জিএসপি ফিরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা

জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস) সুবিধা পুনরায় ফিরে পেতে বাংলাদেশকে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে। শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কয়েকটি কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে বলা হয়েছে শ্রমিক, অগ্নিকান্ড ও ভবন পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণ উন্নত করতে হবে। যারা নিরাপত্তার মানদন্ড লঙ্ঘন করবে তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ’স অফিস থেকে শুক্রবার এ ধরনের একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। ওই বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র আনন্দিত। পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করতে গত ২৭শে জুন ওবামা প্রশাসন বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এপি। বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকার নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকারের গড়িমসির কারণটি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। তবে জিএসপি সুবিধা বাতিলের সময়ও ওবামা প্রশাসন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে একটি কার্যপরিকল্পনার রূপরেখা দিয়েছিলেন। জিএসপি সুবিধা পুনরুদ্ধারে তা বাস্তবায়নের ওপর জোরও দেয়া হয়েছিল। শুক্রবার সেই কর্মপরিকল্পনাটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। ওই কর্ম-পরিকল্পনা অনুযায়ী, শ্রমিকদের অবস্থা, অগ্নিকান্ড ও ভবন পরিদর্শকের সংখ্যা বাড়াতে ও শ্রম আইনের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে সংশোধন ও পরিবর্তন আনতে হবে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের জন্য হটলাইন ব্যবস্থা চালু করা- যাতে তারা অগ্নিকান্ড বা ভবনে যে কোন ঝুঁকি কিংবা শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে পরিচয় গোপন করেই অবিলম্বে রিপোর্ট করতে পারে। এভাবেই আরও কয়েকটি পদক্ষেপের সঠিক বাস্তবায়নের ওপর জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশকে বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা (জিএসপি) ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যে সব কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে তাতে শ্রম, অগ্নি ও ভবনের মান নির্ধারণ বিষয়ক পরিদর্শক বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)’র সঙ্গে পরামর্শ করে যেসব টার্গেট পূরণে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ তা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। যারা শ্রমিক অধিকার, অগ্নি নিরাপত্তা ও ভবন মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা বাড়াতে হবে। অথবা অবরোধ আরোপ করতে হবে। এর মধ্যে আমদানি-রপ্তানি লাইসেন্স বাতিল করতে হবে। সব তৈরী পোশাকের কারখানা ও নিটওয়্যার কোম্পানিগুলোর ডাটাবেজ জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। যাতে তার শ্রমিক, অগ্নি ও ভবন পরিদর্শন সংক্রান্ত তথ্য মানুষ জানতে পারে। জানতে পারে ওই কোম্পানি কোথায় ও তারা কি ধরনের আইন লঙ্ঘন করছে। তাদেরকে কি জরিমানা করা হয়েছে অথবা তাদের বিরুদ্ধে কি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কোন কারখানাকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শ্রমিকদের স্বাধীনভাবে সমবেত হওয়া ও সমন্বিতভাবে দর কষাকষির সুবিধা যাতে পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে আইএলও’র সঙ্গে পরামর্শক্রমে।
এতে আরও বলা হয়েছে, যারা প্রশাসনিক নিয়মনীতি মেনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে তাদের ইউনিয়ন করার নিবন্ধন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। ইউনিয়নের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ইউনিয়ন করার কারণে কোন সদস্য যাতে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার বা প্রতিশোধের শিকার না হন তা নিশ্চিত করতে হবে। নিবন্ধনের জন্য যারা আবেদন করেছে তাদের অবস্থান ও চূড়ান্ত অবস্থা কি তা জনগণকে জানাতে হবে। প্রশাসনিক নিয়মনীতি মেনে এমন বেসরকারি সংস্থা যেমন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটি এবং সোশ্যাল একটিভিটি ফর দ্য এনভায়রনমেন্টকে নিবন্ধিত করতে হবে। শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা যদি মুলতবি অবস্থায় থাকে তাহলে তা হয়তো প্রত্যাহার করতে হবে না হয় তার সমাধান করতে হবে। যাতে শ্রমিক ও তাদের সমর্থনকারীরা কোন হয়রানি বা ভয়ভীতির সম্মুখীন না হন। শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকান্ডের একটি স্বচ্ছ তদন্ত করতে হবে। এ তদন্তের বিষয়ে রিপোর্ট করতে হবে। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় শ্রমিকের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে হবে। দেশের অন্য শ্রমিকদের মতো তারাও যেন ইউনিয়ন করতে পারে, সম্মিলিতভাবে দর কষাকষি করতে পারে সেরকম সমান অধিকার দিতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে একটি গভর্নমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ।
ওদিকে বিবিসি জানায়, বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অধিকার উন্নত করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু পদক্ষেপের যে কর্ম-পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিল তা তারা এখন প্রকাশ করেছে। এর উদ্দেশ্য, এর বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক মহলের অঙ্গীকারকে আরও জোরদার করা। মার্কিন সরকারের ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টিটিভস্ অফিস বা ইউএসটিআর দপ্তর, মার্কিন শ্রম দপ্তর এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে দেয়া যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের কারখানাগুলোয় নিরাপত্তার সমস্যা মোকাবিলার লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান এই কর্ম পরিকল্পনায় জানানো হয়েছে। মার্কিন বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের বাণিজ্য সুবিধা ফিরে পেতে এসব পদক্ষেপের বাস্তবায়ন জরুরি বলে বলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বিশদ এই কর্ম-পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সরকারকে কারখানাগুলোয় আরও ঘন ঘন অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ও ভবন পরিদর্শনের কাজ করতে এবং পরিদর্শকদের সংখ্যা বাড়াতে বলা হয়েছে। কারখানা পরিদর্শকদের প্রশিক্ষণের মান এবং পরিদর্শন যাতে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয় তা নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার আহ্বানও এই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। পদক্ষেপমালায় জরিমানার অঙ্ক বাড়ানো এবং অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে শ্রম আইন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বা পরিদর্শন পদ্ধতি মানা না হলে আমদানি-রপ্তানির লাইসেন্স বাতিলেরও সুপারিশ জানানো হয়েছে। ইউএসটিআরের এই বিবৃতিতে বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার এবং সংঘবদ্ধভাবে দর-কষাকষির প্রক্রিয়া নিয়ে যেসব উদ্বেগ আছে তা নিরসনে বাংলাদেশ সরকারকে শ্রম আইন সংস্কার ও তার বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে বাংলাদেশে ২০১২’র নভেম্বর মাসে তাজরীন ফ্যাশনস্-এর ভয়াবহ অগ্নিকান্ড এবং এবছরের এপ্রিল মাসে রানা প্লাজার মর্মান্তিক ভবন ধসের ঘটনার পর বাংলাদেশের কারখানাগুলোয় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রানা প্লাজা ধসে এগারো শ’র বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটি ২৭শে জুন সে দেশের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্ক মুক্ত প্রবেশের সুবিধা বা জিএসপি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। বাংলাদেশে শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তার অভাবের কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্ত নেয় এবং জানায় বাংলাদেশে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নত না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত থাকবে। মার্কিন সরকারের এই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, জিএসপি সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত এবং তা পর্যালোচনার শর্তাবলী নিয়ে তারা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছে এবং সে সময়ই তাদের এই কর্ম-পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের কারখানাগুলোয় শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সবগুলো সংশ্লিষ্ট পক্ষের সমর্থন আরও বেশি করে পেতে এবং এ লক্ষ্যে উদ্যোগ আরও জোরদার করতে মার্কিন সরকার এখন তাদের এই কর্ম-পরিকল্পনা প্রকাশ করলো বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button