাপারে তারা যা বিশ্বাস করেন এক্ষেত্রে তাদের মোটেই কোন অধিকার নেই। স্বামীর একক নামের সম্পদে কোন অধিকার নেই এবং ভরনপোষণের ব্যাপারে কোন অধিকার নেই।

তিনি আরো বলেন, আপীল আদালত একটি আইনানুগ বিবাহ গঠনকারী বিদ্যমান ধারণাকে স্থগিত করেছে …….. এসব ঘটনার ক্ষেত্রে আইনটি সমাজের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। এসব অরক্ষিত মহিলাদের বর্তমান আইনে প্রদত্ত সুরক্ষার চেয়ে ভালো সুরক্ষা প্রয়োজন।

২০১৮ সালের হাইকোর্টের মামলায় সংশ্লিষ্ট দম্পতি নাসরীণ আক্তার ও মোহাম্মদ শাহবাজ খান ১৯৯৮ সালে পশ্চিম লন্ডনের সাউথহলের একটি রেস্তোরাঁয় ১৫০ জন অতিথির উপস্থিতিতে একজন ইমাম কর্তৃক পরিচালিত নিকাহ বিবাহে আবদ্ধ হন। পরে সম্পর্কটি ভেঙ্গে যায় এবং নাসরিন আক্তার বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু মোহাম্মদ শাহবাজ খান মামলায় এই যুক্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন যে, তারা ইংলিশ আইনের অধীনে বিবাহিত নন, তারা শুধুমাত্র শরিয়া বা ইসলামী আইনে বিবাহিত।

আক্তার বলেন, তিনি খানকে তার স্বামী হিসেবেই গ্রহণ করেন এবং খানও ‘সব সময় তাকে তার স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়’। হাইকোর্ট দম্পত্তির বক্তব্য শ্রবণ করেন, যারা একটি সিভিল সিরিমনি অর্থাৎ সামাজিক বিবাহ অনুসরণ করেন নি। তাই সামাজিক বিবাহ নয় এমন কিছু আইনানুগভাবে শেষ হতে পারে না, কারণ এক্ষেত্রে কখনো বিবাহ সম্পন্ন হয়নি। হাইকোর্ট এই মর্মে রুল প্রদান করেন যে, আক্তার ও খানের বিয়েটি বিবাহ গঠনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট আবশ্যকীয়তার প্রতি অবজ্ঞার মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। তাই এটা একটি বাতিল বিবাহ এবং স্ত্রী একটি বাতিলের ডিক্রি পাবার অধিকারী।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এটর্নী জেনারেল আপীল করেন। তিন পারিবারিক বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত আপীল আদালত শেষ পর্যন্ত হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার সিদ্ধান্তে উপনীত হন এই বলে যে, তারা সিভিল সিরিমনিসহ নিকাহ অনুষ্ঠান পালনে ইচ্ছুক ছিলো। কিন্তু নাসরীন আক্তারের উপর্যুপরি বুঝানোর প্রচেষ্টা সত্বেও শাহবাজ খান একটি আইননানুগ পন্থা অবলম্বন প্রত্যাখ্যান করেন। বিচারপতি মি: উইলিয়াম, যিনি লন্ডনের হাইকোর্টের পারিবারিক বিভাগে মামলাটির শুনানী গ্রহন করেন, এই বলে উপসংহারে উপনীত হন যে বিবাহটি ১৯৭৩ সালের ম্যাট্রিমোনিয়েল কজেস অ্যাক্ট-এর আওতায় পড়েছে।

এই আইনের অধীনে তিন শ্রেনীর বিবাহ রয়েছে: বৈধ, অবৈধ এবং বিবাহ-নয়। বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি লাভের মাধ্যমে বৈধ বিবাহের পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে। বাতিল বা অবৈধ বিবাহ বাতিলের ডিক্রি নিয়ে শেষ হতে পারে। আর রায়টি বহাল রাখতে গেলে বিবাহ নিবন্ধনের পদ্ধতিটির মান মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে, যার ওপর একটি আধুনিক সমাজ বিপুলভাবে নির্ভর করে। তারা আরো বলেন, যারা এই স্ট্যাটাস লাভের জন্য আইনানুগভাবে বিবাহিত হতে চান, সেই সব পক্ষের জন্য এটা মুশকিলের কিছু নয়। রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রের ধর্মীয় বিবাহের স্বীকৃতি প্রদানের কোন মানবাধিকার নেই।

বিএলএম আইন প্রতিষ্ঠানের ড্যানিয়ের জোন্স বলেন, আপীল আদালতের রায় সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য ‘একটি প্রকৃত আঘাত’।
তিনি বলেন ‘এই সিদ্ধান্তের ফলে যুক্তরাজ্যের মুসলিম নারীদের আইনী দীর্ঘসূত্রিতায় ফেলে দেবে, তাদেরকে বাধ্য করবে ইসলামী বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য শরিয়া কাউন্সিলসমূহ অবলম্বনে। এতে প্রায়ই বিলম্ব ঘটে এবং যদি তাদের বিবাহটি ব্রিটিশ আইনে হয়েছে বলে স্বীকৃত হয় তবে নারীরা একই ধরনের আর্থিক সুরক্ষা পাবার অধিকারী হয় না।
তিনি বলেন, বিষয়টি যুক্তরাজ্যব্যাপী মুসলিম নারীদের জন্য মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ন। অসুখী সম্পর্ক সমূহে মুসলিম নারীদের বড়ো ধরনেরা আর্থিক ঝুঁকিতে ফেলে।

উইন্ডওয়ার্থ শেরউড আইনের প্রতিষ্ঠানের জনৈক সিনিয়র এসোসিয়েট আন্নালোরা লক বলেন, বর্তমান বিবাহ আইন পক্ষসমূহের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে ছেড়ে দেয়, যা সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবার পর এতোটা আর্থিক ভাবে প্রকাশিত হয়, এই ইস্যুর জন্য এটা শেষ নয়। আইনের পরিবর্তনের দাবি দীর্ঘদিনের এবং এটা অবশ্যই অধিক্ষেত্রের মধ্যে হবে।
তিনি আরো বলেন, বিবাহ সংক্রান্ত আইন এখন আর একটি আধুনিক বহু-সাংস্কৃতিক ও কম ধর্মীয় সমাজের উদ্দেশ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।

নিকাহ বিবাহের ইস্যু নিয়ে প্রচারাভিযান পরিচালনাকারী সাউথহল ব্লাক সিস্টার্স এর প্রাগনা প্যাটেল বলেন, আজকের রায় মুসলিম ও অন্যান্য নারীদের শরিয়াহ ‘আদালতের’ দিকে ধাবিত করবে, যা ইতোমধ্যে নারী ও শিশুদের প্রতিকারের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষতির কারণ হয়েছে, কারণ তারা এখন সিভিল জাস্টিস সিস্টেমের মধ্যে আবদ্ধ নয়। এক্ষেত্রে পারিবারিক বিষয়ে জবাবদিহিতাহীন এবং ধর্মীয় কমিউনিটিভিত্তিক পদ্ধতি কর্তৃক মৌলবাদ অনুপ্রাণিত বিচারের ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটা শুধু প্রায় ধর্মীয় বিবাহসমূহের স্বীকৃতি সংক্রান্তই নয় বরং এটা সকলের প্রতি আইনে সমানাধিকারের রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তা সংক্রান্ত।

২০১৮ সালে শরিয়াহ কাউন্সিলসমূহের একটি স্বাধীন পর্যালোচনায় এই মর্মে সুপারিশ করা হয় যে, মুসলিম দম্পতিদের উচিত একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সাথে সাথে একটি সিভিল বিবাহের নিয়ম অনুসরণ করা, যাতে এটা আইনের অধীনে নারীদের সুরক্ষা প্রদান করে।

২০১৬ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেরেসা মে কর্তৃক উদ্বুদ্ধ এই পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বিপুল সংখ্যক মুসলিম নারী সিভিল আইনে তাদের বিবাহ নিবন্ধন করেননি এবং অনেক মুসলিম নারীর কোন সিভিল বিবাহ বিচ্ছেদ লাভের উপায় নেই।
ব্রিটেনের মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট রাঘাত আলতিকরিতি বলেন, যুক্তরাজ্যে অনেক ইসলামিক সেন্টার নিকাহ বিবাহে সিভিল রেজিষ্ট্রেশনকে একটি শর্ত হিসাবে গ্রহণ করেছে। আপীল আদালতের রায় এটা নিশ্চিতে আলোচনা অব্যাহত রাখার একটি সুযোগ দিয়েছে যে, একটি নিবিড় পদ্ধতির দ্বারা প্রত্যেকের অধিকার সুরক্ষিত হোক, যা সকলের প্রয়োজনীয়তার সাথে সম্পর্কিত।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button