হ্যালো ব্রিটেন, এখন কি তুমি খুশি?

আমাকে জবাব দিতে দাও, বিশ্ব তোমাকে অভিযুক্ত করেছে আশি বছরের কষ্ট, উচ্ছেদ, নির্বাসন, ও মৃত্যুর জন্য। তুমি এমন এক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিলে যা প্রজন্মের পর প্রজন্মে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। গাজা, জেনিন, দেইর ইয়াসিন —এগুলো আলাদা আলাদা নৃশংসতা নয়, বরং এক শতাব্দীর বিপর্যয়ের ধাপ, যা হোয়াইটহল–এর দালানকক্ষে পরিকল্পিত হয়েছিল।
তুমি সেই আগুন জ্বেলে দিলে যা ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করল, আর এখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণে পিছু হটছো, যেন তুমি কখনোই অগ্নিসংযোগ করোনি। কিন্তু ইতিহাস ভুলে না, ইতিহাস বিচার করে।
ব্যালফোর ঘোষণা-ঋণের নোটে লেখা প্রতারণা:
অনেকে জানে না তোমার প্রতিশ্রুতির পেছনের কপট উৎপত্তি। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন তোমার রাজকোষ প্রায় শূন্য, তুমি আমেরিকান ঋণের জন্য ইহুদি প্রভাবের দিকে তাকালে। তোমার প্রয়োজন ছিল ওয়াশিংটনের ব্যাংকারদের,
তাদের সমর্থনের বিনিময়ে তুমি দিলে এক প্রতিশ্রুতি— এক বিদেশি ভূমিতে ইহুদিদের জন্য একটি “স্বদেশ”। এটা এমন একটি চেক, যা তুমি অন্যের অ্যাকাউন্ট থেকে তুলেছিলে।
ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ আভি শ্লাইম একে বলেছেন,“ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অন্যতম প্রতারণামূলক দলিল।” তুমি শান্তি চাওনি।তুমি চেয়েছিলে মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত ঘাঁটি, যখন অটোমান সাম্রাজ্য পতনের পথে। ব্যালফোর ঘোষণা কোনো উদারতা ছিল না —এটি ছিল একটি ঘুষ, বাইবেলের ভাষায় মোড়ানো এক চুক্তি।
তুমি ফিলিস্তিনকে লীগ অব নেশন্স ম্যান্ডেটের অধীনে দখল করেছিলে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে, “বাসিন্দাদের স্বশাসনের জন্য প্রস্তুত করা হবে।”কিন্তু বাস্তবে তুমি সশস্ত্র করেছিলে জায়নিস্ট মিলিশিয়াদের এবং ফিলিস্তিনিদের নিরস্ত্র করেছিলে। তুমি ন্যায়বিচার নয়, বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলে।
যে সন্ত্রাস তুমি ভুলে গেছো: ব্রিটেন, তুমি কি মনে রেখেছো সেই দিনগুলো—যখন তোমার সৈন্যরা জেরুজালেমের রাস্তায় শিকার হয়েছিল? যখন স্টার্ন গ্যাং ও ইরগুন তোমার অফিসারদের হত্যা করেছিল ও দড়িতে ঝুলিয়েছিল, যাদের নেতারা পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলো?
তুমি তাদের সন্ত্রাসী বলেছিলে, কিন্তু চাবিটা তুমি-ই তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলে। তুমি তাদের অস্ত্র দিলে, তারপর হঠাৎ সরে গেলে, পেছনে রেখে গেলে অরাজকতা ও রক্তপাতের উত্তরাধিকার। ১৯৪৮ সালে তুমি পতাকা গুটিয়ে চলে গেলে কিন্তু তোমার বিবেক অক্ষত রইল। আর প্রতিটি পরবর্তী প্রজন্ম তোমার সাম্রাজ্যিক দ্বিধার মূল্য দিচ্ছে।
শেখেনি যে সাম্রাজ্য:
তুমি একসময় বলেছিলে, “ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনো অস্ত যায় না।” আজ সেটি আর উদয়ই হয় না। তোমার সাম্রাজ্য, যা গড়েছিলে লুট, দাসত্ব ও ভণ্ডামির ওপর, এখন ভেঙে পড়েছে অস্বীকার ও নস্টালজিয়ায়। তুমি ভারতে লুট করেছিলে ৪৪ ট্রিলিয়ন ডলার, জাতিগুলোকে বানিয়েছিলে দাস, মহাদেশগুলো ভাগ করেছিলে, আর একে বলেছিলে “সভ্যতার ভার।” তুমি রেখে গেলে ক্ষতচিহ্ন, বঙ্গের দুর্ভিক্ষ, অমৃতসরের রক্ত,ঝ আর বাগদাদ থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ভুল সীমারেখা। ফিলিস্তিনে নীতি হিসেবে তুমি বিভেদের বীজ বপন করেছিলে, স্থাপন করেছিলে কপটতাকে কূটনীতি হিসেবে। তুমি এমন এক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিলে, যা তোমার সাম্রাজ্যের পতনের পরও টিকে আছে। আজ যখন গাজা সেই একই উপনিবেশিক যুক্তিতে জ্বলছে, তখন তোমার নীরবতাই তোমার স্বীকারোক্তি।
দেইর ইয়াসিনের ভূত:
১৯৪৮ সালে দেইর ইয়াসিন গণহত্যা, যেখানে জায়নিস্ট মিলিশিয়ারা শতাধিক ফিলিস্তিনি নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করেছিল,
ছিল সেই পালায়নের সূচনা, যা তুমি রচনা করেছিলে। তোমার জেনারেলরা জানত, তোমার কূটনীতিকরা সতর্ক করেছিল। তুমি কিছুই করোনি।
তুমি একে বলেছিলে “দুঃখজনক,”তারপর পিলাতের মতো হাত ধুয়ে ফেললে। ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইলান পাপে একে বলেছেন, “জাতিগত নির্মূল।” তুমি কোনো নিরীহ দর্শক ছিলে না, তুমি ছিলে বিপর্যয়ের ধাত্রী, তুমি একটি জাতির জন্ম দিয়েছিলে আরেকটি জাতিকে কবর দিয়ে।
প্রথম পাপের মূল্য:
দশকের পর দশক ধরে তুমি নিজেকে শান্তির প্রবীণ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তুলে ধরেছ — সম্মেলন করেছ, বিবৃতি দিয়েছ, সংযমের আহ্বান জানিয়েছো। কিন্তু তুমি মধ্যস্থতাকারী নও, তুমি প্রথম অপরাধী। তুমি আজ যে “দুই রাষ্ট্র সমাধান”-এর কথা বলছো, তা এক শতাব্দী আগে ভাঙা প্রতিশ্রুতির শেষকৃত্য মাত্র। তোমার বিশ্বাসঘাতকতার স্মৃতি প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিটি শরণার্থী শিবিরে, প্রতিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতালে, প্রতিটি গাজার শোকার্ত তাঁবুতে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও এক কণ্ঠ শোনা যায়, “এ ছিল ব্রিটেনের কাজ।”
প্রফেসর রাশিদ খালিদি যেমন বলেন,“ব্রিটেনের সচেতনভাবে পরিকল্পিত জায়নিস্ট উপনিবেশবাদ ছাড়া আজকের ফিলিস্তিনি ট্র্যাজেডি এ রূপে থাকত না।” তুমি আগুন ধরিয়েছিলে,তারপর অন্যদের সেটি পোড়াতে দিয়েছিলে।
একসময়ের “মহান শক্তির” পতন:
আজ নিজের দিকে তাকাও, ব্রিটেন। যে সাম্রাজ্য মহাদেশ ভাগ করত, সে এখন নিজের গুরুত্ব টিকিয়ে রাখতেও লড়ছে। তোমার প্রধানমন্ত্রী শার্ম আল-শেইখ সম্মেলনে পেছনের সারিতে, অদৃশ্যপ্রায় এক পুরোনো নিদর্শন। আর তোমার নেতা কিয়ার স্টার্মার, যিনি ওয়াশিংটনের সামনে মাথা নত করেন ও ইসরায়েলের বোমাবর্ষণকে বলেন “আত্মরক্ষা”— তিনি উত্তর-সাম্রাজ্যিক ভণ্ডামির প্রতিমূর্তি। ইতিহাস প্রতারিত হয় না। তোমার সাম্রাজ্য এখন অচলতার প্রান্তে, আর যে দানব তুমি সৃষ্টি করেছিলে, আজ তা বিচারের রূপে তোমাকেই তাড়া করছে।
উপসংহার-যে বিচারের হাত থেকে তুমি পালাতে পারবে না: হ্যালো ব্রিটেন, তুমি ভেবেছিলে তুমি চতুর, তুমি ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারবে, লজ্জাকে গোপন করতে পারবে। কিন্তু ইতিহাস কখনো ভুলে না গাজার ভূতেরা, দেইর ইয়াসিনের আত্মারা, ১৯৪৮এর কঙ্কালগুলো। তুমি অন্তহীন যুদ্ধের মঞ্চ সাজালে আর নাম দিলে কূটনীতি। তুমি একটি জাতিকে উচ্ছেদ করলে আর নাম দিলে রাষ্ট্রগঠন। আজ তুমি সেই প্রতারণার ফল দেখে বলছো—এটাই শান্তি? না ব্রিটেন, তুমি তোমার সাম্রাজ্যকে নস্টালজিয়ায় কবর দিতে পারো, কিন্তু তোমার পাপকে নয়।
বিশ্ব দেখেছে, তোমার কল্পনার “সভ্যতা” কীভাবে রক্ত ও প্রতারণায় গড়ে উঠেছে এবং এখন বিচারের হিসাব নিকাশ কেবল শুরু হয়েছে। -জাসিম আল-আজ্জাভি, বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে এমবিসি (MBC), আবুধাবি টিভি এবং আলজাজিরা ইংলিশ। তিনি সংবাদ উপস্থাপক, অনুষ্ঠান সঞ্চালক ও নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংঘাতের খবর কভার করেছেন, বিশ্বনেতাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং গণমাধ্যম বিষয়ে কোর্স পড়িয়েছেন।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button