বিশেষ প্রতিবেদন

উদ্দেশ্যবিহীন যাত্রায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী

Ruhingaবিশ্বে জাতিগতভাবে নির্মম নির্যাতিতদের মধ্যে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী অন্যতম। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর এখন পর্যন্ত হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাধ্য হয়েছেন লক্ষ্যহীন সমুদ্রযাত্রায়। চারদিকেই যখন শত্রু, তখন বিশাল সমুদ্রের বুকেই তারা খুঁজেছেন একটু আশ্রয়। উদ্দেশ্যবিহীন এই যাত্রায় নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে আন্দামান সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছেন প্রতিবেশী দেশগুলোতে। অথচ তাদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েই কিছু থাই নৌ ও পুলিশ কর্মকর্তা তাদের বিক্রি করে দেন আদম ব্যবসায়ীদের কাছে।
মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার অনেক রোহিঙ্গাই জীবন বাঁচাতে ছোট নৌকা নিয়ে ছুটেছেন থাইল্যান্ডের দিকে। কিন্তু তাদের নৌকা যখন থাইল্যান্ডের সমুদ্রতীরে পৌছে, তখন তাদের সাহায্য করার বদলে মানব পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে কিছু থাই নৌ ও পুলিশ সদস্য। তারপর এই পাচারকারী দল তাদের মালয়েশিয়ার দিকে নিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ধ্বংস হয়ে যায় আহমেদ নামে এক রোহিঙ্গা মুসলিমের মাছধরা নৌকা, যা ছিল তার আয়ের একমাত্র অবলম্বন। এরপর ৬০ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি রওনা হন থাইল্যান্ডে কাজের আশায়। ১৩ দিনের ভ্রমণ শেষে তারা থাইল্যান্ডের উপকূলের কাছে পৌছেন। এরপর সেখানে থাই নৌবাহিনী তাদের ধরে ফেলে এবং ওই রাতেই পুলিশভ্যানে করে সীমান্তবর্তী শহর রানোংয়ে নিয়ে যায়। তারা জানতেও পারল না, সাহায্যের বদলে সেখানে পাচারকারীদের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। দুই ঘণ্টা পর তাদের ৬টি ছোট গাড়িতে তোলা হলো। তাদের যখন গাড়ি থেকে বের করা হলো, তখন তারা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সীমান্তবর্তী একটি শহরে।
সেখানে তাদের মানবেতরভাবে রাখা হয়। রড দিয়ে খোঁচানো হয় এবং চেইন দিয়ে পেটানো হয়। এরপর আটককৃতদেরকে তাদের আত্মীয় ও পরিবারের কাছে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করে পাচারকারীরা। আহমেদের জন্য মুক্তিপণ ধার্য করা হয় ৪০ হাজার বাথ (থাইল্যান্ডের মুদ্রা)। এক মাস বন্দি থাকার পর কিছু রোহিঙ্গার সহযোগিতায় তারা মুক্তি পায়। এরপর ২ জানুয়ারি সমুদ্রতীরবর্তী ৭৩ জন নারী-পুুরুষ-শিশুকে ধরে ট্রাকে তুলে ঘোষণা দেয়া হয়, তাদের মুক্ত করার জন্য থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তারাও চোরাকারবারিদের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। ওই ব্যবসায়ীদের এক দালালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা থাইল্যান্ডের কর্মকর্তাদের জন্য ১৫ লাখ থাই বাথ নিয়ে এসেছেন।
এদিকে, থাইল্যান্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের হয়তো অল্প কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা আছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত রানোংয়ের একজন থাই কর্মকর্তা বলেন, দালালদের সঙ্গে কাজ করা এখন এখানে ‘প্রাকৃতিক সমাধান’ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বেশিরভাগ সময়ই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে। আর এভাবেই তারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে অন্য দেশে যাত্রা করে। তবে থাইল্যান্ড এসব অভিবাসী চায় না। থাইল্যান্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়ায় যেতে চায়, আর মালয়েশিয়াও তাদের গ্রহণ করে। কারণ, তারাও মুসলিম। তাই রোহিঙ্গারা কোন পথে সেখানে যাচ্ছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং তারা কিভাবে পৌছবে, সেটাই মুখ্য।’
জাতিসংঘের রিফিউজি এজেন্সির ‘রোহিঙ্গা আশ্রয় দেয়ার দাবি’ অনুমোদন দিয়েছে মালয়েশিয়া। কিন্তু থাইল্যান্ড তা দেয়নি। থাইল্যান্ডে স্থায়ী সচিব শিহাসাক পুয়াংকেটকাও বলেন, ‘আমরা এই মুহূর্তেই এর সমাধান করতে পারছি না। কিন্তু থাই সরকার এই সমস্যার মূলে যাওয়ার জন্য দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। একই সঙ্গে থাই সরকার তার সাধ্যমতো এই লোকগুলোকে মানবিক কারণে সহযোগিতা করছে। আর সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে একটি স্থায়ী ও নিয়মতান্ত্রিক সমাধানের দিকে এগোতে চাই আমরা।’
উল্লেখ্য, ২০০৯ সাল থেকে এভাবে আসা নৌকাগুলোকে সমুদ্রেই ফেরত পাঠাত থাইল্যান্ড। সেই সময় সেখানে বেশিরভাগই থাকত পুরুষ, যাদের তারা ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করত। তবে এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। -বিবিসি অনলাইন

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button