ব্রিটেনে আজ মুসলিম নারী হিসেবে আমি শঙ্কিত

Womenগত ১৫ বছর ধরে ব্রিটেনে আমি যা দেখে ও শুনে আসছি তাতে ভীষণ হতাশ। একটা সময় ছিল যখন লোকে প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করত আমি আল-কায়দা পন্থী কিনা; ৯/১১ এবং ৭/৭-এর হামলাকে আমি ভালো কাজ বলে মনে করি কিনা। তখন আমার বয়স ছিল বিশের ঘরের প্রথম দিকে। আমি মনে করতাম এগুলো জিজ্ঞেস করা রীতিমত আক্রমণাত্মক। তবে তারা আমাকে ঘৃণাজনক মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল ভাবার বদলে অন্তত জিজ্ঞেস করছে।
সময় গড়িয়েছে। এ পর্যন্ত কেউ আর আমাকে জিজ্ঞেস করেনি যে লি রিগবির হত্যাকান্ড (ব্রিটিশদের মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালনকারী তরুণ ব্রিটিশ সৈনিক লি রিগবিকে ২০১৩ সালের ২২ মে লন্ডনের রাস্তায় হত্যা করা হয়) ঠিক ছিল কিনা অথবা শার্লি এবদো বা বোকো হারাম বা বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে আমার ধারণা কী। আমার মনে হয়েছে এটা অগ্রগতি, তবে ব্যাপক অর্থে এটি অগ্রগতির অনুভূতি বোধক নয়।
আসল কথা হল, গত কয়েক বছর ধরে আমি ক্রমশই খারাপ অনুভব করছি। প্রতিবারই আমি যখন কোনো নিষ্ঠুরতার খবর শুনি ততোবারই খারাপ লাগে। প্রথমত সব সময়ই আতঙ্ক রয়েছে এবং আমার একান্ত আশা যে অপকর্মকারীরা নিজেদের মুসলমান দাবি করবে না। এ ধরনের আশা পোষণ করার জন্য আমি নিজেকে অপছন্দ করি, কিন্তু আমি জানি যে তারা যদি নিজেদের মুসলমান দাবি করে তার পাল্টা জবাব হবে মারাত্মক। তা আমাকে আতংকিত করে।
এর পর আমি মনে করি এ মুসলমান নামধারীদের কাছ থেকে ইসলামকে দূরে রাখা আমার কর্তব্য। এটা করার জন্য আমি নিজের উপর বিরক্ত, কিন্তু আমার ধর্মকে সহিংসতা মুক্ত রাখতে রাখতেই তা করা। নিজের ধর্মবিশ্বাস ও নিজেকে রক্ষা করতে করতে আমি ক্লান্ত। আমি কোনো অপরাধ করিনি।
যদিও বিভিন্ন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় আমি শংকিত, তারপরও যাদের নিরাপত্তা ও জীবন নির্মম সহিংসতার শিকার হয়েছে তাদের প্রতি আমার সংহতি রয়েছে। তবে আমার অবাক লাগে যখন অ-পাশ্চাত্য দেশে একই ধরনের সংঘটিত নিষ্ঠুরতায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। এটা আমাকে ক্রুদ্ধ করে, কিন্তু তারপর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি যে এ ক্রোধ উপলব্ধিযোগ্য ও সঠিক হলেও তা মারাত্মক ও বিভেদ সৃষ্টিকারী। আমার উপর এর প্রভাব নিয়েও আমি উদ্বিগ্ন।
প্যারিস হামলার পর থেকে আমি আমি আরো বেশি শংকিত হয়ে পড়েছি। এরপর ৩শ’ শতাংশ বেশি ইসলামভীতিজাত হামলা বেড়েছে। ফিনসব্যারি পার্ক মসজিদসহ বেশ কিছুসংখ্যক ইসলামী কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। এগুলো সরকারী পরিবহনে ইসলাম ভীতিজাত কটূক্তি ও শারীরিক হামলার ভিডিওর প্রেক্ষাপটের বিরুদ্ধে এবং উল্লেখ্য যে লোকেরা যখন এ ধরনের ছবি ধারণ করে খুশি হয় তখন কম সংখ্যক লোকই এতে হস্তক্ষেপ ও সাহায্য করে।
এরই মধ্যে গত সপ্তাহে সান পত্রিকার খবরের শিরোনাম প্রতি ৫ জন ব্রিটিশ মুসলিমের একজন জিহাদিদের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রশ্নবিদ্ধ গবেষণা ভিত্তিক আগুনে ইন্ধন যোগানো বিষয় যাতে মুসলিমদের নিরাপদ বোধ বা সমর্থন লাভের কিছু নেই। এটা অবশ্যই এ নয় যে প্রত্যেকেই আমাদের উপর আক্রমণোদ্যত, কিন্তু শংকিত হওয়ার অনুভূতির জন্য আমাদের দায়ী করা যাবে না।
আমি সামান্য এক মুসলিম নারী। সব জায়গায় যেতে আমি সরকারী পরিবহন ব্যবহার করি। আমি প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফিরি। আমি হিজাব পরি। আমি এক সহজ লক্ষ্যবস্তু। আমি একবারই মাত্র অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হয়েছিলাম। এক লোক আমাকে উদ্দেশ্য করে “যৌনকর্মের উপাদান” বলে মন্তব্য করে ও তারপর কোনো ঘটনা ছাড়াই স্থান ত্যাগ করে। এ ছাড়া আমি আর কখনো সমস্যায় পড়িনি। মনে পড়ে, ১৯৯৯ সালে বাসে একটি বালক আমাকে ‘পোশাক ঢাকা মাথা’ বলে মন্তব্য করেছিল। তবে আমরা তাতে কিছু মনে করিনি।
আসলে কখনো কখনো আমি ভেবে অবাক হই যে আমি কখনো গালাগালি বা মারধরের দুর্ভাগ্যের শিকার হইনি।
তবে এ সৌভাগ্য চিরস্থায়ী হতে পারে না। পারে কি? একদিন তা স্রেফ পালিয়ে যায়। যারা আমার মত লোক ও যারা আমার মত কথা বলে তারা প্রতিদিনই অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে, আমি হইনি। কিন্তু যদি কোনোদিন তা আমার সাথে ঘটে, তখন? আমার সন্দেহ আছে যে পূর্ণ ও খোলাখুলি ধর্মীয় আলোচনা দুর্ব্যবহারকারীদের নিরস্ত করতে পারবে। আমি যা বলতে যাচ্ছি আসলে আমি একজন মুক্তমনা, ধর্মনিরপেক্ষ শিয়া। ইসলামিক স্টেট আমাকে সম্ভবত আপনাদের চেয়ে বেশি ঘৃণা করে। তাহলে আমরা কি বন্ধু হতে পারি? তা কঠিন। আমি তাদের প্রতি পাল্টা মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করতে পারি না। সুতরাং আমাকে সেখানে বসে থাকতে হবে ও সহ্য করতে হবে।
আমি এ সব কথা লিখতে শংকা বোধ করি এবং যদি কোনোদিন তার চেয়েও হুমকিজনক পরিস্থিতি হয় তবে আমার হামলাকারীদের কারো সাথে লড়াই করার শারীরিক ক্ষমতা আমার নেই। আমি যদি দৌড়ে পালাইও তাহলেও বেশিদূর যেতে পারব না। আমার কোনো সম্ভাবনা থাকছে না।
আমি এখন যতটা আমার মুসলমানত্ব নিয়ে সচেতন জীবনে আর কোনো সময় তা ছিলাম না। আমি কখনোই শংকিত ছিলাম না। আমি সারা জীবন ব্রিটেনে বাস করে এসেছি, এটা আমার স্বদেশ, একে আমি ভালোবাসি। কিন্তু এখন আমি বিভিন্ন ব্যাপারে শংকিত যা কিছুকাল আগেও আমার জন্য অপ্রীতিকর ছিল না।
আমি লন্ডনের চারপাশে চলাফেরা করি, এটা আমার নিজের শহর, সার্বক্ষণিক উচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকি, কেউ আমার দিকে লক্ষ্য করছে কিনা বা পেছনে হেঁটে আসছে কিনা তা নিয়ে ভীষণ সতর্ক। গত বিশ বছর ধরে আমি হিজাব পরছি, তা কখনোই সমস্যা সৃষ্টি করেনি। কিন্ত প্রথমবারের মত গত ক’দিন ধরে হিজাব আর না পরার চিন্তা উঁকি দিচ্ছে। আমার তা করার কোনো ইচ্ছে নেই, কিন্তু এ পরিস্থিতি আসতে পারে। আমার পোশাক আমাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে, আর আমার একটি ক্ষুদ্র অংশ ভাবছে যে আমি মুসলিম এটা অস্বীকার করাই বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।
আমি ১০ বছর ধরে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করছি। এ সব রোগী হিংস্র, বিপজ্জনক ও বেপরোয়া অসুস্থ লোক। আমাকে ধর্ম নিয়ে কখনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। এখন আমি সেদিনের অপেক্ষা করছি যখন কোনো রোগী আমার সাথে কাজ করতে অস্বীকার করবে বা খারাপ আচরণ করবে, কারণ আমি একজন মুসলিম।
কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধ বলেছিলেন, মুসলিমরাই যে সব সময় শত্রু হবে তা নয়। একদিন অন্য কেউও শত্রু হতে পারে। একদিন এটা আলাদা কিছু হবে ও এটা সহজ হয়ে যাবে। সে সময় আমি তার কথায় সায় দিয়েছিলাম। তবে এখন আর তা বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি না যে পরিস্থিতি ভালো হবে, সেদিন আসবে- যেদিন আমার মত লোককে শত্রু ভাবা হবে না। আমি কেন? আমরা যে অবস্থায় আছি দেখুন। সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী কৌশল দেখুন, যাতে আমাদের সবাইকে সন্দেহভাজন করা হয়েছে।
এখন কী হবে? সংবাদ মাধ্যম ও রাজনীতিকদের কাছে অসম্মানিত, আমার জীবনযাপন পন্থাকে বিপজ্জনক বলা হচ্ছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থার নামে বিমান থেকে আমাকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে, আমার মত লোককে অবাঞ্ছিত বলা হচ্ছে। নিজেদের দেশে জীবন বিপন্ন হওয়ার কারণে আমার পরিবার এখানে এসেছিল। আমাকে কি সেখানে চলে যেতে হবে? আমি এভাবে কী করে বাস করব? আমাদের আর কেউই বা কীভাবে বাস করবে?
আপনার ক্ষেত্রে এ রকম না ঘটলে আপনি বাস্তবতাটা উপলব্ধি করতে পারবেন না। আপনি বুঝতে পারবেন না আমি কতটা অসহায় ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠি যখন আমার ১১ বছরের প্রতিভাবান, সংবেদনশীল, ভদ্র ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে তার অজ্ঞ স্কুল সাথীদের বর্ণবৈষম্য ও ইসলামভীতি জনিত মন্তব্যের শিকার হতে হয়।
আমার বোনের ছেলেমেয়েরা যে পৃথিবীতে বাস করতে যাচ্ছে সে পৃথিবী সম্পর্কে আমি শংকিত, তাদের জন্য শংকিত যারা ঘৃণা ছড়ানো ও আগ্রাসনকারী লোকদের দয়ায় রয়েছে। আমি আশা করি এ ক্ষেত্রে ইসলামিক স্টেটই একমাত্র শত্রু। দুঃখজনক হল, ইসলামিক স্টেট হচ্ছে স্রেফ হিমশৈলের অগ্রভাগ যা সংকুচিত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
-মাসুমা রহিমের লেখা এ নিবন্ধটি ১ ডিসেম্বর দি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হয়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button