দ্বন্দ্বের জেরে বন্ধের মুখে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ

United Airপরিচালনা পর্ষদের কোন্দলে কার্যক্রম বন্ধ হতে চলেছে বেসরকারি উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বিডি লিমিটেডের। কোন্দলের জেরে পদত্যাগ করেছেন এয়ারলাইন্সটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী।
অন্যদিকে, নতুন পরিচালনা পর্ষদের অধীনে কাজ করতে অসম্মতি জানিয়েছেন বৈমানিক, ইঞ্জিনিয়ারসহ এয়ারলাইন্সটির অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা মঙ্গলবার রাত থেকে কর্মবিরতি শুরু করেছেন।
চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদত্যাগের এক দিনের মাথায় সব ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দিল ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ।
গতকাল বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পরিচালনার অর্থ না থাকায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ২০০৫ সালে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে বিমান পরিচালনা করার লাইসেন্স দেয়। তার দুই বছর পর যাত্রী পরিবহন শুরু করে সংস্থাটি।
মঙ্গলবার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী পদত্যাগ করলে নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয় মোহাম্মদ মাহাতাবুর রহমানকে। তার একদিনের মাথায় সংবাদ সম্মেলন করে ফ্লাইট বন্ধ করার ঘোষণা দিল সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন্স) ক্যাপ্টেন এম ইলিয়াস বলেন, ফ্লাইট পরিচালনা করতে যে খরচ হয় এই মুহূর্তে সেই খরচ নির্বাহের অর্থ ইউনাইটেডের নেই। এই অবস্থায় ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষহীন অবস্থায় রয়েছে।
এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় এক হাজার কর্মচারীর ভবিষ্যত্ও অনিশ্চয়তায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এই বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক এসএম নাজমুল আনাম বলেন, সমস্যাটি মূলত ইউনাইটেডের কর্মী ও ম্যানেজমেন্টের। আমরা তাদের বলেছি, তারা চাইলে ফ্লাইট চালাতে পারে।
বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি কয়েক দফা সময় বেঁধে দেয় ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে। তারপরও তা পরিশোধ না করায় প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স বাতিলেরও হুমকি দেয়া হয়।
ইউনাইটেডের বহরে রয়েছে একটি ড্যাশ-৮, তিনটি এটিআর-৭২, পাঁচটি এমডি-৮৩ এবং দুটি এয়ারবাস-৩১০-সহ মোট ১১টি উড়োজাহাজ।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এয়ারলাইন্সের আয়-ব্যয় নিয়ে কয়েক মাস ধরে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এর জের ধরে গত সোমবার অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে সদস্যরা তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডতায় জড়িয়ে পড়েন।
বৈঠকের এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়ার ঘোষণা দেন তিনি। ওইদিনই পরিচালনা পর্ষদের কাছে পদত্যাগপত্রও জমা দেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই বিমান সংস্থার এমডি তাসবিরুল আহমেদের পদত্যাগের বিষয়টি মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে নোটিসের মাধমে জানানো হয়।
এতে বলা হয়, চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বিডি লিমিটেডের ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী। নতুন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মোহাম্মদ মাহাতাবুর রহমানকে। আর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন শাহিনুর আলম। অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার ফেরদৌস ইমামকে দেয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব।
এ বিষয়ে ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকের পরই পদত্যাগ করেছি। সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছা আপাতত নেই।’
তিনি বলেন, ‘নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মিলে ৬০ হাজারের বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে। পরিচালকরা মনে করছেন, আমাকে ছাড়া ইউনাইটেডকে আরো ভালোভাবে চালানো সম্ভব। এসব কারণেই প্রতিষ্ঠানটি তাদের ওপর ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এদিকে, তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীর পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে। মঙ্গলবার রাতেই অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে যান এয়ারলাইন্সটির বৈমানিকরা।
পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ার, গ্রাউন্ড স্টাফসহ এয়ারলাইন্সটির বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ২০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারীও চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে এয়ারলাইন্সটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের পরিচালক উইং কমান্ডার এসএম নাজমুল আনাম বলেন, ‘ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের বৈমানিকরা কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন এমন খরব শুনেছি। তবে এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিনা তা বলার সময় এখনো আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘এয়ারলাইন্স বন্ধ হোক, এটা বেবিচক কখনই চায় না। তবে পুরনো পর্ষদের অধীনে হোক আর নতুন পর্ষদের অধীনে হোক, ইউনাইটেডকে অবশ্যই কমপ্লায়েন্সের মধ্যে থেকেই কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।’
উল্লেখ্য, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের সংকট প্রায় দুই বছরের। এ বছর তা ধরে প্রকট আকার ধারণ করছে। পুরনো উড়োজাহাজ ব্যবহারের কারণে জ্বালানি খরচ বেশি হওয়ায় ও বিলম্বিত কর আমলে নেয়ার পর থেকেই মুনাফা কমে গেছে প্রতিষ্ঠানটির।
এর আগে পুঁজিবাজার থেকে রাইট শেয়ার ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করে কোম্পানিটি। সে অর্থে উড়োজাহাজ কেনা হলেও প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বরং তুলনামূলক বেশি দামে উড়োজাহাজ কেনার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির তত্কালীন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে।
আর আর্থিক সংকট কাটাতে সরকারের হস্তক্ষেপও চেয়েছে কোম্পানিটি। নতুন করে রাইট শেয়ার ছেড়ে মূলধন সংগ্রহের জন্য ন্যূনতম শেয়ার ধারণসংক্রান্ত সিকিউরিটিজ আইন থেকে অব্যাহতিও চেয়েছে একাধিকবার।
এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেবিচকের কাছেও বিপুল অঙ্কের বকেয়া রয়েছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের। এয়ার নেভিগেশন, ওভার ফ্লাইং এবং অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল বিল বাবদ এয়ারলাইন্সটির কাছে বেবিচকের পাওনা প্রায় শতকোটি টাকা।
পাওনা আদায়ে এক সময় এয়ারলাইন্সটির লাইসেন্স নবায়নে অস্বীকৃতি জানায় বেবিচক। পরবর্তীতে সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে ২৭ আগস্ট ১০ মাসের জন্য ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের এয়ার অপারেটর সার্টিফিকেট (এওসি) বা উড্ডয়ন অনুমতি নবায়ন করে বেবিচক।
২০১২ সালে ডিএসইর কাছে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরীর কাছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের শেয়ার রয়েছে ৬৫ লাখ ৯৪ হাজার ৫২২টি। তার স্ত্রী খন্দকার তাসলিমা চৌধুরীর শেয়ার ১৪ লাখ ৮৩ হাজার। এর বাইরে তাদের মালিকানাধীন টিএসি এভিয়েশন লিমিটেডের কাছে ইউনাইটেড এয়ারের আরো ৯১ লাখ ৮১ হাজার শেয়ার রয়েছে।
বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহাতাবুর রহমানের কাছে রয়েছে ৮১ লাখ ৯৬ হাজার ৫০০টি শেয়ার। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহিনুর আলমের কাছে প্রতিষ্ঠানটির ৮৩ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার রয়েছে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালক হতে হলে নিজ কোম্পানির ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এতে ইউনাইটেড এয়ারের ১ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার ১৬০টি শেয়ার থাকলে পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়া যাবে। তবে বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের কেউই ন্যূনতম শেয়ার ধারণ করছেন না।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button