আন্তর্জাতিক এক স্কলারের চিরবিদায়

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন: বর্তমান বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামিক স্কলার, সাবেক বিচারপতি, শায়খুল হাদিস, লেখক ও গবেষক আল্লামা ড. খালিদ মাহমুদ ১৪ মে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এ মনীষীর যোগ্যতা ও প্রতিভা ছিল বিস্ময়কর। দ্বীনি ইলম ও আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয়ে তার জীবন গড়ে ওঠে। মেধা ও মননের বহুমাত্রিকতাকে কাজে লাগিয়ে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে ইসলামের খিদমতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন পুরো জীবন। ইসলাম, মুসলমান, ইসলামের ইতিহাস ও আকিদা-বিশ্বাস নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সব প্রয়াসের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছেন এবং প্রতিপক্ষের সব চ্যালেঞ্জের বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব দিতে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত পাঞ্জাবের কাসুর জেলায় ১৯২৫ সালের ১৭ অক্টোবরে তার জন্ম। গুজরানওয়ালার মাদরাসায় পড়ালেখা শেষ করে তিনি লাহোর জামিয়া আশরাফিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি লাভ করেন। পরে বিশ^খ্যাত দ্বীনি মাদরাসা, ভারতের উত্তরপ্রদেশের দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন এবং বরেণ্য শিক্ষাবিদদের কাছে তাফসির, হাদিস, ফিকহসহ ইলমে দ্বীন হাসিল করেন। অতঃপর উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাটে অবস্থিত জামিয়া ইসলামিয়া তালিমুদ্দিনে ভর্তি হয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। উপমহাদেশের খ্যাতনামা আলিম বিশেষ করে শায়খুল হাদিস আল্লামা জাকারিয়া কান্ধলভী, আল্লামা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী, আল্লামা শামসুল হক আফগানী, আল্লামা শাব্বির আহমদ ওসমানী, মাওলানা বদরে আলম মিরাটী, মাওলানা খায়ের মুহাম্মদ জালান্ধরী, মুফতি মুহাম্মদ শফি, মুফতি মুহাম্মদ হাসান ও আল্লামা ইদরিস কান্ধলভী ছিলেন তার খাস ওস্তাদ। তিনি বহু দিন লাহোর জামিয়া আশরাফিয়ার শায়খুল হাদিস হিসেবে বোখারি শরিফের পাঠদান করেন। তিনি বেশ কিছু দিন শিয়ালকোটের মারে কলেজ এবং এমএও লাহোরের কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।
আল্লামা খালিদ মাহমুদ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের শরিয়াহ অ্যাপিলেট ডিভিশনের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন নিষ্ঠার সাথে। হাদিস, ফিকহ, ইসলামী আইন, জুরিসপ্রুডেন্স, ইসলামের ইতিহাস, তর্কশাস্ত্র, হিন্দুমত, ইহুদিবাদ ও খ্রিষ্টবাদের বিষয়ে তার পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। প্রখর স্মৃতি ও মেধাশক্তির অধিকারী ড. খালিদ মাহমুদ বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সেমিনার, ওয়াজ ও তাফসির মাহফিলে কোনো নোট রাখতেন না। দলিল ও প্রমাণ দেয়ার সময় গ্রন্থের খণ্ড ও পৃষ্ঠা মুখস্থ উল্লেখ করে দর্শক শ্রোতাদের সম্মোহিত করে রাখতে পারতেন।
১৯৭০ সালে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন খালিদ মাহমুদ। ১৯৭৪ সালে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান পরিচালক হজরত আল্লামা মুহাম্মদ তৈয়ব সাহেবের পরামর্শক্রমে ম্যানচেস্টারে ইসলামিক একাডেমি স্থাপন করেন এবং আমৃত্যু এই একাডেমির পরিচালক হিসেবে নানা গবেষণাধর্মী খিদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন।

এটা মনে রাখা দরকার, একতরফা বা একপক্ষের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে আসল সত্য অনুদঘাটিত থেকে যায়। পক্ষ, বিপক্ষ ও প্রতিপক্ষের লিখিত গ্রন্থাবলি পাঠের আওতায় আনতে পারলেই আসল সত্য প্রকটিত এবং ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়। মরহুমের লিখিত গ্রন্থাবলি গতানুগতিক নয়; বরং অনুসন্ধানী, দলিলনির্ভর ও বিশ্লেষণধর্মী। প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে তিনি শালীনতা ও সৌজন্যবোধের সীমা অতিক্রম করেননি।

মরহুম মাহমুদের লিখিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫০। এর মধ্যে আছারুত তানজিল (২ খণ্ড), আছারুল হাদিস (২ খণ্ড), আছারুত তাশরিয়ী (২ খণ্ড), আছারুল ইহসান (২ খণ্ড), মুতালায়ে বেরলভিয়ত (৮ খণ্ড) ও খুলাফায়ে রাশেদীন (২ খণ্ড), তাজাল্লিয়াতে আফতাব, তাজাল্লিয়াতে সাদাকাত, দারসে কুরআন, আকিদাতুল উম্মত, মি’আরে সাহাবিয়ত, মাদারিকুল আযকিয়া ফি হায়াতিল আম্বিয়া, মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানি-আপনি আ’দাত পেশগুইউঁ আরো কিরদারকে আইনা মে, শাহ ইসমাঈল মুহাদ্দিসে দেহলভী, মুনাযেরে ওয়া মুবাহেছে, তাকিয়া না কিজিইয়ে, বারাআত হজরত থানভী, সহিহ বুখারি কি আখেরি হাদিছ কা দরস প্রভৃতি পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে।
এ ছাড়া মাওলানা আহমদ আলী লাহোরীর যুগে সাপ্তাহিক ‘খুদ্দামুদ্বীন’, তানযিমে আহলে সুন্নাহর মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘দাওয়াত’, শাহিওয়ালের জামিয়া রশিদিয়ার ‘আর রশিদ’, গুজরানওয়ালা থেকে প্রকাশিত ‘আল আদল’, মুলতান থেকে প্রকাশিত ‘আস সিদ্দিক’, দারুল উলুম দেওবন্দের মুখপত্র মাসিক ‘দারুল উলুম’ এবং মিসর থেকে প্রকাশিত ‘আয যাহারাতুল খালিজ’-এ নিয়মিত আল্লামা খালিদ মাহমুদের গবেষণাধর্মী নিবন্ধ ছাপা হতো।
তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও ইসলামের ইতিহাসে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও আধুনিক জ্ঞানের সমন্বয়ের কারণে ‘আল্লামা’ শব্দটি খালিদ মাহমুদের নামের অংশ হয়ে যায়। তিনি তার সময়কালে একজন তাত্ত্বিক বাগ্মী ও উলুমে ইসলামীর অথরিটি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: শেষনবী ও রাসূল এবং তাঁর পরে আর কোনো নবী ও রাসূল নেই। এই মহাসত্যটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি তাঁর জীবন যৌবন উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। মহানবী সা:-এর হাতে গড়া সাহাবায়ে কেরামের সংগ্রামী ও গৌরবময় জীবনের খুঁটিনাটি আলেখ্য শ্রোতা ও পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে অধিকতর প্রয়াসী ছিলেন। মর্যাদাবান সাহাবাদের যারা অযথা সমালোচনা করে, দোষত্রুটি চর্চা করে এবং ত্যাগ ও গৌরবগাথা এবং কর্মপ্রয়াসকে মিথ্যাচারে আড়াল করতে চায়, নির্ভরযোগ্য ইতিহাসের দলিল দিয়ে তাদের দাঁতভাঙা জবাব দিতে আল্লামা খালিদ মাহমুদের কৃতিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।
এটা মনে রাখা দরকার, একতরফা বা একপক্ষের ইতিহাস অধ্যয়ন করলে আসল সত্য অনুদঘাটিত থেকে যায়। পক্ষ, বিপক্ষ ও প্রতিপক্ষের লিখিত গ্রন্থাবলি পাঠের আওতায় আনতে পারলেই আসল সত্য প্রকটিত এবং ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়। মরহুমের লিখিত গ্রন্থাবলি গতানুগতিক নয়; বরং অনুসন্ধানী, দলিলনির্ভর ও বিশ্লেষণধর্মী। প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে তিনি শালীনতা ও সৌজন্যবোধের সীমা অতিক্রম করেননি।
ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন সরল, অনাড়ম্বর ও সদালাপী। সর্বদা আল্লাহ তায়ালার জিকিরে মশগুল থাকতেন। সারা জীবন তিনি সুন্নাতে রাসূলের পাবন্দ ছিলেন এবং তার অনুসারীদেরও পাবন্দ করার প্রয়াসী ছিলেন। রুটিনমাফিক জীবন পরিচালনায় ছিলেন অভ্যস্ত। দুনিয়াব্যাপী ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো ছিল তার মিশন। রাতদিন পঠন-পাঠন, অধ্যয়ন ও গ্রন্থ রচনায় ব্যাপৃত থাকতেন। দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশে দু’বার এসেছিলেন এবং চট্টগ্রামের পটিয়া আল জামিয়া আল ইসলামিয়ার বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। আমরা আল্লাহ তায়ালার দরবারে তার রূহের মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button