ভাঙছে একক ইউরোপের স্বপ্ন !

Greeceঅর্থনৈতিক দায়, ঋণমুক্তি আলোচনা এবং তুমুল আলোচনা-সমালোচনায় এখন মুখর গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। আর এই পরিস্থিতিতে ২৮ সদস্যের এই আদর্শ সংস্থাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন অনেকেই। বিশেষ করে, গত পাঁচ বছর ধরে অভিবাসন ও অর্থনৈতিক সংকট ঘিরে রেখেছে ইইউকে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ অনেক বিতর্কে একক ইউরোপের চিন্তা থেকেও অনেককে সরে আসতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি ইউরোপের অনেক যুবকের কাছে ইইউ সংকট ব্যবস্থাপনার অধ্যয়ন ছাড়া আর বেশি কিছু নয়। ইউরোপের ২৮টি দেশ নিয়ে গঠিত হলেও বর্তমানে সংস্থাটি মূলত চালাচ্ছে ফ্রান্স ও জার্মানি। গ্রিস সংকট, ইউক্রেনে অস্ত্রবিরতি আলোচনা ইত্যাদিতে ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ আর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের কর্মকা-ে এর স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অন্যদিকে অবৈধ অভিবাসীদের ঠেকাতে ফ্রান্স, ইতালি, হাঙ্গেরি ইত্যাদি দেশের পৃথক প্রতিরোধক সীমানা স্থাপনের মাধ্যমে ইইউ সদস্যদের সংঘবদ্ধ রোডম্যাপ সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। কিন্তু একেবারে শুরুর দিকে নজর দিলে, ইইউ-এর নিগুঢ় উদ্দেশ্যই ছিল একক ইউরোপ ভাবনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপে বিরোধ ভুলে শান্তির ভিত্তি রচনাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

একক মুদ্রা, সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাধীনভাবে ভ্রমণ, সীমানাবিহীন বাণিজ্য, সম্মিলিত নিরাপত্তা নীতিতে সাফল্যের কারণে বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি আদর্শ। আর অভ্যন্তরীণ বিরোধ ঠেকাতেও সংস্থাটি এতকাল যথেষ্ট সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। তবে সংঘবদ্ধ ইউরোপ ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে বিরোধ ইদানীং চাঙ্গা হচ্ছে। তাই ইইউ-এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পৃথক পৃথক ব্যাখ্যা দিতেও দেখা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের শুরুর দিকে ব্রিটেন একটি সাধারণ বাজারের খোঁজে ছিল। অন্যদিকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের স্বপ্ন ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ, যেখানে থাকবে না কোনো ‘আয়রন কারটেইন’ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিচ্ছিন্নতা)। সত্যি বলতে, ওয়ারশ চুক্তির আওতাভুক্ত দেশগুলোর জন্য ইইউতে অংশ নেয়ার সুযোগের অর্থ ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় নিরাপত্তা বৃদ্ধি। উদারহরণস্বরূপ বলা যায়, পোল্যান্ড বিশ্বাস করে কমিউনিস্ট শাসনের কারণেই তারা ভাগ্য হারিয়েছে। এসব পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিত্তি। সাবেক পোলিশ প্রেসিডেন্ট লেচ ওয়ালেসা কমিউনিস্ট শাসন নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ করতেন। তিনি পশ্চিম ইউরোপের গণতন্ত্রের চিন্তাকে হাত খুলে গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলেন; কিন্তু জোর করে চাপিয়ে দেয়ার পক্ষে নন। ২০০৪ সালে ইইউতে যোগ দেয়া ১০ নতুন সদস্যের মধ্যে পোল্যান্ড একটি। এর পরের বছর সাংবিধানিক চুক্তির পরিকল্পনা থাকলেও দুই আদি সদস্য রাষ্ট্র ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের বিরোধিতায় তা ভেস্তে যায়। এরপর লিসবনে সংস্কার চুক্তিতে অনেক ভাবনা পুনরায় চলে এলেও হতাশা বাড়তে থাকে। এর মূলে ছিল দেশগুলোতে ক্রমবর্ধমান ইইউ-এর অভিবাসন ও চাকরি নিয়ে উৎকণ্ঠা। এর ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলো, যারা সাশ্রয়ী শ্রম ও কম দ্রব্যমূল্যের জন্য সুপরিচিত ছিল, তারা পূর্বের নতুন সদস্যদের পেছনে পড়তে শুরু করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থানান্তরের জন্য পর্তুগাল, স্পেন, ইতালি এবং গ্রিস থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চলে যেতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে পূর্বমুখী ইইউ-এর বিস্তারই যে ইউরোপীয় চাকরির বাজারের একমাত্র কারণ, সেটা বলা যাবে না। কারণ, এখনো বেকারত্বকে ইইউ-এর অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদিকে সাম্প্রতিক সংকট নিরসনে গ্রিসের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণের জন্য আগামী রোববার ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের এক জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেই বৈঠকেই গ্রিস ইউরোজোনে থাকছে কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আর এ জন্য বৃহস্পতিবারের মধ্যে কী কী শর্তে তারা ঋণ নিতে চায়, সে বিষয়ে চূড়ান্ত পরিকল্পনা পেশ করতে বলা হয়েছে গ্রিসকে। মঙ্গলবার বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইউরোজোনের নেতাদের বৈঠকের পর ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক বলেন, ‘ইউরোজোনের ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল সময়’ পার করছেন তারা। তবে যাই হোক, এই সপ্তাহেই চূড়ান্ত সময়সীমা শেষ হচ্ছে।’ তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে, গ্রিসের সঙ্গে আলোচনায় একক ইউরোপের ভাবনা উঠে আসবে কিনা। সেই আলোচনা কি হবে শুধুই নিয়মতান্ত্রিক, নাকি সেখানে প্রায়োগিক কিছু পদক্ষেপও থাকবে। উত্তর পাওয়া যাবে ইউরোজোনের চলমান ঘটনাপ্রবাহেই।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button