দুই প্লেটের রেষারেষি ৫০০ হিরোশিমার শক্তি

Nepal2কাঠমান্ডু থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নির্জন পাহাড়ি এলাকা। সেখানেই মাটির ১১ কিলোমিটার গভীরে গত শনিবারের ভয়াবহ ভূমিকম্পের উৎসস্থল। ভূগর্ভস্থ যে প্লেটগুলোর উপরে অবস্থান করছে মহাদেশ ও মহাসাগরগুলো, তার মধ্যেই দুটি প্লেটের রেষারেষির ফল এ দিনের ভূমিকম্প।
গত শনিবার দুপুরে ভারতীয় প্লেটটি পিছলে ঢুকে যায় ইউরেশীয় প্লেটের নিচে। সেই প্রক্রিয়ায় যে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তার জেরেই কেঁপে ওঠে কাঠমান্ডু থেকে ঢাকা। কম্পন কোথাও স্থায়ী হয় এক মিনিট, কোথাও দেড় মিনিট, কোথাও বা দু’মিনিট। ধ্বংসলীলার পক্ষে এটুকু সময়ই ছিল যথেষ্ট। কারণ দু’প্লেটের এই স্থান পরিবর্তনে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়েছে, তার কাছে পরমাণু বোমা নস্যি। কী রকম? ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিরোশিমায় যে পরমাণু বোমাটি ফেটেছিল, তার থেকে নির্গত হয়েছিল ২০ হাজার টন টিএনটির শক্তি। আর গত শনিবার রিখটার স্কেলে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে শক্তি বিচ্ছুরণের পরিমাণ তার থেকেও ৫০০ গুণ বেশি। হিসেব অনুযায়ী সেটা এক কোটি টন টিএনটির শক্তি (১০২০ জুল)।
২০০৪ সালে সুনামির সময়ে ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্পে একই পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়েছিল বলে জানিয়েছেন খড়্গপুর আইআইটির ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ শঙ্করকুমার নাথ। এ দিনের ভূমিকম্পকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘অতি বড়’ (গ্রেট) ভূমিকম্প বলেই চিহ্নিত করছেন বিজ্ঞানীরা।
কী ভাবে তৈরি হল অতি বড় মাপের ভূমিকম্পটি? শঙ্করকুমার বাবু বলেন, ‘হিমালয় তৈরি হওয়ার সময় থেকেই ভারতীয় প্লেট এবং ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে- কে কার নিচে পিছলে যাবে।’ তিনি জানান, এর ফলেই ওই দুটি প্লেট বরাবর তৈরি হয়েছে কয়েকটি চ্যুতি বা ফাটল।
কয়েকটি চ্যুতি বেশ বড় মাপের। সেগুলো ‘থ্রাস্ট’ বা খোঁচা। ভূমিকম্পগুলো তৈরি হয় এই চ্যুতি ও খোঁচায় অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয়ের জন্য।
কীভাবে?
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, দুটি প্লেটের মধ্যে নিরন্তর ঘর্ষণের জন্য এই চ্যুতি এবং খোঁচাগুলিতে সব সময়ে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। স্বভাবতই চ্যুতির থেকে খোঁচায় সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ বেশি। কোনো চ্যুতি বা খোঁচায় সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ যখন সম্পৃক্ত হয়ে যায় তখন আরো শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ওই চ্যুতি বা খোঁচায় ঝাঁকুনি হয় (চিনি দিয়ে ভর্তি একটি বোতলে অতিরিক্ত চিনি ভরার সময় যেমন ঝাঁকুনির প্রয়োজন হয়, তেমনই)।
তখনই একটি প্লেট অন্য একটি প্লেটের নিচে পিছলে যায়। যে খাঁজে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ যত বেশি, ঝাঁকুনির ফলে সেখানে তত বেশি মাত্রার ভূমিকম্প তৈরি হয়। এ রকমই একটি খোঁচায় ঝাঁকুনির ফলই হল এ দিনের ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প। ঠিক কোথায় তৈরি হয়েছে এ দিনের ভূমিকম্পটি?
ভূ-বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, হিমালয়ে এই ধরনের তিনটি খোঁচা রয়েছে। প্রধান কেন্দ্রীয় (মেইন সেন্ট্রাল), প্রধান প্রান্তীয় (মেইন বাউন্ডারি) এবং হিমালয়ের পৃষ্ঠদেশীয় (ফ্রন্টাল)।
শঙ্করকুমার জানান, গত শনিবারের ঝাঁকুনিটি হয়েছে প্রধান প্রান্তীয় খোঁচায়। ওই ঝাঁকুনির ফলে যে বিপুল পরিমাণ শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটেছে, তা-ই নাড়িয়ে দিয়েছে নেপালের পাশাপাশি প্রতিবেশী আরো চারটি দেশকে। এ দিন আধ ঘণ্টার ব্যবধানে দুবার জোরে কেঁপেছে নেপাল থেকে ঢাকা। তা হলে কি পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়েছে নেপালে?
ভূ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি বড় ভূমিকম্পের পরে অনেকগুলো ভূমিকম্পোত্তর কম্পন (আফটার শক) হয়। সেগুলোর জন্য অনেকের মনেই ভুল ধারণা তৈরি হয়। তারা ভাবেন, নতুন করে ভূমিকম্প হল। আসলে যে ভূমিকম্পের শক্তি যত বেশি, তার তৈরি ভূমিকম্পোত্তর কম্পনও তত বেশি।
শঙ্করকুমার বাবু জানান, এ দিনের ভূমিকম্পের পরে অন্তত ২০টি ভূমিকম্পোত্তর কম্পন তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে প্রথমটির শক্তি ছিল বেশি। তাই কলকাতায় প্রথম দফার কম্পনের আধ ঘণ্টা পরে আর এক বার প্রবল কম্পন অনুভূত হয়েছে। পরবর্তী ভূমিকম্পোত্তর কম্পনগুলো নেপালে অনুভূত হলেও, কলকাতায় বোঝা যায়নি।
এ দিনের অতি প্রবল ওই ভূমিকম্পের জেরে ফের বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের সতর্কতা রয়েছে কি? আইআইটির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের কোনো পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়। হিমালয়ে এবং সমুদ্রে বিভিন্ন প্লেটের মধ্যে প্রতিনিয়ত রেষারেষি চলছে। কবে, কোথায়, কত মাত্রার ভূমিকম্প হবে তা কেউ বলতে পারে না। -আনন্দবাজার পত্রিকা

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button