নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি বরিসের

মিলন বিরহে ব্রেক্সিট কার্যকর: ৪৭ বছরের সম্পর্কের ইতি

ব্রিটিশ রাজনীতিতে ঝড় তোলা বহুল আলোচিত ব্রেক্সিট অবশেষে কার্যকর হলো শুক্রবার গ্রিনিচ মিন টাইম রাত ১১টায়। ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ায় একদিকে ছিল উল্লাস। একদিকে ছিল বেদনা। অনেকটা কত আনন্দ বেদনায় মিলন বিরহ সঙ্কটে। ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর ব্রিটিশ অনেক সদস্যকে উল্লাস করতে দেখা গেছে। আবার অনেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার বেদনায় কেঁদেছেন। কান্নাভেজা আলিঙ্গনে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছেন। ব্রেক্সিট সম্পন্ন হলেও ১৯৭৩ সালে যোগ দেয়া ব্রিটেনের প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভালবাসা অব্যাহত থাকবে বলে প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বিচ্ছেদের ঘণ্টা খানেক আগে টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি ব্রেক্সিটকে ‘শেষ নয় বরং শুরু’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি তার বক্তব্যে ব্রেক্সিটকে ‘সত্যিকারের জাতীয় নবায়ন ও পরিবর্তনের মুহূর্ত’ হিসেবে তুলে ধরেন। লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন ব্রেক্সিটের প্রাক্কালে দেয়া এক বিবৃতিতে ইউরোপীয় জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাজ্য যেন ‘অন্তর্মুখী’ না হয়ে ‘সত্যিকারের আন্তর্জাতিকতাবাদী, বৈচিত্র্যময় এবং বহির্মুখী’ দেশে পরিণত হয় তা নিশ্চিত করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ইইউ জোটকে ‘আবেগঘন বিদায়’ জানাতে শুক্রবার বিকাল ৩টায় হোয়াইটহলের সামনে ব্রেক্সিটবিরোধীরা কর্মসূচি পালন করেন। পরে ব্রেক্সিটপন্থীরা পার্লামেন্ট চত্বরে একত্রিত হয়ে ‘বন্ধনমুক্তি’ উদযাপন করেন। ডাউনিং স্ট্রিটের একটি ঘড়িতে চলে বিচ্ছেদের ক্ষণগণনা। হোয়াইটহলের আশপাশের ভবনগুলোতে ছিল আলোকসজ্জা। পার্লামেন্ট চত্বরের প্রতিটি খাম্বায় উড়ে ইউনিয়ন জ্যাক। যুক্তরাজ্যের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়াকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রকাশ করা হয় ৫০ পয়সার স্মারক কয়েন।

গত বুধবার রাতে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে শেষ অধিবেশন বসে। সেখানে ব্রিটেনের ব্রেক্সিট চুক্তিকে ভূমিধস সমর্থন দিয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। কেউ কেউ আশা প্রকাশ করেছেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে নতুন করে যুক্ত করার স্বপ্নকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই পার্লামেন্টে এমন অবিমিশ্র অবস্থা আগে কখনো দেখা গিয়েছে কিনা তা জানা নেই। এর আগে ব্রাসেলসে অবস্থিত এই পার্লামেন্টে চুক্তিটি নিয়ে আবেগঘন বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর অনুষ্ঠিত হয় ভোট। এরপর ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্যরা আউলড ল্যাং সাইনি’তে স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে ব্রিটেনের প্রস্তাব অনুমোদন করে।

এই পার্লামেন্টের বেশ কিছু ব্রিটিশ সদস্য বলেছেন, তারা আশাবাদী ছিলেন একদিন ব্রিটেন ফিরে আসবে। এর মধ্যে রয়েছেন ব্রেক্সিট পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজে। ইউরোপিয় ইউনিয়নে দেয়া তার শেষ বক্তব্যে নাইজেল ফারাজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অক্টোবরে উইড্র চুক্তি অনুমোদন ও তাতে সম্মত হয় ব্রিটেন ও ইউরোপিয় ইউনিয়ন। এতে স্বাক্ষর করেন পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট ডেভিড সাসোলি। এরপর তিনি বলেন, ভবিষ্যত সম্পর্কের বিষয়ে প্রয়াত লেবার দলের এমপি জো কক্সের কথাগুলো স্মরণ করা উচিত উভয় পক্ষের। তা হলো, আমাদেরকে বিভক্ত করার চেয়ে অনেক কিছু আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে দেয়।

আবেগ জড়ানো কণ্ঠে তিনি ব্রিটেনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা ইউরোপিয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সব সময়ই আপনারা ইউরোপের অংশ হয়ে থাকবেন। আপনাদেরকে বিদায় কথাটা বলা খুব কষ্টের। তাই আমার অন্য সহকর্মীদের মতো আমি বিদায় না বলে বলতে চাই আবার দেখা না হওয়া পর্যন্ত বিদায়। এটা বুঝাতে তিনি ইংরেজিতে একটি শব্দ ব্যবহার করেন। তা হলো- অ্যারাইভেডেরসি। বুধবারের এই অধিবেশনে ব্রেক্সিট বিতর্কে দুই পক্ষকে দেখা গেছে দুইদিকে। ব্রিটেনের ৭৩ জন সদস্য ছিলেন এই পার্লামেন্টে। ইউরোপিয় ইউনিয়নে ব্রিটেনের সদস্যপদের ইতি ঘটেছে- এতে একপক্ষ উল্লাস করেছেন। অন্য একপক্ষ বিলাপ করেছেন। কিছু এমপি এই সময়টাকে গান গেয়ে, কেউ সর্বদা আমরা ঐকবদ্ধ থাকবো লেখা স্কার্ফ পরে চিহ্নিত করে রাখেন।

ইউরোপিয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট বিষয়ক মুখপাত্র গাই ভারহোফস্টাডট বেদনাভরা বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন, যে দেশ ইউরোপকে স্বাধীন করতে দু’বার রক্ত দিয়েছে তারা এই ইউরোপ ছেড়ে যাচ্ছে এটা আমাদের কাছে বেদনার। তিনি আরো বলেন, পার্লামেন্টে ব্রিটিশ এমপিরা একগুঁয়েমি সত্তেও বুদ্ধিমত্তা এনেছিলেন। তাদেরকে মিস করবে এই পার্লামেন্ট। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেনের মধ্যে সৃষ্টি হবে নতুন এক অংশীদারিত্ব। তাদের ব্রেক্সিট বিষয়ক চুক্তি অনুমোদন দেয়া হলো তারই প্রথম পদক্ষেপ। ব্রিটেন ইউরোপিয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাচ্ছে। এরপর তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, আবহাওয়া পরিবর্তনের মতো ইস্যুতে যৌথ শক্তি হিসেবে কাজ করবে উভয় পক্ষ।

ব্রিটেনকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনাদেরকে সব সময়ই আমরা ভালবাসবো। আপনাদের কাছ থেকে আমরা দূরে সরে যাবো না। ব্রিটেনের জন্য শুভ কামনা করেন ইউরোপিয় ইউনিয়নের ব্রেক্সিট বিষয়ক মধ্যস্থতাকারী মিশেল বার্নিয়ার। আবেগী হয়ে পড়েন নাইজেল ফারাজে ও তার ব্রেক্সিট পার্টির সদস্যরা। তারা পার্লামেন্ট থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে ইউরোপিয় ইউনিয়নের পতাকা দোলাতে থাকেন। কান্না বিজড়িত মলি স্কট ক্যাটোকে তার সহকর্মীরা জড়িয়ে ধরেন। এ সময় তিনি ব্রেক্সিট নিয়ে ক্ষোভ ও বেদনা প্রকাশ করেন। আশা প্রকাশ করেন, কোনো একদিন তিনি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে ফিরে যেতে পারবেন।

গ্রিন পার্টির এই সদস্য বলেন, এখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে নতুন করে যোগ দেয়ার মতো সময় নয়। তবে এই স্বপ্নকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ব্রিটেনের সিদ্ধান্ত থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন এই পার্লামেন্টে বেলজিয়ামের সদস্য ফিলিপ্পি ল্যাম্বার্ট।

উল্লেখ্য, ৪০ বছরের বেশি সময় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে থাকার পর ২০১৬ সালের ২৩শে জুন গণভোটের আয়োজন করেছিল যুক্তরাজ্য। এতে সেদেশের নাগরিকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল – যুক্তরাজ্যের কি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে থাকা উচিত নাকি উচিত না? ৫২ শতাংশ ভোট পড়েছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে, আর থাকার পক্ষে ছিল বাকি ৪৮ শতাংশ ভোট। তারপর বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে সাড়ে তিন বছর ইইউ-ইউকে বিচ্ছেদ কার্যকর হলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ জোটের সূচনা হয়েছিল। ধীরে ধীরে তা বিশ্বের বৃহত্তম আঞ্চলিক জোট হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইইউ জোটভুক্ত ২৮টি দেশের বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, অভিবাসনসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক কিছুই ইইউর একক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিচালিত হয়। ১৯৭৩ সালে জোটে যোগ দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। এই প্রথম কোনো দেশ ইইউ ছেড়ে চলে গেল। যা পরিচয় পেয়েছে ব্রেক্সিট হিসেবে। জোটের অনেকে দিনটিকে দুঃখের দিন হিসেবে দেখছেন। আজকের পর থেকে ইইউ ২৮ নয় বরং ২৭ দেশের জোটে পরিণত হলো।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button