ব্রিটেনের প্রথম নওমুসলিম আবদুল্লাহ কুইলিয়ামের ইসলাম গ্রহণ

ড. ইকবাল কবীর মোহন: ব্রিটেনের প্রথম নওমুসলিম আবদুল্লাহ কুইলিয়াম। তিনি খ্রিষ্টান ধর্মবিশ্বাস থেকে ইসলামে প্রবেশ করেন। সেটি ১৮৮৭ সালের কথা। তার মূল নাম ছিল হেনরি কুইলিয়াম। ১৮৫৬ সালের ১০ এপ্রিল তিনি লিভারপুলের এলিয়ট স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা খ্রিষ্টধর্ম প্রচারক ছিলেন। পিতার মতো হেনরি কুইলিয়ামও একই ধ্যানধারণায় বেড়ে ওঠেন। হেনরি কিং উইলিয়ামস কলেজ থেকে আইন শাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। পেশায় তিনি ছিলেন একজন সলিসেটর। তিনি ডিফেন্স আইনজ্ঞ হিসেবে বেশি পরিচিতি লাভ করেন। কারণ, তিনি কয়েকটি খুনের মামলা পরিচালনা করেন। তখন ব্রিটেনে চলছিল মিত্যাচার (অ্যালকোহল বা মদপান বর্জন) আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল অ্যালকোহল জাতীয় খাবার বর্জন এবং অ্যালকোহলের বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। ১৯ শতকব্যাপী এবং ২০ শতকের শুরুর দিকে এই আন্দোলন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তিনি জানতে পারেন ইসলামে অ্যালকোহল নিষিদ্ধ। এই বিষয়টি তাকে ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে।

হেনরি কুইলিয়াম ১৮৮৭ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি তার স্বাস্থের খাতিরে আবহাওয়া পরিবর্তনের কথা ভেবে মরক্কো গমন করেন। মরক্কোতে হেনরি কুইলিয়াম মুসলমানদের ইসলামী আচার-অনুষ্ঠান গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন এবং তার মনে ইসলাম সম্পর্কে একটি সুন্দর ধারণা তৈরি হয়। সেখানকার একটি ঘটনা তার মনে গভীর রেখাপাত করে এবং তাকে ইসলামে প্রবেশ করতে অনুপ্রাণিত করে। একদিন তিনি একটি ফেরি ম্যাডেটিরিয়ান ঝড়ে আক্রান্ত হতে দেখতে পেলেন। তবে মজার ব্যাপার হলো, ফেরির মুসলমানরা প্রচণ্ড বাতাসের মধ্যেও নামাজ পড়ছিল। তিনি দেখতে পেলেন এই বিপদের মধ্যেও মুসলমানরা বিশ্বাস ও সততার দৃঢ়তায় ছিলেন অমলিন। এই অদ্ভুত অবস্থা দেখে হেনরি কুইলিয়াম এই ধর্ম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। পরিশেষে ৩১ বছর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং নতুন নাম ধারণ করেন আবদুল্লাহ কুইলিয়াম। হেনরি কুইলিয়াম নতুন ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, ‘ইসলাম একটি যুক্তিসম্মত এবং যৌক্তিক ধর্মবিশ্বাস। ইসলামের সাথে আমার বিশ্বাসের এর কোনো বিরোধ নেই।’
মরক্কো থেকে লিভারপুলে ফিরে এসে আবদুল্লাহ কুইলিয়াম তার পরিবারের মধ্যে ইসলামের কাজ শুরু করেন। ফলে তার মা ও তিন সন্তান ইসলামে দীক্ষিত হন। তিনি এবার নতুন বিশ্বাসের ভিত্তিতে পড়াশোনা শুরু করেন এবং ইসলামবিষয়ক বই লেখায় হাত দেন। অতি দ্রুত আবদুল্লাহ কুইলিয়াম ইসলাম প্রচারকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বেশ কয়েকটি ছোট পুস্তিকা রচনা করেন। ফলে অতি দ্রুত তার নাম মুসলিম বিশে^ ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, আবদুল্লাহ কুইলিয়াম তার এসব পুস্তিকার এক কপি রানী ভিক্টোরিয়াকে দেন। পুস্তিকার কপি পেয়ে রানী খুব উচ্ছ্বসিত হন এবং তার ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্য আরো কিছু কপি সংগ্রহ করেন।

ব্রিটেনে যেসব পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের লালন-পালনে অক্ষম হতেন আবদুল্লাহ কুইলিয়াম তাদের জন্য ‘মদিনা হাউজ’ নামে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ২০ জন সন্তান থাকা-খাওয়া ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তবে যেসব শিশু এখানে আনা হতো তারা মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠবে এ ধরনের শর্ত তিনি পিতা-মাতার কাছ থেকে লিখে নিতেন। আবদুল্লাহ কুইলিয়ামের নানামুখী ইসলামী কর্মকাণ্ড সারা দুনিয়ার মুসলমানদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়।

বলা আবশ্যক যে আবদুল্লাহ কুইলিয়াম লিভারপুলের ব্রুগহাম টেরাসিতে কয়েকটি সম্পত্তি ক্রয় করেন। আফগানিস্তানের ক্রাউন প্রিন্স নসরুল্লাহ খানও তাকে সম্পত্তি ক্রয়ে সহায়তা করেন। পরবর্তীকালে ৮ নম্বর ব্রুগহাম টেরাসির সম্পত্তিতে ১৮৮৯ সালে তিনি মসজিদ নির্মাণ করেন, যেটি লিভারপুলের প্রথম মসজিদ। এর নাম দেন লিভারপুল মুসলিম ইনস্টিটিউট। তা ছাড়া আবদুল্লাহ কুইলিয়াম একটি বালক ও একটি বালিকা বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি যে ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন, তার মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর চালিত শিক্ষা কর্মসূচিতে মুসলিম ছাড়াও অমুসলিমরা যোগদান করত। ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি আবদুল্লাহ কুইলিয়াম ব্যাপক সামাজিক কাজেও ব্যাপৃত হন। ব্রিটেনে যেসব পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের লালন-পালনে অক্ষম হতেন আবদুল্লাহ কুইলিয়াম তাদের জন্য ‘মদিনা হাউজ’ নামে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
এখানে ২০ জন সন্তান থাকা-খাওয়া ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তবে যেসব শিশু এখানে আনা হতো তারা মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠবে এ ধরনের শর্ত তিনি পিতা-মাতার কাছ থেকে লিখে নিতেন। আবদুল্লাহ কুইলিয়ামের নানামুখী ইসলামী কর্মকাণ্ড সারা দুনিয়ার মুসলমানদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়। ফলে বিভিন্ন দেশের অনেক গণ্যমান্য মুসলিম ব্যক্তিরা তার লিভারপুল মসজিদ পরিদর্শনে আসেন এবং তাকে নানা নাম ও উপাধিতে ভূষিত করেন। ২৬তম অটোমান খলিফা দ্বিতীয় আবদুল হামিদ আবদুল্লাহ কুইলিয়ামকে ‘শেখ আল-ইসলাম অব ব্রিটিশ ইসলিস’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আফগানিস্তানের আমির তাকে ‘শেখ অব মুসলিমস ইন ব্রিটেন’ উপাধি দেন। ইসলামী শিক্ষা বিস্তার এবং ইসলামের দাওয়াত দেশে বিদেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আবদুল্লাহ কুইলিয়াম ছোট ছোট পুস্তিকা রচনা এবং বিতরণ করেন। তা ছাড়া ‘দ্যা ক্রিসেন্ট’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেন।
ইসলাম প্রচারকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আবদুল্লাহ কুইলিয়াম ব্রিটেনের বিভিন্ন জায়গায় সফর করেন এবং তিনি সেখানে বক্তব্য রাখেন। তার নিরলস চেষ্টা ও প্রভাবে ব্রিটেনের অনেক নামকরা ব্যক্তি ইসলামে দীক্ষিত হন। এদের মধ্যে আছেন, প্রফেসর নাসরুল্লাহ ওয়ারেন, প্রফেসর হেশাম ওয়ালডি, স্টেলি ব্রিজের সাবেক মেয়র রিচার্ড পি. স্টানলি প্রমুখ। সবমিলে আবদুল্লাহ কুইলিয়ামের চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও সামগ্রিক দীনি কার্যক্রমের কারণে ব্রিটেনে প্রায় ছয় শত অমুসলিম ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে বলে এক রিপোর্টে জানা যায়। তবে তার এই প্রয়াস ব্রিটেনের সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি করে। ব্রিটেনের মিডিয়া এবং স্থানীয় সম্প্রদায় তার ব্যাপক কর্মযজ্ঞের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনায় নেমে পড়ে। এ সময় ১৯০৮ সালে তাকে বাধ্য হয়ে ব্রিটেন ছাড়তে হয় এবং এর ফলে তার আইন পেশাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তার ছেলে বিলাল আবদুল্লাহ কুইলিয়ামের নামে রেজিস্ট্রিকৃত মসজিদের সম্পত্তি এবং ইসলামিক সেন্টার বিক্রি করে দেন। অবশ্য পরে আবদুল্লাহ কুইলিয়াম আবার ব্রিটেনে ফিরে আসেন। তিনি ১৯৩২ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাকে ব্রুকফিল্ড কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রায় ১০০ বছর আগে আবদুল্লাহ কুইলিয়াম ইন্তেকাল করলেও তার ইসলাম প্রচারের কারণে ব্রিটেনে মুসলিম এবং ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। ব্রুগহাম টেরাসির সেই মসজিদ আজও তার স্মৃতি বহন করছে।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও সাবেক ডিএমডি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button