আওয়ামী লীগ-জামায়াত আঁতাত !

মাসুদ মজুমদার
জামায়াত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় রাজনৈতিক আলোচনার প্রধান বিষয়। রায় বুঝে হরতাল জামায়াতের কর্মসূচির অংশ। আওয়ামী লীগের সুরে কথা না বললেই রাজাকার- স্বাধীনতার শত্রু। কথায় বা লেবাছে ইসলাম থাকলে তিনি মৌলবাদী কিংবা সন্ত্রাসী-জঙ্গি। আমাদের জাতীয় রাজনীতি এখানে এসে ঠেকেছে। অথচ এই বিপজ্জনক খেলা বন্ধ না হলে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সরকারি মোর্চা দাবি করে, হরতাল জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। জামায়াত জনগণকে অভিনন্দন জানায় হরতাল সফল করার জন্য। এক দিকে বলা হয় হরতাল হয় না, অন্য দিকে হরতালে বেশুমার ক্ষতির খতিয়ান তুলে ধরা হয়। তার পরও অনেকের ধারণা, সরকার জামায়াত নেতাদের গর্দানের বিনিময়ে রাজনৈতিক আপস বা সমঝোতা চাচ্ছে। এ ব্যাপারে একটি অদৃশ্য আঁতাতের মুখরোচক গল্প কিংবা কল্পকাহিনী বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সরকার অস্বীকার করছে। জামায়াত বলছে, প্রশ্নই আসে না। আসলে জামায়াত যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সরকার যে পর্যায়ে এসে আপাতত থেমেছে, তাতে আঁতাতের খবর যুক্তির ধোপে টেকে না। বিচার-আচারের নামে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে চায়। বিএনপি জোটে থাকাকে ‘ঔদ্ধত্য’ মনে করে। জামায়াত অবস্থান পরিবর্তন না করলে ভোটের রাজনীতির অঙ্ক মিলাতে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করার সব উপায় অবলম্বন করার পক্ষে। তারপরও জামায়াত সমঝোতার নামে জেনে বুঝে বিষপান না করারই কথা।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি সম্পর্কে আমজনতার ভাবনা, তারা যা বলে করে উল্টো। প্রচার-প্রপাগান্ডাকে তারা বেশি গুরুত্ব দেয়। তাই, কারণে-অকারণে মিথ্যার ফানুস উড়ায়, কল্পিত উন্নয়নের ডুগডুগি বাজায়।  আবার জামায়াত সম্পর্কে সাধারণের ধারণা, তারা কী চায় সবটা খুলে বলে না, যা বলে তা জনগণ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নেয় না। এ দু’টি দলকে যারা পছন্দ করে তারা শর্তহীনভাবে করে। যারা অপছন্দ করে তারা সেটাকে ঘৃণার স্তরে নিয়ে যায়। তাদের ব্যাপারে মাঝামাঝি কোন জায়গা সাধারণ মানুষের মনে কমই স্থান পায়। তাই এ দুই দলের আঁতাতের খবর সব সময় সন্দেহের দোলায় দোল খাবে। মজার ব্যাপার যে, অস্বস্তি এবং চাপ বাড়লেও আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারিকে পাশ কাটাতে জামায়াত ইস্যুকে সাফল্যের সাথে ব্যবহার করতে চেয়েছে। বন্ধুও পেয়েছে। কিন্তু জামায়াত একধরনের সহমর্মিতা ছাড়া তেমন কিছু পায়নি। এ ক্ষেত্রে তাদের উইন-উইন অবস্থান নেই। তাই আঁতাতের সম্ভাবনা বিশ্লেষকেরা উড়িয়ে দেয়ার পক্ষে।
মন্ত্রীরা মিথ্যা না বললে জামায়াত নিষিদ্ধের জন্য আইন প্রস্তুত। অনেক আইনজীবী বলছেন- আইন নয়, সরকারের ইচ্ছাপত্র তৈরি হচ্ছে। আমরা সরল অঙ্কের মতো একটা সত্য বুঝি- আইন করে মানুষের সংগঠন নিষিদ্ধ করা যায় না। নেতাদের হত্যা করেও দল নিঃশেষ করা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু নিজেই আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে বাকশাল করেছেন। তিনিও নেই। হামাগুড়ি দিয়ে প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। জামায়াত যে হারে সিম্প্যাথি পাচ্ছে তাতে তারা যে নাম পরিবর্তন করে ঘুরে দাঁড়াবে না সেটা কিভাবে বলা সম্ভব! অনেক দলনিরপেক্ষ মানুষ ভাবেন, জামায়াত নামের ট্রামকার্ডটি এবার সাঙ্গ হওয়াই ভালো। এই ট্রামকার্ড দিয়ে সরকার ও তাদের সহমতের বামপন্থীরা ইচ্ছেমতো অনৈতিক  ও নোংরা খেলা খেলেছেন। দাপুটে এই খেলা জামায়াতকে বন্ধুহীন করে দিয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ জামায়াতকে বুঝতে গিয়ে কিছুটা সহমর্মী যে  হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগ সব বামপন্থীকে এই ইস্যুতে সাথে পেয়েছে। অপরপক্ষে প্রকাশ্যে ও দৃশ্যমান বন্ধুহীন জামায়াত যে সিম্প্যাথি পেয়েছে সেটাই শেষ, রাজপথে এমনকি বক্তব্য-বিবৃতিতেও কাউকে সাথে পায়নি। জামায়াতপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবীকেও বলতে শুনেছি, জামায়াত নিষিদ্ধ হলে জামায়াতেরই লাভ। কারণ, জামায়াতও এই ইস্যুকে লায়াবিলিটিস ভাবছে, অ্যাসেট ভাবছে না। তবে জামায়াত নিষিদ্ধ হলে কেন লাভ, কিভাবে তারা লাভবান হবেন- সেটা শোনার আগ্রহ ও ধৈর্য অনেকেরই নেই। জামায়াতকে তালাবদ্ধ করার যে ইচ্ছাপত্র তৈরি হচ্ছে, তাতে অভিযুক্ত ছাড়াও জামায়াতের চেনা নেতাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করার একটা বিষয় থাকবে বলে শুনেছি। তাদেরকে কোনো দলে যোগ দেয়া ও রাজনীতি করার অধিকার বঞ্চিত করার একটা রাজতান্ত্রিক ফরমানের কথাও শোনা যায় । এখানেও রাজনীতির শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে কর্মীবহুল এমন একটি দল নিষিদ্ধ হলে সরকার কিভাবে লাভবান হবে এবং পরবর্তী পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নয়। জামায়াতের ঝুড়িতে নিষিদ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ ধরনের আদর্শিকভাবে উদ্দীপ্ত কোনো দল কখনো নিশ্চিহ্ন হওয়ার কথা নয়। সব পক্ষকে এই সত্যটি মগজে নিতে হবে।
জামায়াত মনে করে তাদের নিষিদ্ধ করার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ইস্যুটি একটি আমদানিকৃত ধারণা। সরকার উৎসাহের সাথে বাস্তবায়ন করছে রাজনৈতিক কারণে। বামপন্থীরা অতিউৎসাহ দেখাচ্ছে আদর্শিক কারণে- এমন ধারণা জামায়াতপন্থী এবং তাদের সব সুহৃদের। এ ধারণা খণ্ডন করেই আওয়ামী লীগ জেদের রাজনীতি করছে এবং কোণঠাসা জামায়াতের অবস্থানকে বিরোধী দলকে নাই করে দেয়ার সফল ফর্মুলা হিসেবে দেখছে। যদিও ফাঁসি নিয়ে তাদের অবস্থান বারবার বদলাতে বাধ্য হচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জামায়াত নেতাদের কাছে দোয়া চাওয়ার কথা স্মরণে রেখে এক সময় জামায়াত নেতারা ভাবতেও চাননি, শেখ হাসিনা তাদের বিচার করে গর্দানে রশি ঝুলিয়ে দেবেন এবং এটা করে তিনি আনন্দ পাবেন, এটাও ছিল জামায়াতের ধারণাতীত। তা ছাড়া ১৯৫ পাকিস্তানি চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে জামায়াত নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জাতিকে গ্লানিমুক্তির গান শোনাবেন, এটা জামায়াত কল্পনাও করেনি। ৫ জানুয়ারির আগের নির্বাচনে জিতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, জাতি তাকে বিজয়ী করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেই ফেলেছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনের পর জামায়াত নেতারা ধরেই নিয়েছিলেন ধর্মকর্মে বিশ্বাসী শেখ হাসিনা ধূম্রজাল সৃষ্টি করে রাজনীতি করবেন, জামায়াত ট্রামকার্ড খেলে রাজনীতি করবেন খোলামেলাভাবে। বামপন্থীদের ব্যবহার করবেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে, বাস্তবে ফাঁসি-জাতীয় শাস্তির মতো তেমন কিছু করবেন না। যখন নানা ছলছুতায় জামায়াত নেতাদের গ্রেফতার করা হচ্ছিল, অফিসে তালা ঝুলাচ্ছিল, যেখানে সেখানে জিহাদি বই ও জঙ্গি ধরার প্রচারণা চলছিল, তখনো জামায়াত নেতারা বলতেন, সরকার বিরোধী দল ও জোটকে ভয় পেয়ে নিরাপদে থাকার জন্য তাদের জেলে নিচ্ছে। হামলা-মামলাও করছে একই কারণে। এর মাধ্যমে সরকার জামায়াত ট্রামকার্ডও খেলছে, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ দমনের কথা বলে বিশ্বসম্প্রদায়কেও প্রবোধ দিচ্ছে। আওয়ামী লীগের দৃষ্টিতে বিরোধী দলকে দুর্বল করে রাখার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম ও যুৎসই ইস্যু আর নেই। সাধারণভাবে এক শ্রেণীর মানুষ এবং একসময় আওয়ামী লীগ করতেন এখন করেন না তারা মনে করেন, ভালো ও ভদ্রলোক আওয়ামী লীগ করে না। মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মনসুররা এই সময়ের উপমা। পেছনের ইতিহাস মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আমেনা বেগম পর্যন্ত বিস্তৃত। স্বাধীন দেশের কোনো মানুষ জামায়াত করতে পারে না, এমন ধারণাই নতুন প্রজন্মকে দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অথচ শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন তিনি নিজের ক্ষমতার স্বার্থে যেকোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারেন এবং কৌশল, কূটকচাল সব জানেন। বিশেষত কখন জামায়াতকে কখন বামপন্থীদের ব্যবহার করতে হবে সেটা তার জানা। প্রথম ক্ষমতায় এসে তিনি শুধু জানতে ও বুঝতে চেয়েছেন, ফাঁক ফোকর দেখে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। দ্বিতীয়বার সেসব নেতিবাচক-ইতিবাচক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছেন। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে আজদাহা হয়ে উঠেছেন। বেপরোয়া হয়ে আক্রমণভাগে খেলে ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থাকে আড়াল করতে মরিয়া হয়ে উঠছেন। এটা নাকি অপসহীনতা, স্মার্ট সরকার পরিচালনারও লক্ষণ। জামায়াতও শক্তি সঞ্চয় করেছে প্রতিকূল পরিবেশে। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের বিরুদ্ধে এত প্রচারণার পরও  তারা যদি শক্তি সঞ্চয় ও প্রভাব বলয় বাড়াতে পারে তারা নিষিদ্ধ হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন- এমন কথা যুক্তির ধোপে টিকে না। কর্মীবহুল দলটি অংশত ক্ষমতা চর্চায় শরিক হয়েছে সময়কে চ্যালেঞ্জ করেই। সেটা কতটা ক্ষমতাচর্চা, কতটা নয়; সে বিতর্ক অনেক দিন চলবে। সেটার লাভ-ক্ষতিও তাদের মিলিয়ে দেখতে হবে। গাড়িতে পতাকা বহনের ঝাঁজটা তেতো না অম্লমধুর সেটাও তাদেরই মূল্যায়নের বিষয়।
জামায়াত নেতারা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবেন না- এটা এখন স্পষ্ট। পৃথিবীর কোনো রাজনৈতিক নেতাই ক্ষমা চেয়ে দণ্ড মওকুফ করানোর ঐতিহ্য নেই। উপমাও কম। কারণ, দোষ স্বীকার করেই ক্ষমা চাইতে হয়। সেটা সরকারদলীয় পোষ্য তাহেরপুত্ররা পারেন। রাষ্ট্রপতিও দলীয় রাজনীতির কাছে পোষ মানেন। ততটা নতজানু হতে রাজনীতিবিদেরা পারেন না। এভাবে ক্ষমা ভিক্ষাকে তাদের রাজনৈতিক মৃত্যুরই শামিল মনে করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রচলিত ট্রাইব্যুনালকে জামায়াত সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ বলেছে। এর আইনকানুন, বিচারপ্রক্রিয়া, সাক্ষী-সাবুদ, বিচারক নিয়োগ সব কিছুতেই জামায়াত আপত্তি জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বারবার আন্তর্জাতিক মান রক্ষা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কথা বলেছে। অথচ সরকার কারো কথায় কান দেয়নি। গণ-আদালতের ধারায় একরোখাভাবে দেশজ আইনে গড়া ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক বলে চালিয়ে দিয়েছে। অথচ জামায়াত প্রচলিত আইন মেনে প্রসিকিউশনকে সাহায্য করেছে। আবার রায় না মানার কথাও বলেছে। গভীর ভাবনার বিষয় হচ্ছে, জামায়াত এই বিচারপ্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করেনি, আস্থায়ও নেয়নি, আবার বয়কটও করেনি। বরং প্রতিটি রায়কে ন্যায়ভ্রষ্ট ও জুডিশিয়াল কিলিং বলে অভিহিত করার চেষ্টা করেছে। আপিল করার সুযোগও নিয়েছে। এখানে একটি বড় জিজ্ঞাসা থেকে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, জামায়াত আল্লাহর আইন চায়, সৎ লোকের শাসন দাবি করে। বর্তমানে এ দুটো অনুপস্থিত বলেই তারা মনে করেন। তাহলে তারা জেনে-বুঝে এই বিষ পান না করলে কী হতো! একতরফা বিচারে সরকার নিয়োগ করা উকিল বিচারপ্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে যা হয়েছে তাই করত। তাতে বিবেকের মৃত্যু দেখে দেশবাসীও ুব্ধ হতো। প্রচলিত আইনে ক্ষমা না চাওয়ার দৃঢ়তা যদি নন্দিত বিষয় হয়, তাহলে বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রহসন বলার পর অংশ নেয়ার বিষয়টি মূল্যায়িত হবে না কেন? ইসলাম মৃত্যুদণ্ডে উৎসাহ দেয়নি। তবে হত্যার বদলায় হত্যাকেই অনুমোদন দেয়, যদি সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্তদের স্বজনেরা মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি দিতে না বলেন এবং ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা না দেন। এ ধরনের কুরআনিক আইনের রায় রদ করার এখতিয়ার রাজা-বাদশাহ-খলিফা, ইমাম, দেশনেতা ও রাষ্ট্রপতি কেউ রাখেন না। আমরা ও আমাদের রাষ্ট্র সেই জগতে নেই।
তা ছাড়া আওয়ামী লীগ বন্ধু নির্বাচনে অনেক পারদর্শী, দূরদর্শীও। আজ এমন লোকও মন্ত্রিসভায় আছেন, যারা বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজানোর কথা বলেছেন, সিআইএ-এর দালাল ছাড়া আওয়ামী লীগকে কখনো কথা বলতেন না। আওয়ামী লীগের বুর্জোয়া শ্রেণী চরিত্র নিয়ে নাকসিটকাতেন। অপর দিকে রাজনৈতিক মিত্র সন্ধানে জামায়াত দূরদর্শী কিন্তু আদর্শিক বন্ধুত্ব তারা কাক্সিত মাত্রায় চাননি। বরং শক্তি সঞ্চয় করার পর আদর্শিক বন্ধুদের এড়িয়ে চলার ভাব দেখিয়েছেন বলেই কোনো কোনো ইসলামপন্থী অনুযোগ করেন।
প্রচলিত আইনে বিচার প্রভাবিত করা সম্ভব। শাসকের ইচ্ছা পূরণ সহজ। দলীয়করণের মাধ্যমে ইচ্ছাপত্র ও মুসাবিদা করা রায় দেয়াও কঠিন কোনো কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, অ্যামনেস্টি, জাতিসঙ্ঘ প্রতিনিধি, হিউম্যান রাইট ওয়াচ, লর্ড কারলাইল, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আরো যেসব মানবাধিকার সংস্থা মৃত্যুদণ্ড বাতিলের নীতিগত অবস্থান নিয়েছে, সেটা যৌক্তিক নয়- এ দাবি এখন কেউ করতে পারেন না। রায় ফাঁস, সাক্ষী উধাও, স্কাইপ বিতর্ক, আইন পরিবর্তন, শাহবাগী উসকানি এবং মান বিতর্ক কখনো একটা রায়কে ত্রুটিমুক্ত রাখতে পারে না; তাহলে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের অভিযোগ খণ্ডন করা কিভাবে সম্ভব! তা ছাড়া এই বিচার-আচারে রাজনৈতিক মোটিভ কখনো লুকানো ছিল না। তাই কপালদোষে আজকের শাসকেরা যদি কোনো দিন এমন বিচারের মাধ্যমে অভিযুক্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ড পান, তা-ও নীতিগত কারণে বাতিল দাবি করা যুক্তিগত নয় বলা যাবে না। কারণ, রাজনীতি ও বিচারকে আমরা গুলিয়ে ফেলেছি বলেই প্রচুর অভিযোগ উঠেছে। তা ছাড়া সরকার ও তাদের বামপন্থী সুবিধাবাদী বন্ধুরা কোনো রাখ-ঢাক অবস্থান নেননি। তারা সময়মতো তত্ত্বীয় রাজনীতি ভুলে আপাতত শত্রুর শত্রুর বন্ধুর ভূমিকায়। এক ধরনের রোমাঞ্চকর হত্যা উৎসবকে দেশপ্রেমের কথা বলে চালিয়ে দিয়েছেন। এখনো দিচ্ছেন।
ইতিহাসে অসংখ্য নজির আছে ফাঁসির রশিতে ঝুলতে ঝুলতেও কেউ কেউ শক্ত ভাষায় প্রতিবাদ ও ক্ষোভের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। রায় শুনে আর্তচিৎকারও বিরল কোনো ঘটনা নয়। নাটক-সিনেমায়ও এমন গল্প দেখা যায়। তা-ছাড়া সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী সব ধর্ম তথা মুসলিম, খ্রিষ্টান,্ ইহুদি, হিন্দুসহ সব ধর্মীয় বিশ্বাসীদের নাম এই তালিকাভুক্ত করা সম্ভব। ফাঁসির রশি গলায় নিয়ে জন্ম-মৃত্যুর ফয়সালা জমিনে হয় না, আসমানে হয়- এমন দাবি করেছেন অনেক বরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রহসনের আদালতে ক’দিন আগে আরব বসন্তের সফল নায়ক মিসরের  বৈধ কিন্তু কারারুদ্ধ প্রেসিডেন্ট মুরসি বললেন, বিপ্লব থেকে একচুলও নড়বেন না। বঙ্গবন্ধুর মতো লোকও পাকিস্তানি দুর্বিনীত শাসকদের কবর খোঁড়া দেখে ভড়কে যাননি। প্রফুল্ল চাকি, তিতুমীর, ুধিরাম সবাই ফাঁসির রশি গলায় নিয়ে প্রতিবাদী ভাষা উচ্চারণ করে হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন। তাহলে যারা ভাবেন সৃষ্টিকর্তা প্রাণ দেন আবার তিনিই কেড়ে নেন, তার ইচ্ছার বাইরে একদণ্ড আগে কিংবা একমুহূর্ত পরেও মৃত্যু হওয়ার সুযোগ নেই; তারা এমন পরিস্থিতিতে ভড়কে যাবেন না, তা তো মনস্তত্ত্ব পড়ে বুঝতে হয় না।
এ কারণেই মীর কাসেম আলী আদালতে দাঁড়িয়ে রায় শুনে মন্তব্য করলে আমরা হকচকিত হই না। কর্নেল তাহের প্রতিবাদী চিঠি লিখে বরণীয় হয়ে আছেন- এমন ধারণা প্রচলিত আছে, অন্তত জাসদ তাই মনে করে। জামায়াতের সাথে প্রচুর রাজনৈতিক দ্বিমত করা সম্ভব। ’৫৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তাদের অসংখ্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে কিছু ভুল চিহ্নিত করা কোনো কঠিন কাজ নয়। একাত্তরে জামায়াতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে জামায়াত ডিফেন্সে যাওয়াটাই আত্মঘাতী। তবে ‘জামাতিরা মানুষ নয়’- এমন ধারণা কোনো মানবতাবাদীর নয়, এ জন্যই ইউরোপীয় ইউনিয়ন স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, তারা বিচারের বিপক্ষে অবস্থান নেয়নি, নীতিগত অবস্থান থেকে বিচারের মান নিশ্চিত করতে বলেছে, একই কারণে এমন ফাঁসি কার্যকর না করার পক্ষে। মৃত্যু শুধু অপরাধীকে তাড়া করে না। আদর্শবাদী এবং দেশপ্রেমিককেও তাড়া করে। তাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিচারকে যত দূর সাধ্য নির্ভুল ও ইনসাফ-নির্ভর করা সবার দাবি হওয়া উচিত। এই ঔচিত্যবোধ ভুলে গেলে প্রতিহিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে- সেটা প্রতিশোধস্পৃহাকেও ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। তা ছাড়া জুলুম-অত্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতনের মাধ্যমে যে প্রতিশোধমানস সৃষ্টি করা হয় সেটাকে সন্ত্রাস বা জঙ্গিপনা বলে অবদমিত করা কঠিন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button