সাহিত্যের পুরস্কার যখন অসাহিত্যিকের হাতে

সায়ীদ আবুবকর: ২০১৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেলেন বেলারুশের সাংবাদিক-লেখিকা সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ। পেশায় সাংবাদিক এই লেখিকা সাহিত্যের মূল স্রোতে অবগাহন না করলেও তাকেই দেয়া হয়েছে এ বছরের সবচেয়ে বড় সাহিত্যপুরস্কার নোবেল প্রাইজ। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ১১২তম লেখক হিসাবে তার নাম ঘোষণা করে সুইডিশ একাডেমির প্রধান সারা দানিউস বলেন, “আলেক্সিয়েভিচ তার অনন্যসাধারণ লেখনি শৈলীর মাধ্যমে সতর্কভাবে বাছাই করা কিছু কণ্ঠের যে কোলাজ রচনা করেছেন, তা পুরো একটি যুগ সম্পর্কে আমাদের বোধের জগৎকে নিয়ে গেছে আরও গভীরে।” সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচের চল্লিশ বছর কেটেছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার পরের সময়ের অসংখ্য মানুষের জীবন কাহিনী শুনে। তবে তার গদ্য কেবল ইতিহাসকে তুলে ধরেনি, ধারণ করেছে মানুষের আবেগের ইতিহাস। প্রায় অর্ধশতক পর এমন একজনকে এই পুরস্কার দেয়া হলো, যিনি মূলত ‘নন-ফিকশন’ লেখক।
সভেতলানার জন্ম ১৯৪১ সালের ৩১মে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ইউক্রেনের স্তানিস্তাভিভে। জাতিতে তিনি একজন বেলারাশিয়ান। লেখালেখি করেন রাশিয়ান ভাষায়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া তিনিই বেলারুশের একমাত্র লেখক। তাঁর পিতা ছিলেন একজন বেলারাশিয়ান, মাতা ইউক্রেনিয়ান। ইউক্রেনে জন্ম হলেও তিনি বেড়ে ওঠেন বেলারুশে। স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে তিনি লোকাল কয়েকটি নিউজপেপারে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন। বেলারাশিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৭২ সালে। ১৯৭৬ সালে তিনি মিন্স্ক-এর সাহিত্যপত্রিকা নিম্যানে প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করা শুরু করেন।
এরপর তিনি আত্মনিয়োগ করেন সাংবাদিক হিসেবে তার ক্যারিয়ার গড়ার সংগ্রামে। তিনি সাক্ষাতকারের মাধ্যমে প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে সংগ্রহ করতে থাকেন তার দেশের নাটকীয় ঘটনাবলির তথ্য-উপাত্ত। এভাবে তিনি রচনা করে চলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও চেরনোবিল বিপর্যয়ের জীবন্ত ইতিহাস।
৬৭ বছর বয়সী সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ হলেন চতুর্দশ নারী, যিনি সাহিত্যে নোবেল পেলেন। নিজের দেশে আলেক্সিয়েভিচ পরিচিত সরকারের একজন সমালোচক হিসেবে। আর তিনিই প্রথম সাংবাদিক, যিনি সাহিত্যের সবচেয়ে সম্মানজনক এই পুরস্কার পেলেন। এই লেখিকা এ মনুমেন্ট টু সাফারিং এন্ড কারেজ ইন আওয়ার টাইম বইয়ের জন্য এ পুরস্কার পেয়েছেন।পুরস্কারের অর্থমূল্য আট মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার বা নয় লাখ ৫০ হাজার ইউএস ডলার। চেরনোবিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে লেখা বইয়ের মাধ্যমেই আলেক্সিয়েভিচ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত অর্জন করেন। এই দুই ঘটনার ভয়াবহতা তিনি প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন আবেগঘন ভাষায়। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার বইগুলো ।
২০১৫ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের দৌড়ে এগিয়েছিলেন জাপানের কথাসাহিত্যিক হারুকি মোরাকামি, কেনিয়ান ঔপন্যাসিক নগুগি ওয়া থিওয়াংগো, নরওয়ের ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার জন ফোসে, আমেরিকার জয়েস ক্যারোল ওয়াটেস ও ফিলিপ রথ। সিরিয়ার কবি এডোনিস নোবেল প্রাইজ পাচ্ছেন এরকম গুঞ্জরন আমরা শুনে আসছি বহু বছর ধরে। কিন্তু সব গুঞ্জরন নিস্তব্ধ করে দিয়ে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার  ছিনিয়ে নিলেন সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ।
নোবেল প্রাইজ পাননি লিও টলস্টয় ও আন্তন চেখভের মতো কালজয়ী লেখকেরা। নজরুলের মতো অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিপ্লবী ও মানবতাবাদী কবিও রয়ে গেছেন নোবেল কমিটির নলেজের বাইরে। অথচ এমন সব কবি-সাহিত্যিককেও নোবেল প্রাইজ দিতে দেখা গেছে যাদের সাহিত্যমূল্য নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না। সাহিত্যের অঙ্গনে কাজই করেননি কখনও, এমন কাউকে কাউকে দেখা গেছে এমন একটি মূল্যবান সাহিত্যপুরস্কার পেতে। সভেতলানা আলেক্সিয়েভিচ-এর নোবেল প্রাইজ পাওয়ার মূল কারণ হয়তো তার লেখার মধ্যে সোভিয়েত সরকারের বিরোধিতা। তিনি যখন তার রাজনৈতিক সমালোচনামূলক গ্রন্থ ‘দ্য আনওম্যানলি ফেস অব দ্য ওয়ার’ রচনা করা শেষ করেন ১৯৮৩ সালে, তখন তাকে অভিযুক্ত করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের মহীয়সী রমণীদেরকে মর্যাদাহীন করে উপস্থাপন করার অভিযোগে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে মিখাইল গরভাচেভ ক্ষমতায় আসার পর, যারই হাতে মূলত ধসে পড়ে সমাজতন্ত্রের গৌরবস্তম্ভ। ইউরোপ সবসময় স্বাগত জানিয়েছে তাদেরকে যারা সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হয়েছে কিংবা তাদেরই পক্ষ নিয়ে লড়াই করেছে তাদের যেকোনো অপছন্দের মতাদর্শের বিরুদ্ধে। হাল আমলে নোবেল প্রাইজ পাওয়া চীনা লেখক মো ইয়ানের কথা বলি কিংবা ঝাউ জিয়াঙের কথা বলি, বিষয়টি যে সাহিত্যের নয় মোটেও, স্রেফ রাজনৈতিক ও আদর্শিক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button