সু চিকে চিনতে ভুল করেছে বিশ্ব

suchiঅং সান সু চির রাজনৈতিক দল ২০০৩ সালে যখন মিয়ানমারে ক্ষমতায় এলো, তখন সু চিকে ভাবা হতো একজন রাজনৈতিক আদর্শের কাণ্ডারি, যিনি ন্যায়ের ব্যাপারে আপসহীন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। নিজের জীবন হুমকির মুখে রেখে তিনি প্রায় একাই সামরিক জান্তার স্বৈরশাসনের কবল থেকে গণতন্ত্রের পথে টেনে এনেছেন মিয়ানমারকে। তার গ্রহণযোগ্যতা এত বেশি সার্বজনীন হয়ে দাঁড়ায় যে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন জনসম্মুখে তাকে শ্রদ্ধায় আলিঙ্গনাবদ্ধ করেন। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠদের নেতা মিচ ম্যাককনেল তাকে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করেন।
তবে সময়ের পরিক্রমায় শান্তিতে নোবেলজয়ী এই নেত্রী এখন ত্রাসের প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন। বর্তমান বিশ্বের নিন্দিত রাজনৈতিক নেতাদের কাতারে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘটিত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনে সে দেশের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নিপীড়নের পক্ষে কথা বলে নিজেকে প্রমাণ করেছেন একজন নির্দয়, নৃশংস মানুষ হিসেবে।
নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, যদিও সু চির এই প্রশংসার সিংহাসন থেকে নিন্দার আস্তাকুঁড়ে পতিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি একটি অভাবনীয় ঘটনা। তবে বিশ্ব ইতিহাসে এমনটি ব্যতিক্রম কিছু নয়। বিশ্ব এর আগেও প্রতিশ্রুতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের অভাবিত অবনমন দেখেছে। সংকটাপন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে উত্তরণের দ্রুত উপায় হিসেবে অনেক সময় জনপ্রিয় কিংবা ত্যাগী নেতাদেরকে ক্ষমতার আসনে আসীন করা হয় এই আশায় যে, তারা আতশবাজির মতো সবকিছু পাল্টে দেবেন। চারদিকে শুধু ধন্য ধন্য রব তুলে ভুলে যাওয়া কিংবা উপেক্ষা করা হয় তাদের মানবিক সীমাবদ্ধতা। সবাই যেন একটা অলৌকিক সমাধানের আশায় পথ চেয়ে থাকে। আদর্শ ভেবে বসা এসব নেতা যে ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নন, এটা পরে টের পেতে হয় মাশুল গুনে গুনে। কারণ একক আধিপত্যের ক্ষমতা পেয়ে ওইসব নেতার অনেকেই হাঁটেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ভুল পথে। হয়ে পড়েন আদর্শচ্যুত।
রাজনৈতিক নেতাদের আচরণ কিভাবে বিদেশি নীতিকে প্রভাবিত করে তার একটি তাৎপর্যবহ বিষয় নিয়ে বহুদিন গবেষণা করছেন বিশ্বখ্যাত কোলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল লুপটন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগই হয় রাজনৈতিক নেতাদের অতিরিক্ত ভক্তি দেখিয়ে দেবতার আসন দিই, নয়তো তাদেরকে ঘৃণা করে দানব ভেবে বসি।’ তিনি বলেন, ঠিক এভাবেই সু চিকে সবাই গ্রহণযোগ্য ভেবে নেয়ার ফলে, তার গ্রহণযোগ্য কাজগুলোর প্রতি আমাদের দৃষ্টি আবদ্ধ থেকেছে। তার অগ্রহণযোগ্য কাজগুলোতে দৃষ্টি যায়নি। ২০১৩ সালে বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে কেন রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ বেড়ে চলেছে, এই প্রশ্নটি সু চিকে করা হয়। জবাবে তিনি বলেন, কারণ একসময় রোহিঙ্গা মুসলমানরাও মিয়ানমারের বৌদ্ধদের সঙ্গে বিদ্বেষমূলক আচরণ করত! বিদ্বেষকামী সু চির ভেতরে যে শান্তিকামী সু চির সমাধি ঘটেছে। তখনই তা আমাদের টের পেয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা তা পাইনি। কারণ আমরা সু চিকে শান্তির দূতের চিরস্থায়ী তকমা এঁটে দিয়েছিলাম।
শান্তির ধারক ভেবে বসা শাসকদের স্বৈরাচারী শাসনকে রূপান্তরিত হওয়ার এমন অজস্র উদাহরণ রয়েছে। একসময় আফগানিস্তানের হামিদ কারজাইকেও শান্তির আলোকবর্তিকা ভাবা হয়েছিল। রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামি যখন ২০০৪ সালের গণহত্যা পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তায় ক্ষমতায় আসেন, তাকেও ভাবা হয়েছিল একজন শান্তির দূত। সুদানে ওমর হাসান আল বশীরকে উৎখাত করা বিদ্রোহী বাহিনীকেও ভাবা হয়েছিল শান্তির সমাধান হিসেবে। জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবেকে একসময় ত্রাণকর্তা ভাবা হয়েছিল। তিনি ধীরে ধীরে স্বৈরশাসকে রূপ নেন। সু চি হয়তোবা এখনই মুগাবে কিংবা কাগামির মতো ব্যর্থ নন, কিন্তু ক্ষমতার ২০ মাস অতিক্রম করার পর তার কর্মকাণ্ডে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, তিনি ব্যর্থতার পথেই হাঁটছেন। ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই তিনি সমাজকর্মী এবং সুশীল সমাজের একটা অংশ, যারা তাকে ক্ষমতায় যেতে সহায়তা করেছে, তাদেরকে তিনি রাজনৈতিক পটভূমি থেকে সরিয়ে দেন। তিনি শুধু তার কাছের লোকদের কথা শোনেন। বিপক্ষ মতধারীদের তিনি অকেজো করে দেন। সু চিকে একজন স্বৈরাচারী বলে অভিহিত করেছেন মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী ‘৮৮ জেনারেশন’ গ্রুপের নেতা ইউ ইয়ান মায় থেইন। যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সু চির তুমুল প্রশংসা হচ্ছিল, সে সময়ে মিয়ানমারের মানুষ, বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলমানরা এক অন্য দৃশ্য দেখে। তারা দেখতে পায়, সু চির ক্ষমতা কুক্ষিগত করার নিমিত্তে শুরু করা নিপীড়নের বৃদ্ধি। মিয়ানমারের খ্যাতিমান সুশীল সমাজ দলের নেতা কোয়াই থু বলেন, যদিও সু চি ও তার ক্ষমতাশীল সরকার নিজেদের গণতন্ত্রের একনিষ্ঠ ধারক মনে করে, আসলে তারা শুধু ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টায় রত।
তাদের মূল উদ্দেশ্য গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা নয়। সু চির প্রতিষ্ঠিত আইন মতে, যারাই তার রাজনৈতিক বিরোধিতা করবে, তারাই দেশের শত্রু। তাদেরকেই জেলে পাঠানো হয়। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির লয়ি ইন্সটিটিউটের বিশ্লেষক অ্যারন কনেলি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু বাদ দিলেও সু চিকে একজন উদার রাজনীতিবিদ বলা যায় না।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button