কুরবানিতে অংশীদারত্ব: ইসলাম কী বলে?

দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমাজে একটি বিষয় নিয়ে বেশ বিতর্ক চলে আসছে। প্রতি বছর কুরবানি ইদের সময় এ নিয়ে প্রমাণ ও নির্ভরযোগ্য তথ্য ছাড়া পক্ষ-বিপক্ষ তর্ক করতে থাকে, যা থেকে মূলত পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ও দোষারোপ ছাড়া শরয়ি কোনো সমাধান পাওয়া যায় না। বিষয়টি হলো, গরু, মহিষ ও উটে একাধিক ব্যক্তি; যথা সর্বোচ্চ সাতজনের অংশীদারত্বে কুরবানি দেওয়া যাবে কিনা। এটাকে অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম বৈধ বলেন, আর এর বিপরীতে অন্য একটি পক্ষ অবৈধ বলে মনে করেন। আসুন, কুরবানির মতো এ গুরুত্বপূর্ণ বিধানে অংশীদারত্ব নিয়ে আমাদের শরিয়ত কী বলে, তা জেনে নিই। আশা করি, দালিলিক ও প্রামাণ্য আলোচনায় এ বিষয়টি সবার জন্যই স্পষ্ট হবে। আল্লাহ-ই আমাদের তাওফিকদাতা।

প্রথমত, জেনে নেওয়া জরুরি যে, কুরবানির পশু ছয় শ্রেণির হয়ে থাকে। যথা : উট, মহিষ, গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। এ পশুগুলোর কিছু আছে এমন, যেগুলোতে অংশীদারত্ব জায়েজ নেই। আর কিছু আছে, যেগুলোতে অংশীদারত্বের সাথে কুরবানি করার অনুমোদন পাওয়া যায়। তাই আমরা কুরবানির পশুর শ্রেণি বিন্যাস হিসেবে অংশীদারত্বের মাসআলাকে দুই ভাগে আলোচনা করব। প্রথম ভাগে ওই সব পশু নিয়ে কথা বলব, যেগুলোতে অংশীদারত্বের সাথে কুরবানি করা জায়িজ নয়। আর দ্বিতীয় ভাগে আলোচনা করব সেসব পশু নিয়ে, যেসব পশুতে অংশীদারত্বের সাথে কুরবানি করা জায়িজ।

প্রথম ভাগ :
কুরবানির পশুগুলোর মধ্য হতে ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা- এই তিন শ্রেণির পশু দ্বারা শুধু একজন ব্যক্তিই কুরবানি দিতে পারবে। এতে অন্য কারও শরিক হওয়ার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে সব শ্রেণির উলামায়ে কিরামের ইজমা বা ঐকমত্য রয়েছে।

ইমাম নববি রহ. বলেন :
وَأَجْمَعُوا عَلَى أَنَّ الشَّاةَ لَا يَجُوزُ الِاشْتِرَاكُ فِيهَا.
‘এ ব্যাপারে উলামায়ে কিরাম ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, ছাগলের মধ্যে অংশীদারিত্ব বৈধ নয়।’ (শারহু মুসলিম, নববি : ৯/৬৭, প্র. দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

ইমাম ইবনে রুশদ রহ. বলেন :
أَنَّ الْأَصْلَ هُوَ أَنْ لَا يُجْزِي إِلَّا وَاحِدٌ عَنْ وَاحِدٍ، وَلِذَلِكَ اتَّفَقُوا عَلَى مَنْعِ الِاشْتِرَاكِ فِي الضَّأْنِ.
‘মূলনীতি হলো, একটি পশু কেবল একজনের জন্যই যথেষ্ট হবে। আর এজন্যই তো ফুকাহায়ে কিরাম সবাই ছাগলে অংশীদারত্ব অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। (বিদায়াতুল মুজতাহিদ : ২/১৯৬, প্র. দারুল হাদিস, কায়রো)

দ্বিতীয় ভাগ :
উট, মহিষ ও গরু; এই তিন প্রকারের পশু দ্বারা কুরবানি দেওয়ার ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তি শরিক হতে পারবে কি না? এক্ষেত্রে অধিকাংশ উলামায়ে কিরামের মত হলো, এসব পশুতে একজন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত শরিক হতে পারবে। অবশ্য কিছু ফকিহের মতে একটি উটে দশজন পর্যন্ত শরিক হতে পারবে। আমরা এ বিষয়ে নিয়ে কয়েকটি হাদিস লক্ষ্য করি।

এক : সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، قَالَ: نَحَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ.
‘জাবির বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা হুদাইবিয়ার বছর রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাথে উট কুরবানি করেছি সাতজনের পক্ষ থেকে, অনুরূপ গরু কুরবানি করেছি সাতজনের পক্ষ থেকে।’ (সহিহু মুসলিম : ২/৯৫৫, হা. নং ১৩১৮, প্র. দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবিয়্যি, বৈরুত)

দুই : সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: الْبَقَرَةُ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالْجَزُورُ عَنْ سَبْعَةٍ.
‘জাবির বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, নবি কারিম সা. ইরশাদ করেছেন, গরু সাতজনের পক্ষ থেকে এবং উট সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট।’ (সুনানু আবি দাউদ : ৩/৯৮, হা. নং ২৮০৮, প্র. আল মাকতাবাতুল আসরিয়্যা, বৈরুত)

তিন: মুসনাদে ইবনে জাদে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ جَابِرٍ قَالَ: أَمَرَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ نَشْتَرِكَ فِي الْإِبِلِ وَالْبَقَرِ، كُلُّ سَبْعَةٍ مِنَّا فِي بُدْنَةٍ.
‘জাবির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদেরকে রাসুলুল্লাহ সা. আদেশ দিয়েছেন, যেন আমরা প্রত্যেক সাতজনে একটি করে গরু ও উটে শরিক হই। (মুসনাদু ইবনিল জাদ : পৃ. নং ৩৮৪, হা. নং ২৬২৮, প্র. মুআসসাসাতু নাদির, বৈরুত)

চার : সুনানুত তিরমিজিতে বর্ণিত হয়েছে :
عَنْ جَابِرٍ قَالَ: نَحَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالحُدَيْبِيَةِ البَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ.
هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ وَالعَمَلُ عَلَى هَذَا عِنْدَ أَهْلِ العِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَغَيْرِهِمْ، وَهُوَ قَوْلُ سُفْيَانَ الثَّوْرِيِّ، وَابْنِ الْمُبَارَكِ، وَالشَّافِعِيِّ، وَأَحْمَدَ، وَإِسْحَاقَ وقَالَ إِسْحَاقُ: يُجْزِئُ أَيْضًا البَعِيرُ عَنْ عَشَرَةٍ وَاحْتَجَّ بِحَدِيثِ ابْنِ عَبَّاسٍ
‘জাবির বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা হুদাইবিয়ার বছর রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাথে উট কুরবানি করেছি সাতজনের পক্ষ থেকে এবং গরু কুরবানি করেছি সাতজনের পক্ষ থেকে।’
ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, এটা হাসান সহিহ হাদিস। নবি কারিম সা.-এর বিজ্ঞ সাহাবা ও অন্যন্য ফুকাহায়ে কিরাম এ হাদিস অনুযায়ী আমল করেন। আর এটাই ইমাম সুফইয়ান সাওরি রহ., ইমাম ইবনে মুবারক রহ., ইমাম শাফিয়ি রহ., ইমাম আহমাদ রহ. ও ইমাম ইসহাক রহ.-এর মত। ইসহাক রহ. বলেন, উট দশজনের পক্ষ থেকেও যথেষ্ট হবে এবং তিনি ইবনে আব্বাস রা.-এর হাদিস দ্বারা প্রমাণ দেন। (সুনানুত তিরমিজি : ৩/১৩১, হা. নং ১৫০২, প্র. দারুল গারবিল ইসলামি, বৈরুত)

এসব হাদিস থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, গরু বা উটে সাতজন ব্যক্তি শরিক হতে পারবে। এখন আমরা দেখব, এ ব্যাপারে উম্মাহর বিজ্ঞ ফুকাহায়ে কিরাম কী বলেন; বিশেষত চার মাজহাবের উলামায়ে কিরাম এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত দেন?

ক. হানাফি মাজহাব :
হানাফি মাজহাব উপরোক্ত হাদিসগুলো সামনে রেখে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, গরু, মহিষ ও উটে সর্বোচ্চ সাতজন ব্যক্তি শরিক হতে পারবে। এ ব্যাপারে ফিকহে হানাফির প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘বাদাইউস সানায়ি’-তে বিখ্যাত ফকিহ ইমাম আলাউদ্দিন কাসানি রহ. বলেন :
وَلَا يَجُوزُ بَعِيرٌ وَاحِدٌ وَلَا بَقَرَةٌ وَاحِدَةٌ عَنْ أَكْثَرَ مِنْ سَبْعَةٍ وَيَجُوزُ ذَلِكَ عَنْ سَبْعَةٍ أَوْ أَقَلَّ مِنْ ذَلِكَ، وَهَذَا قَوْلُ عَامَّةِ الْعُلَمَاءِ.
‘একটি উট ও একটি গরু সাতের অধিক ব্যক্তির পক্ষ থেকে জায়িজ নেই। সাতজন বা তার কম লোকের পক্ষ থেকে জায়িজ হবে। আর এটাই অধিকাংশ উলামায়ে কিরামের উক্তি।’ (বাদায়িউস সানায়ি :৫/৭০, প্র. দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরূত)

খ. মালিকি মাজহাব :
মালিকি মাজহাব এক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, এক পরিবারে যত সদস্যই থাকুক না কেন, সবার পক্ষ থেকে একটি উট বা গরুই যথেষ্ট। একাধিক পরিবারের দুজন ব্যক্তি হলেও অংশীদারত্ব জায়িজ হবে না। এ ব্যাপারে মালিকি মাজহাবের সুপ্রসিদ্ধ কিতাব ‘বিদায়াতুল মুজতাহিদ’-এ ইমাম ইবনে রুশদ রহ. বলেন :
فَإِنَّهُمُ اخْتَلَفُوا فِي ذَلِكَ، فَقَالَ مَالِكٌ: يَجُوزُ أَنْ يَذْبَحَ الرَّجُلُ الْكَبْشَ أَوِ الْبَقَرَةَ أَوِ الْبَدَنَةَ مُضَحِّيًا عَنْ نَفْسِهِ وَعَنْ أَهْلِ بَيْتِهِ الَّذِينَ تَلْزَمُهُ نَفَقَتُهُمْ بِالشَّرْعِ، وَكَذَلِكَ عِنْدَهُ الْهَدَايَا. وَأَجَازَ الشَّافِعِيُّ وَأَبُو حَنِيفَةَ وَجَمَاعَةٌ أَنْ يَنْحَرَ الرَّجُلُ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعٍ، وَكَذَلِكَ الْبَقَرَةَ مُضَحِّيًا أَوْ مُهْدِيًّا.
‘এ মাসআলায় উলামায়ে কিরাম মতানৈক্য করেছেন। ইমাম মালিক রহ. বলেন, নিজের পক্ষ থেকে এবং শরয়িভাবে পরিবারের যাদের ভরণ-পোষণ বহন করা আবশ্যক, এমন সবার পক্ষ থেকে একজন ব্যক্তি কুরবানির উদ্দেশ্যে মেষ বা গরু বা উট কুরবানি করতে পারে। অনুরূপ তাঁর নিকট হজের পশুর একই বিধান। আর ইমাম শাফিয়ি রহ., ইমাম আবু হানিফা রহ. এবং একদল উলামায়ে কিরাম এ অনুমোদন দিয়েছেন যে, কুরবানির উদ্দেশ্যে হোক বা হজের উদ্দেশ্যে হোক, সাতজনের পক্ষ থেকে একটি উট কুরবানি দেওয়া যাবে। অনুরূপ গরুরও একই বিধান।’ (বিদায়াতুল মুজতাহিদ : ২/১৯৬, প্র. দারুল হাদিস, কায়রো)

গ. শাফিয়ি মাজহাব :
এ মাসআলায় শাফিয়ি মাজহাব হানাফিদের মতোই এ সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, উট এবং গরুতে সর্বোচ্চ সাতজন পর্যন্ত শরিক হতে পারবে; চাই তারা একই পরিবারের হোক বা ভিন্ন পরিবারের হোক। শাফিয়ি মাজহাবের অন্যতম নির্ভরযোগ্য কিতাব ‘আল-মাজমু শারহুল মুহাজ্জাব’-এ ইমাম নববি রহ. বলেন :
وَتُجْزِئُ الْبَدَنَةُ عَنْ سَبْعَةٍ وَكَذَا الْبَقَرَةُ سَوَاءٌ كَانُوا أَهْلَ بَيْتٍ أَوْ بُيُوتٍ.
‘উট সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে; গরুও অনুরূপ। চাই তারা সবাই এক পরিবারের হোক বা ভিন্ন পরিবারের হোক।’ (আল-মাজমু শরহুল মুহাজ্জাব : ৮/৩৯৭, প্র. দারুল ফিকর, বৈরুত)

ঘ. হাম্বলি মাজহাব :
এক্ষেত্রে হাম্বলি মাজহাবও হানাফিদের মতো এ সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, উট ও গরু সর্বোচ্চ সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। হাম্বলি মাজহাবের সুপ্রসিদ্ধ ও নির্ভযোগ্য কিতাব ‘আল মুগনি’-তে ইমাম ইবনে কুদামা রহ. বলেন :
(وَتُجْزِئُ الْبَدَنَةُ عَنْ سَبْعَةٍ، وَكَذَلِكَ الْبَقَرَةُ) وَهَذَا قَوْلُ أَكْثَرِ أَهْلِ الْعِلْمِ. رُوِيَ ذَلِكَ عَنْ عَلِيٍّ وَابْنِ عُمَرَ وَابْنِ مَسْعُودٍ وَابْنِ عَبَّاسٍ وَعَائِشَةَ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ -، وَبِهِ قَالَ عَطَاءٌ وَطَاوُسٌ وَسَالِمٌ وَالْحَسَنُ وَعَمْرُو بْنُ دِينَارٍ وَالثَّوْرِيُّ وَالْأَوْزَاعِيُّ وَالشَّافِعِيُّ وَأَبُو ثَوْرٍ، وَأَصْحَابُ الرَّأْيِ….. قَالَ أَحْمَدُ: مَا عَلِمْت أَحَدًا إلَّا يُرَخِّصُ فِي ذَلِكَ، إلَّا ابْنَ عُمَرَ. وَعَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيِّبِ، أَنَّ الْجَزُورَ عَنْ عَشَرَةٍ، وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ. وَبِهِ قَالَ إِسْحَاقُ.
‘উট সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে; গরুও অনুরূপ। আর এটাই অধিকাংশ উলামায়ে কিরামের বক্তব্য। এটা বর্ণিত হয়েছে আলি রা., ইবনে উমর রা., ইবনে মাসউদ রা., ইবনে আব্বাস রা., আয়িশা রা. থেকে। এমনই বলেছেন আতা রহ., তাউস রহ., সালিম রহ., হাসান রহ., আমর বিন দিনার রহ., সুফইয়ান সাওরি রহ., আওজায়ি রহ., শাফিয়ি রহ., আবু সাওর রহ. এবং হানাফি ফুকাহায়ে কিরাম। …ইমাম আহমদ রহ. বলেন, আমার জানামতে ইবনে উমর রা. ছাড়া সবাই এটাকে (উট ও গরু সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হওয়াকে) অনুমোদন দিয়েছেন।’ (আল মুগনি : ৯/৪৩৭, প্র. মাকতাবা কায়রো, মিশর)

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারলাম, চার মাজহাবই এ ব্যাপারে একমত যে, গরু ও উটে একজন হওয়া আবশ্যক নয়; যেমনটি আমাদের দেশের কতিপয় আহলে হাদিস ভাই মনে করেন। অবশ্য তাদের মধ্য হতে হানাফি, শাফিয়ি ও হাম্বলি মাজহাব এ কথার প্রবক্তা যে, উট ও গরু যেকোনো সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। আর মালিকি মাজহাব মনে করে, এখানে এক পরিবারের সদস্য হওয়া আবশ্যক; চাই যত সদস্যই থাকুক না কেন। মোটকথা, একাধিক ব্যক্তির শরিক হওয়ার ব্যাপারে সবাই একমত। তবে শরিক কারা হবে, সেক্ষেত্রে মালিকি মাজহাব জমহুর উলামায়ে কিরামের মত হতে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে।

এ মাসআলায় আমরা আরববিশ্বের গবেষণাকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ শাইখদের কয়েকটি ফতোয়া উল্লেখ করব, যাতে তা আমাদের অতিউৎসাহী কিছু ভাইদের অন্তরের খোরাক হয় এবং দিল প্রশান্তির কারণ হয়।

আরবসহ সমগ্র ইসলামি বিশ্বে ব্যাপকভাবে সমাদৃত ৪৫ খণ্ডে প্রকাশিত ফিকহি বিশ্বকোষ ‘আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা’-এর ভাষ্য হলো :
وَيَتَعَلَّقُ بِهَذَا الشَّرْطِ أَنَّ الشَّاةَ تُجْزِئُ عَنْ وَاحِدٍ، وَالْبَدَنَةُ وَالْبَقَرَةُ كُلٌّ مِنْهُمَا عَنْ سَبْعَةٍ، لِحَدِيثِ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَال: نَحَرْنَا مَعَ رَسُول اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَهَذَا مَرْوِيٌّ عَنْ عَلِيٍّ وَابْنِ عُمَرَ وَابْنِ مَسْعُودٍ وَابْنِ عَبَّاسٍ وَعَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ، وَبِهِ قَال عَطَاءٌ وَطَاوُسٌ وَسَالِمٌ وَالْحَسَنُ وَعَمْرُو بْنُ دِينَارٍ وَالثَّوْرِيُّ وَالأْوْزَاعِيُّ وَأَبُو ثَوْرٍ وَأَكْثَرُ أَهْل الْعِلْمِ، وَهُوَ قَوْل الْحَنَفِيَّةِ وَالشَّافِعِيَّةِ وَالْحَنَابِلَةِ.
‘এ শর্তের সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি মাসআলা হলো, ছাগল শুধু একজনের পক্ষ থেকেই যথেষ্ট হবে। আর উট ও গরু প্রত্যেকটি সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। দলিল, জাবির রা.-এর হাদিস যে, “আমরা হুদাইবিয়ার বছর রাসুলুল্লাহ সা.-এর সাথে উট কুরবানি করেছি সাতজনের পক্ষ থেকে এবং গরু কুরবানি করেছি সাতজনের পক্ষ থেকে।” এমনটি বর্ণিত হয়েছে আলি রা., ইবনে উমর রা., ইবনে মাসউদ রা., ইবনে আব্বাস রা., আয়িশা রা. থেকে। এমন কথাই বলেছেন আতা রহ., তাউস রহ., সালিম রহ., হাসান রহ., আমর বিন দিনার রহ., সুফইয়ান সাওরি রহ., আওজায়ি রহ., আবু সাওর রহ. ও অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম। আর এটাই শাফিয়ি, হানাফি ও হাম্বলিদের মত। (আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা : ৫/৮২, প্র. অজারাতুল আওকাফ ওয়াশ শুউনিল ইসলামিয়্যা, কুয়েত)

আরববিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গবেষণাকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত ‘ফাতাওয়াল লাজনাতিদ দায়িমা’-তে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে :
وتجزئ البدنة والبقرة عن سبعة، فعن جابر قال: أمرنا رسول الله – صلى الله عليه وسلم – أن نشترك في الإبل والبقر كل سبعة منا في بدنة. متفق عليه.
‘উট ও গরু সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। জাবির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদেরকে রাসুলুল্লাহ সা. আদেশ দিয়েছেন, যেন আমরা প্রত্যেক সাতজনে একটি করে গরু ও উটে শরিক হই। সহিহুল বুখারি ও সহিহু মুসলিম।’ (ফাতাওয়াল লাজনাতিদ দায়িমা : ১০/৪৩০, ফতোয়া নং ১৮৪৬৩, প্র. রিয়াসাতু ইদারাতিল বুহুসিল ইলমিয়্যা ওয়াল ইফতা, রিয়াদ)

আরবের সর্বস্বীকৃত ও সুপ্রসিদ্ধ আলিম শাইখ বিন বাজ রহ. বলেন :
ومن ضحى بالبقر أو بالإبل -الناقة عن سبعة، والبقرة عن سبعة- فكله طيب ولا حرج.
‘আর যে ব্যক্তি গরু অথবা উট দ্বারা কুরবানি দেওয়ার ক্ষেত্রে উট সাতজনের পক্ষ থেকে এবং গরু সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানি করবে, এর সবগুলোই ভালো ও উত্তম। এতে কোনো অসুবিধা নেই।’ (মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বাজ : ১৮/৪৩, প্র. মুহাম্মাদ বিন সাদ শুআইয়ির কর্তৃক সংকলিত ও প্রকাশিত)

আরবের আরেকজন বিখ্যাত শাইখ ইবনে উসাইমিন রহ. বলেন :
وأما إذا اشترك الإنسان وزوجته في قيمة شاة فإن هذا لا يصح؛ لأنه لا يشترك اثنان في القيمة في شاة واحدة، وإنما الاشتراك المتعدد في الإبل والبقر، يكون البعير عن سبعة، والبقرة عن سبعة، أما الغنم فلا يمكن أن يشترك اثنان على الشيوع أبدً.
‘একটি ছাগলের মূল্যে যদি কোনো ব্যক্তি এবং তার স্ত্রী শরিক হয় তাহলে তা বিশুদ্ধ হবে না। কেননা, একটি ছাগলের মূল্যে দুজন ব্যক্তি শরিক হতে পারে না। একাধিক অংশীদারত্ব তো শুধু উট এবং গরুতে। উট সাতজনের পক্ষ থেকে এবং গরু সাতজনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। কিন্তু ছাগলে দুজন সমভাবে শরিক হওয়া কখনো সম্ভব নয়।’ (মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়িলিল উসাইমিন : ২৫/৪৬, প্রশ্নোত্তর নং ৩৫, প্র. দারুল ওয়াতন)

পরিশিষ্ট :
পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হলো যে, গরু ও উটে শরিকি কুরবানি দেওয়া হাদিস ও ইজমার আলোকে সুসাব্যস্ত একটি বিষয়। বিষয়টি এতটাই শক্তিশালী যে, এতে উল্লেখযোগ্য কারও তেমন কোনো মতানৈক্য নেই। সাহাবায়ে কিরাম, তাবিয়িন, আইম্মায়ে কিরাম ও চার মাজহাবের সকল ফকিহ এ মাসআলায় একমত। এমন একটি প্রতিষ্ঠিত বিধানকে কিছু মানুষ অযথাই বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করছে। আশা করি, সত্য জানার নিয়ত থাকলে প্রবন্ধটি পড়ে সব সংশয়ের নিরসন হবে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, এককভাবে কেউ কুরবানি দিতে পারলে তা ভালো ও উত্তম, কিন্তু তাই বলে শরিয়তের জায়িজ ও অনুমোদিত কোনো বিধানকে নাজায়িজ আখ্যা দিয়ে উম্মাহকে বিপদ ও কষ্টের মুখে ঠেলে দেওয়া হঠকারিতা ও অকল্যাণকামিতা ছাড়া কিছু নয়। দ্বীন সম্বন্ধে প্রাজ্ঞ কেউ এমন কথা বলতে পারে না। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে না-জেনে, না-বুঝে মিথ্যা অপপ্রচার করা থেকে হিফাজত করুন এবং সত্য জানার পর অন্তর থেকে মেনে তার প্রচার ও প্রসার করার তাওফিক দান করুন।
-আখতার জামান

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button