ইউরোপের মাঝখানে এক অভিবাসী বস্তি

প্রতিবছর আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার মানুষ ইটালি পৌঁছান বেআইনি অভিবাসী হয়ে। উদ্দেশ্য একটাই, কোনো একটা চাকরি, মোটামুটি বেঁচে থাকার মতো সামর্থ্য আর দেশে টাকা পাঠানো। কিন্তু সে স্বপ্ন সফল করা খুব সহজ নয়। ইটালির আপুলিয়া অঞ্চল। গ্রীষ্মের দুপুরে সূর্য আগুন ঝরায়। সেই সঙ্গে বয়ে যায় আগুনের হল্কার মতো বাতাস। তারই মধ্যে পুরনো পিচবোর্ডের বাক্স আর প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে তৈরি এক বস্তিবাড়ি। সামনে একটা ময়লার পাহাড়, যার উপর মাছি ভন ভন করছে। চতুর্দিকে এ ধরনের ঝুপড়ির পর ঝুপড়ি। কোথাও পানি নেই, বিদ্যুৎ নেই, বাথরুম-পায়খানা নেই। এই বস্তির বাসিন্দারা জায়গাটাকে তাদের ঘেটো বলেন, হিটলারের আমলে ইহুদিরা যেভাবে থাকতো।
ঝুপড়িতে ঢুকলে হয়তো দেখা যাবে, জনা পাঁচেক লোক নিজের নিজের বিছানার উপর শুয়ে আছে। ঘরে আরো গোটা দশেক জাজিম পাতা। ঘর জুড়ে টাঙানো দড়িতে ঝুলছে জামাকাপড়। মাটিতে রাখা রয়েছে জুতোজোড়া, প্লাস্টিকের বাক্সে খাবার-দাবার। এই ঘরটাকেই ইব্রা ম’বাকে তার ঘরবাড়ি বলে চিহ্নিত করেন। সেনেগাল থেকে নৌকায় সাগরপাড়ি দিয়ে ইটালিতে যান অনেক অভিবাসী। পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আগত আরো বিশজন মানুষের সঙ্গে এই ঝুপড়িতে থাকেন ইব্রা। দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য বছর দশেক আগে সেনেগাল ছেড়ে পালিয়েছিলেন তিনি। ভাঙা নৌকায় জান হাতে করে সাগরপাড়ি দেওয়ার পর দক্ষিণ ইটালির উপকূলে পৌঁছেন, একটা ভালো চাকরি পাবার আশায় এখানে এসেছিলাম বলে জানান তিনি।
ভালো টাকা কামাবেন, যাতে ভালোভাবে বাঁচতে পারবেন, সেনেগালে তার পরিবারকে সাহায্য করতে পারবেন। ৩২ বছর বয়সি ইব্রা ছিলেন পেশায় ছুতোর। গোড়ায় কিছু কিছু কাজও পেয়েছিলেন, তবে ছুতোর মিস্ত্রি হিসেবে নয় : মাঠে, খামারে শাকসবজি বা ফল তোলার কাজ, কম মজুরির কাজ, যা ইটালীয়রা করতে চায় না। ইটালিতে মন্দা চলছে, কাজেই সেসব কাজও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। ওদিকে ইব্রা এই বস্তিতে আটকা পড়েছেন। তার আর কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। গত তিন মাস ধরে তিনি বাড়িতে কোনো টাকা পাঠাতে পারেননি। বাড়ির লোকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, তার কোনো চাকরি নেই, বাড়িতে পাঠানোর মতো টাকা নেই কিন্তু তারা বিশ্বাস করতে চান না। তারা মনে করেন, তাদের কথা ভুলে ইউরোপে মজা করছেন তিনি। আগের কাজের মজুরিও যে খুব বেশি ছিল এমন নয়, ঘণ্টায় সাড়ে তিন ইউরো। ইটালীয় আর আফ্রিকান মাফিয়া মিলিয়ে তৈরি কাপোলারি ওর চেয়ে বেশি মজুরি দেয় না। ইব্রা পারিশ্রমিক সংক্রান্ত একটা লিখিত চুক্তি চাওয়াতে, সে আবেদন নাকচ হয় এবং ইব্রা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। ইব্রা জানেন, চুক্তি করা চাকরি থাকলে, তিনি সেই চাকরি গেলে বেকার ভাতা পেতেন। কিন্তু এসব বহিরাগত শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত করায় কাপোলারির কোনো আগ্রহ কিংবা স্বার্থ নেই। প্রণালীটা হলো এই যে, স্থানীয় চাষি ও খামার মালিকরা সস্তায় মজদুর যোগাড় করার কাজটা মাফিয়ার হাতেই ছেড়ে দেয়। মাফিয়া আবার ঐ শ্রমিকদের কাজ দেবার জন্য তাদের কাছ থেকে তাদের রোজগারের অর্ধেক দাবি করে। ওদিকে ইব্রার পক্ষে সব কিছু ছেড়ে-ছুড়ে সেনেগালে ফিরে যাওয়াটা ব্যক্তিগত পরাজয়ের মতো হবে। এছাড়া ফেরত যাওয়ার টিকিট কেনারও সামর্থ্য নেই। যেটুকু টাকা বাঁচিয়েছিল, তাও ফুরিয়ে গেছে। কাজেই সে আজ সারাদিন রাস্তার ধারের সবজির খামারগুলো ঘুরে দেখে, যদি কোনো কাজ পাওয়া যায়। সূত্র : ডয়চে ভেলে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button