শরণার্থী সমস্যায় বিপর্যস্ত বিশ্ব

USAকাঁটাতারের বেড়া। গনগনে সূর্য। বেড়ার এক দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছেন বেশকিছু সৈনিক। অন্যদিকে, কাতারে কাতারে মানুষ। শিশু-কোলে মা। ক্লান্ত প্রবীণ। উদ্বিগ্ন পরিবার। সঙ্গে যৎসামান্য জিনিসপত্র। তাড়াহুড়োয় যতটুকু আনা যায় আর কী! প্রায় সকলেই ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় কাতর। বার বার গেট খুলে দেওয়ার জন্য কাতর অনুরোধ। কর্ণপাত করছেন না সৈনিকেরা। বেলা আরও বাড়লে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল মানুষগুলোর। চাপে ভেঙে গেল গেট। পিল পিল করে ঘরছাড়া সিরিয়ানরা ঢুকে পড়ল তুরস্কে। সেভাবে বাধা দেয়নি তুরস্ক-সেনা। এই সৌভাগ্য অবশ্য সবার জোটে না। জলকামান থেকে বুলেট- ভাগ্যে এ সবই জুটেছে। তবুও দেশান্তর হওয়ার থামেনি, গোটা বিশ্বজুড়েই। এ সময়ে এ বিশ্বে প্রায় ছয় কোটি মানুষ শরণার্থী। এই সংখ্যা পাওয়া গিয়েছে ‘ইউনাইটেড নেশন হাইকমিশন ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর)’-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট-এ।
এই ছ’কোটির মধ্যেই আছেন নাসিফা। বাড়ি সিরিয়ার আলেপ্পোয়। প্রেসিডেন্ট আসাদের সেনার আক্রমণে পরিবারের সবাই মৃত। পালিয়ে বিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চলে আসেন নাসিফা। কিন্তু, সেই অঞ্চল ইসলামী স্টেটের দখলে চলে গেল। ‘যৌন ক্রীতদাসী’ হওয়া থেকে বাঁচতে আবার ছুট। অবশেষে ঠাঁই মিলল তুরস্কে। সেখানেও একা মেয়ের নানা ভয় নিয়ে বাস।
নাসিফার মতো সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেই ঘর ছেড়েছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সমস্যা। শরণার্থীরা ছড়িয়ে গিয়েছেন তুরস্ক, লেবানন, জর্দানে। আর এক দল, প্রাণের বাজি ধরে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছে। তাদের গন্তব্য ইতালি। ছোট নৌকোয়, গাদাগাদি করে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে কোনোক্রমে ইতালিতে ঢোকার চেষ্টা। লাগাতার দুর্ঘটনা। ২০১৪-তে শুধু নৌকাডুবিতে প্রাণ গিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের। এ বছর এখনই সংখ্যাটা ১৮৬৫।
শঙ্কিত সরকারি, বেসরকারি ত্রাণ সংস্থাগুলি। শরণার্থী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে তুরস্ক, জর্দান, লেবানন। সমস্যায় আছে ইতালিও। শুধু বসবাসের সামান্য ব্যবস্থাটুকু করতেই যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তা জোগাড় করাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আর অদ্ভুতভাবে উদাসীন ধনী দেশগুলো। তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি শরণার্থীর বাস। নতুন চার জন শরণার্থীর মধ্যে এক জন ঢুকে পড়ছেন কেনিয়া, ইথিওপিয়ার মতো গরিব দেশেও। আমেরিকা প্রতি বছর ৭০,০০০ মানুষকে আশ্রয় দেয়। এ বছর প্রায় ২০০০ সিরিয়ার শরণার্থী আমেরিকায় আশ্রয় পাবে। কিন্তু সে তো সিন্ধু মাঝে বিন্দু বারি। সাহায্য দূর অস্ত, সীমান্তে কড়াকড়ি বাড়িয়ে দিয়েছে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড। সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে নৌকাগুলোকে পানিসীমায় প্রবেশের অনুমতিই দেয়নি টনি অ্যাবোটের সরকার। অভিযোগ উঠেছে, নৌকা অন্যত্র নিয়ে যেতে মালিকদের অর্থও দিয়েছে অস্ট্রেলীয় সরকার।
আর্থিক সঙ্কট, বেকারি, অনুন্নয়ন- হাজারো সমস্যায় এই দেশগুলোর প্রাণ ওষ্ঠাগত। তার উপরে শরণার্থীর চাপ। চাপে নাগরিক পরিষেবাও প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। তৈরি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। শরণার্থীদের সঙ্গে বাসিন্দাদের মিলমিশ হচ্ছে না। বিষিয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক। অচ্ছুত হতে হতে অপরাধ জগতে, যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছেন অনেক শরণার্থী।  কিন্তু সে ভাবে সাহায্য মিলছে না।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মতো মানবাধিকার সংস্থা ধনী দেশগুলির বিরুদ্ধে সরাসরি অবহেলার অভিযোগও তুলছে। শরণার্থীদের সুব্যবস্থা করার বদলে রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসেবেই এই সব দেশ ব্যস্ত রয়েছে। চলছে একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর পালা।
আর এই ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’-এ বিপদে পড়েছে ইতালির মতো দেশ। ‘গডফাদার’ খ্যাত সিসিলি দ্বীপ মনে আছে। সেখানে এখন গেলে দেখবেন বন্দরে সার দিয়ে পড়ে আছে অসংখ্য পরিত্যক্ত নৌকা। এগুলি চেপেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে শরণার্থী আসেন ইতালিতে। ক্ষুধা, তৃষ্ণাদীর্ণ সে বড় কঠিন যাত্রা। পথে অসুস্থ হলে সাগরেই শেষ আশ্রয়। তার পরে নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ এড়িয়ে কোনো ক্রমে ইতালি ঢোকা। এভাবে এ বছরে ঢুকেছেন প্রায় ৫৭ হাজার শরণার্থী। গত বছর সংখ্যাটি ছিল ৫৪ হাজার।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-এর ‘ডাবলিন কনভেনশন’ অনুযায়ী শরণার্থীরা যে দেশে প্রথম আসবেন সেখানেই প্রথম বাসের আবেদন করবেন। ফলে ইতালির হাত-পা বাঁধা। তার উপরে এত দিন শরণার্থীদের বড় অংশ ইউরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ত। ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড কড়াকড়ি শুরু করায় সে রাস্তা বন্ধ। কোনোক্রমে এ সব দেশে ঢুকতে পারলেও, পাকড়াও হলেই আবার ইতালিতে ফেরত। অবস্থা এমনই যে শরণার্থীদের চাপে রোম আর মিলানের স্টেশনে পরিষেবায় সমস্যা হচ্ছে। তড়িঘড়ি গুদামঘর খুলে থাকার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকে।
অনেক জোরাজুরির পরে ঠিক হয়েছে ২৪ হাজার শরণার্থীকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। কিন্তু, কে কত ভাগ নেবে তা এখনও ঠিক হয়নি। সস্তার শ্রমিকদের কারাই বা নিতে চাইবে? তা ছাড়া পড়ে থাকা শরণার্থীদের চাপও ইতালির পক্ষে সামলানো কঠিন। সাহায্য না পেয়ে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। ডাবলিন কনভেনশন বদলেরও দাবি তুলেছে ইতালি। প্রায় একই সমস্যায় ভুগছে গ্রিসও। সেখানে চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে শরণার্থীদের চাপ যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া।
পুরো বিষয়টির মধ্যেই গোড়ায় গলদ আছে। ইউরোপে নয়, ব্যবস্থা নিতে হবে লিবিয়া, তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তানেই। ব্যবস্থা নিতে হবে সংঘর্ষপীড়িত অঞ্চলগুলিতে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকেই সে কথাই বোঝানোর চেষ্টা করছে ইতালির সরকার। পাশাপাশি ভূমধ্যসাগরে মানুষ চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ন্যাটোকেও অনুরোধ করা হচ্ছে। কিন্তু, সবই তো আলোচনার স্তরে। আগের সংঘর্ষগুলিই থামেনি। তার উপরে এ বছরে প্রায় ১৫টি নতুন জায়গায় সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। ২০১৪-এ ঘর ছেড়েছেন প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ মানুষ। ঘরে ফিরেছেন ১ লাখ ২৭ হাজার। যা ৩১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। উন্নত বিশ্ব এভাবে উদাসীন থাকলে পরবাস থেকে পরিত্রাণ স্বপ্নই হয়ে থাকবে। -নতুন বার্তা

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button