আল্লামা ইকবাল ও তার রাজনৈতিক অবদান

শাহ্ আব্দুল হান্নান
আল্লামা ইকবালের কোন পরিচয়টি বড় তা আমি জানি না। ইকবাল অবশ্যই কবি, দুই ভাষার কবি। সর্বোপরি তিনি একজন দার্শনিক ছিলেন। মুসলিম দর্শনে তিনি নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। তিনি নতুন দর্শন দান করেন। মুসলিম উম্মাহকে উজ্জীবিত করার জন্য তিনি ‘আসরারে খুদি’ বা খুদির দর্শন উপহার দেন। আর সেটিকে আরো ব্যাখ্যা করেন যে, ‘রমুজে বেখুদি’তে খুদির প্রকাশটি কী? আর খুদির বিলীন হওয়াটাই বা কী?
সত্যিকার অর্থেই তিনি একজন বড় দার্শনিক ছিলেন। তিনি খ্যাতিমান দার্শনিকই ছিলেন এমন শুধু নয়, তিনি ইসলামেরও দার্শনিক ছিলেন। শিক্ষায় তিনি দর্শনে এমএ ও পিএইচডি করেন। শিক্ষার দিক থেকেও তিনি এ উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অ্যারাবিকেও এমএ করেন। আবার বার এট ল-ও করেছেন। আর কবি এমন এক প্রতিভা, যার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানিক ডিগ্রি লাগে না। ডিগ্রি ছাড়াই বড় হতে পারে। বড় হনও তারা। এ সবকিছু মিলেই ইকবাল।
ইকবালের রাজনৈতিক দিকটি মানুষ তেমন খেয়াল করে না। কিন্তু উপমহাদেশের রাজনীতিতে তার অবদান খুবই বেশি। তাকে খুবই বড় একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আমি দেখি। তিনি নির্বাচনে অংশ নিয়ে লাহোর থেকে পাঞ্জাব সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও তিনি গণতন্ত্রের, মূলত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলেন। পার্লামেন্টের ভেতরেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। তবে তিনি সেকুলার গণতন্ত্র পছন্দ করতেন না। গণতন্ত্র যদি ইসলামভিত্তিক হয় তাহলে সেটিকেই তিনি প্রকৃত গণতন্ত্র বলে মনে করতেন, যেখানে আল্লাহ তায়ালার আইন হবে আর শাসন হবে মানুষের।
রাজনীতির ক্ষেত্রে ইকবালের দু’টি অবদানকে আমি সবচেয়ে বড় মনে করি। একটি হলো মুসলিম লীগে তার সক্রিয় ভূমিকা পালন। তখন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ছিল সারা ভারত উপমহাদেশের মূল প্রতিষ্ঠান। সে প্রতিষ্ঠানের তিনি এক সময়ের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। তিনি তার সাধ্যমতো মুসলিম লীগকে এগিয়ে নেয়ার কাজ করেছেন। সে মুসলিম লীগ ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় অবদান হলো, তিনি এলাহাবাদ কনফারেন্সে ১৯৩০ সালে ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব দিকে দু’টি মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। এ দু’টি এলাকাতেই মুসলিমরা মেজরিটি। তিনি এটি দেখতে পেয়েছিলেন যে, সারা ভারতে হিন্দু মেজরিটি এবং সেখানে মুসলিমরা সত্যিকার স্বাধীনতা পাবে না। মুসলমানরা সংখ্যায় অল্প হলে কথা ছিল। কিন্তু এরা বড় একটা জাতি। তারা ভারতের পূর্ব দিকের প্রদেশে মেজরিটি অর্থাৎ বেঙ্গল এবং আসামে, যেটি বর্তমানে নয়টি প্রদেশে বিভক্ত হয়ে গেছে। এ অঞ্চল আর পশ্চিম দিকের মুসলিম মেজরিটির প্রদেশ নিয়ে দু’টি আলাদা রাষ্ট্রের কথা ইকবাল বলেন।
তিনি মুসলিম জাতীয়তাবাদের কথা বলেন। তিনি জাতীয়তাবাদের সাথে ইসলামের সমন্বয় ঘটান। জাতীয়তাবাদের ধারণা হলো, প্রত্যেক জাতির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আছে। প্রত্যেক জাতি ভাষাভিত্তিক হোক আর এলাকাভিত্তিক হোক, তার স্বায়ত্তশাসন চাওয়ার অধিকার আছে। ইকবাল এটিকে ইসলামের সাথে সমন্বয় ঘটান। তিনি বললেন, ইসলামের ভিত্তিতেও জাতীয়তা হতে পারে। আর জাতির সাথে পাশ্চাত্যের মিলন ঘটালেন এ বলে, আর্দশিক মুসলিম জাতি, তার যে ভূখণ্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ সে এলাকায় স্বাধীন রাষ্ট্র করতে পারবে। ওয়েস্টার্ন থিওরি ছিল, জাতির সাধারণ এলাকাভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক বা বর্ণভিত্তিক হবে এবং তার আলোকে সেখানে যারা মেজরিটি সেখানে রাষ্ট্র হতে পারে। তবে তাদের মধ্যে এ আদর্শিক জাতির কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু ইকবাল সেখানে ইসলামভিত্তিক জাতির কথা বললেন। মুসলমানদের আর্দশিক জাতি বললেন। তিনি যেখানে মুসলমানরা মেজরিটি সেখানে স্বাধীন হওয়ার কথা বললেন। এর মাধ্যমে তিনি ইসলামের সাথে আধুনিক জাতীয়তাবাদের একটি সমন্বয় ঘটালেন। এ সমন্বয়ের মাধ্যমেই তিনি পাকিস্তান দাবি করলেন। একপর্যায়ে পূর্ব অংশ ও পশ্চিম অংশ মিলে একটি জোরদার আন্দোলন হলো। সে আন্দোলনের ফলস্বরূপ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন হলো। পরবর্তী সেখান থেকে বাংলাদেশ হলো।
ভারতের এ রাজনৈতিক বিবর্তনে ইকবালের ভূমিকা অনেক বড়। ইসলামের ভাবধারা, চেতনার সাথে তিনি আধুনিক জাতীয়তার সমন্বয় ঘটিয়ে তাকে ইসলামীকরণ করে ফেললেন অথবা আমরা বলতে পারি তাকে ইসলামাইজ করে ফেললেন। এটি তার একটি বিরাট অবদান। এ কাজ তার আগে কেউ করেনি। এ দিক থেকে ইকবাল অনেক বড় রাজনীতিবিদ ছিলেন। তার কথা আমরা ইতিহাস থেকে বাদ দিতে পারব না।
লেখক : সাবেক সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button