আনোয়ার ইব্রাহিমকে ঠেকাতে মামলা কৌশল

Anwarমাসুম বিল্লাহ
দুই বছর আগে হাইকোর্টে খালাস পাওয়া একটি মামলার রায় বাতিল করে মালয়শিয়ার আপিল আদালত দেশটির জনপ্রিয় বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছে তা সেখানকার বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি লজ্জাজনক অধ্যায় বলেই মনে হচ্ছে। গত ৭ই ফেব্রুয়ারি ওই রায়ে সাবেক এই উপপ্রধানমন্ত্রীকে সমকামিতার অভিযোগে ৫ বছর কারাদণ্ড এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। ফলে বহুল আলোচিত কাজাং রাজ্যের উপনির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারছেন না। জনপ্রিয় এই নেতাকে দমনের জন্য যেন সরকারের প্রধান অস্ত্র সমকামিতার অভিযোগ। মজার বিষয় হলো, আদালতে উপস্থিত আনোয়ার ইব্রাহিমের সমর্থকদের রায় শুনে বিমর্ষ হওয়ার বদলে উৎফুল্লচিত্তে বিজয়ীর হাসি হাসতে দেখা যায়। আদালতের বিচারকাজ সরাসরি সম্প্রচার করছিল বেশকিছু ওয়েভ টেলিভিশন। তাতে আনোয়ার সমর্থকদের ‘সংস্কার চাই’ বলে স্লোগান দিতে দেখা যায়। এই স্লোগান দিয়ে ১৯৯৮ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামেন আনোয়ার ইব্রাহিম। তাতে বেশ সাড়াও পান। জনপ্রিয়তাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নেতার জন্য।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে দেশটির রাজনীতিতে আনোয়ার ইব্রাহিম ছিলেন একজন উদীয়মান তারকা। ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল বারিসান জোটের নেতৃত্বদানকারী ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অরগানাইজেশন (উমনো)-এর নেতা ছিলেন তিনি। মাহথির মোহাম্মদের উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হতো তাকে। ১৯৯৭ সালে এশিয়ায় আর্থিক সঙ্কট দেখা দিলে দলের শীর্ষ নেতাদের সাথে তার বিরোধ বাধে। ফলে দল থেকে বহিষ্কৃত হন। এতে দমে না গিয়ে সরকারের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। ফলে প্রমাদ গুনে সরকার। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়। এই অভিযোগে ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ার একটি আদালত তাকে ৬ বছর কারাদণ্ড দেয়। রায়ের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং আনোয়ার ইব্রাহিমের জনপ্রিয়তার পারদ ওপরের দিকে উঠতে থাকে। ফলে তাকে দমনের জন্য নোংরা পথে হাঁটতে শুরু করে সরকার।
২০০০ সালে স্ত্রীর গাড়ি চালকের সঙ্গে সমকামিতার অভিযোগ আনা হয় আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে। আদালত তাকে ৯ বছর কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু অভিযোগটি যে সাজানো ছিল তা বুঝতে বেশি দেরি হয়নি। আনোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার কিছু দিন আগে ২৪ বছর বয়সী ওই গাড়িচালক সে সময়ের উপপ্রধানমন্ত্রী (পরে প্রধানমন্ত্রী) নাজিব রাজাক ও তার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো প্রকাশ হয়ে পড়ে। সেই সাথে অভিযোগকারীর সাথে বাদিপক্ষের একজন নারী আইনজীবীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক ছিল বলে খবর প্রকাশ হলে মামলাটি আরো জটিল হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালে হাইকোর্ট তাকে নির্দোষ বলে রায় দেয়। আদালতের রায়ে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে প্রভাবশালী বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন আনোয়ার ইব্রাহিম। মারাত্মক রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হন নাজিব রাজাকের জন্য।
তার এ জনপ্রিয়তার প্রমান পাওয়া যায় ২০০৮ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত দেশটির সাধারণ নির্বাচনে। যদিও তিনি তখনো নির্বাচনে অংশ নেয়ার যোগ্য ছিলেন না কিন্তু, তার স্ত্রী ওয়ান আজিজার নেতৃত্বে বিরোধী দল ব্যাপক সাফল্য লাভ করে। ওয়ান আজিজার দল পাকাতান রাকিয়াত ৮২টি আসন পেয়ে পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনালের আসন কমে ৬১টি। নির্বাচনের ফলা ছিল সরকারের জন্য আতঙ্কের কারণ। ওই বছরের আগস্টে দ্বিতীয়বারের মতো আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ আনা হয়। এবারের অভিযোগকারী সাজানো হয় সাইফুল বুখারি আজলান নামে তারই একসময়ের এক সহকারীকে দিয়ে। অভিযোগ মাথায় নিয়েই একটি উপনির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন আনোয়ার ইব্রাহিম।
তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সমকামি মামলার বিচার শুরু হয় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তিন বছর বিচার চলার পর ২০১২ সালের জানুয়ারিতে আনোয়ার ইব্রাহিমকে খালাস দেয় হাইকোর্ট। তখনই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার। কিন্তু এই আপিল নিয়ে গত দু’বছরে তেমন উচ্চবাচ্য করেনি সরকার। এরই মাঝে দেশটির অর্ধশতাব্দীর স্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে সফল বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হন আনোয়ার ইব্রাহিম। তার নেতৃত্বে ২০১৩ সালের মে’তে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিরোধী দল আগের চেয়ে আরো ৭টি বেশি ৮৯টি আসনে জয়ী হয়। অন্য দিকে, ক্ষমতাসীন জোট পায় ১৩৩টি আসন। কিন্তু ভোটের হিসাবে বিরোধী দল পায় ৫১% এবং সরকারি দল ৪৮%। ১৯৫৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ক্ষমতায় বারিসান ন্যাশনাল। ২০১৩ সালের ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী সাধারণ নির্বাচনে পাকাতান রাকিয়াত-এর সরকার গঠন যে আর ঠেকানো যাবে না তা বুঝতে কারো আর বাকি থাকার কথা নয়।
কিন্তু, আপিলের দুই বছরের মাথায় তড়িঘড়ি করে মাত্র দুই দিনে শুনানি শেষে গত ৭ ফেব্রুয়ারি দেশটির আদালত যে রায় দেয় তার কারণ কিন্তু পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন নয়। তা ছিল এ মাসেই সেলেঙ্গার রাজ্যের কাজাং-এর উপনির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমের অংশ গ্রহণের সম্ভাবনা। আগামী ২৩ মার্চ এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। রায় ঘোষণা করা হয় মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার শেষ সময়ের ঠিক তিন দিন আগে। মালয়েশিয়ার অন্যতম ধনী ও প্রভাবশালী রাজ্য সেলেঙ্গার। গত বছর নির্বাচনে রাজ্যের ২২টি আসনের মধ্যে ১৭টি আসন পায় পাকাতান রাকিয়াত। দলটির আশা ছিল উপনির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমকে বিজয়ী করে আনা গেলে তিনি হবেন এখানকার মুখ্যমন্ত্রী। এতে তার পক্ষে আগামীতে আরো শক্ত হাতে দলকে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব হবে। আপিল আদালতের রায়ে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হলেন। অবশ্য একটি জামিন আবেদন আদালতে বিচারাধীন থাকায় এখনই তাকে জেলে যেতে হচ্ছে না।
গত নির্বাচনে পেনাং রাজ্য থেকে এমপি নির্বাচিত হন আনোয়ার ইব্রাহিম। কিন্তু বিগত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল মালয় প্রভাবিত উমনোকে ভয় পাইয়ে দেয়। ফলে সেলেঙ্গারে আনোয়ার ইব্রাহিমের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়ের মধ্যে ছিল দলটি। মুখ্যমন্ত্রী হলে সত্যিকারের একজন মালয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পেতেন তিনি। তার বদলে এখন স্ত্রী ড. ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাইল কাজাং উপনির্বাচনে অংশ নেবেন বলে রাকিয়াত নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি দলটির সভাপতি। আর আনোয়ার ইব্রাহিম এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপদেষ্টা হিসেবে।
ক্ষমতাসীন বারিসান-ন্যাশনাল জোট যে কোনোভাবে আনোয়ার ইব্রাহিমের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে চাইছেÑ আপিল আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের জন্য আদালতের এই রায় গুরুত্বপূর্ণ। ফেডারেল কোর্টের আপিলে হেরে গেলে আনোয়ার ইব্রাহিমকে কারাগারে যেতে হবে। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনেও তিনি অংশ নিতে পারবেন না।
নামে স্বাধীন হলেও এই ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় দেশটির আদালতের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কতটা প্রবল। সরকার অবশ্য বলেছে, দুই ব্যক্তির মধ্যে এই মামলায় আদালতের রায়ের ব্যাপারে তাদের বলার কিছু নেই। কিন্তু, রায়টি যে চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আর এখানেই আনোয়ার ইব্রাহিমের বিজয়। এতে তার ও তার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পাওয়াই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button