বিশ্বকে কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয় গাজার গণহত্যা
ইসরায়েলের নৃশংসতা মানবতা, ন্যায়বিচার এবং সব জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের একটি বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে। গাজা উপত্যকায় প্রায় দুই বছর ধরে যা ঘটছে, তা শুধুমাত্র একটি মানবিক বিপর্যয় নয়; এটি একটি রাজনৈতিক অপরাধ, যার গভীর ঐতিহাসিক ও ভূরাজনৈতিক পরিণতি রয়েছে।
এটি মানবাধিকার, শান্তি এবং নিরাপত্তা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক বক্তৃতার দুর্বলতাকে উন্মোচিত করেছে, কারণ এমন কথা ইসরায়েলের চলমান হত্যাযজ্ঞ থামাতে পারেনি, বা ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে জোরপূর্বক উৎখাতের উদ্দেশ্যে গৃহীত নীতিগুলোকে রোধ করতে পারেনি — যা এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ উন্মুক্ত কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। তবুও, এই গণহত্যা বিশ্বব্যাপী মুক্ত বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে, মানবতা, ন্যায়বিচার এবং সব জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সম্মিলিত প্রতিরক্ষা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ কণ্ঠ ইসরায়েলের পুরুষ, নারী এবং শিশু হত্যার বিরুদ্ধে, এবং গাজার বেসামরিক অবকাঠামোর অধিকাংশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উঠেছে।
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং কানাডা সহ অনেক দেশ সম্প্রতি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দিকে একটি বাস্তব রাজনৈতিক পথের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে।
যেসব রাষ্ট্র বহুদিন ধরে ইসরায়েলকে সমর্থন করেছে, তাদের জন্যও গাজার গণহত্যা উপেক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গত দুই বছরে যা ঘটেছে তা আধুনিক যুগের অন্যতম জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বেসামরিক মানুষদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, মানবিক সহায়তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, এবং পুরো পাড়া-মহল্লা মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। খাদ্যকে ধ্বংসের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে হাজার হাজার ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিকে সহায়তা বিতরণ কেন্দ্রে ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করেছে। ইসরায়েল প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করেছে, বৈশ্বিক নিয়ম ও কনভেনশনকে উপেক্ষা করেছে, যা জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থার অসংখ্য প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
একটি মোড় ঘোরানো মুহূর্ত:
এই নৃশংস আগ্রাসন শুধুমাত্র একটি মানবিক ট্র্যাজেডি নয়। এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে একটি মোড় ঘোরানো মুহূর্ত, যা অনেক দেশকে সংঘাত নিয়ে তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করছে, একই সাথে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ভিতরে লুকিয়ে থাকা দ্বৈত মানকে উন্মোচিত করছে।
এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে যে কীভাবে ভুক্তভোগীদের স্মৃতি সংরক্ষণ করা যায়, এবং কীভাবে ইসরায়েলের ভয়াবহ অপরাধগুলিকে নথিবদ্ধ করা যায় যাতে এমন ঘটনা আবার না ঘটে। গাজার গণহত্যার একটি মূল্যায়ন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু সত্য এবং পরিবর্তন প্রকাশ করে। এটি উন্মোচন করেছে যে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর “বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিক সেনাবাহিনী” দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা, কারণ তারা অতি মাত্রায় ও অযৌক্তিকভাবে বলপ্রয়োগ করেছে; নিহত ৬৭,০০০ মানুষের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নারী ও শিশু। ইসরায়েলের লঙ্ঘনগুলির মধ্যে রয়েছে হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, আশ্রয়কেন্দ্র এবং স্কুলকে লক্ষ্যবস্তু করা, এবং বেসামরিক লোকদের নিয়ে থাকা বাড়িগুলো বোমা মেরে ধ্বংস করা। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে, এবং তাদের আরোপিত কঠোর অবরোধ গাজায় ব্যাপক অনাহার ও দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে।
গাজায় সংঘটিত এই নৃশংসতা — মানব অস্তিত্বের একটি পরিকল্পিত ধ্বংস — বিশ্বের যৌথ চেতনায় খোদাই করা আবশ্যক।
একই সাথে, ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তর করা হয়েছে আল-মাওয়াসির মতো জায়গায়, যাকে মিথ্যা করে “নিরাপদ অঞ্চল” বলা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার কোনো সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও, ইসরায়েল সেই এলাকাতেও বোমা বর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে, এই গণহত্যা বহু দেশের দ্বৈত মান উন্মোচিত করেছে, যারা মুখে এই নীতিগুলো বজায় রাখার দাবি করে, অথচ একই সাথে ইসরায়েলকে রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে তার গণহত্যা অব্যাহত রাখতে সহায়তা করে। বিশ্বজুড়ে জনগণ প্রতিষ্ঠিত বৈশ্বিক ব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছে, এবং পশ্চিমা কর্মীরা নিজেরাই প্রতিবাদ করছে ও তাদের সরকারকে অবস্থান পরিবর্তনে চাপ দিচ্ছে। এটি ছিল সম্প্রতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতির ঢেউয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
একই সময়ে, আমরা আন্তর্জাতিক জোটগুলির একটি নতুন রূপ দেখতে পাচ্ছি, যা প্রচলিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে, এবং সম্ভবত ইউরোপীয় রাজধানীগুলিতে মার্কিন-ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে সরে গিয়ে বৃহত্তর স্বাধীনতার সূচনা করছে। এটি শেষ পর্যন্ত আমেরিকান আধিপত্য যুগের অবসানের দিকেও নিয়ে যেতে পারে।
মানব ভাষা:
এই গণহত্যার স্মৃতি বিশ্বমানবতার চেতনায় খোদাই করা জরুরি, যাতে এই নৃশংসতা আর কখনও পুনরাবৃত্তি না হয় — এবং ন্যায়বিচারের জন্য অবিরাম চাপ বজায় থাকে। আমাদের প্রয়োজন এমন তথ্যচিত্র ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র যা জীবন্ত সাক্ষ্যকে অমর করে তুলবে, এবং এই বিভীষিকাগুলোকে এমন মানব ভাষায় বলবে যা সারা বিশ্বের মানুষ উপলব্ধি করতে পারে।
গাজার ভিতরে ও বাইরে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা উচিত, যেখানে ইসরায়েলের অপরাধগুলো নথিভুক্ত করা হবে, ধ্বংসযজ্ঞ প্রদর্শিত হবে, এবং ভুক্তভোগীদের গল্প বর্ণনা করা হবে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত সম্পর্কিত শিক্ষাসামগ্রী বিশ্বব্যাপী স্কুলের পাঠ্যক্রমে গভীরভাবে সংযুক্ত করা উচিত, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। জাতিসংঘের উদ্যোগে গাজার গণহত্যার জন্য একটি বৈশ্বিক স্মরণদিবস ঘোষণা করা উচিত, যা বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হবে।
গাজার গণহত্যা শুরু হওয়ার দুই বছর পূর্ণ হওয়া শুধু সময়ের হিসাব নয়। এটি মানব স্মৃতিকে প্রতিরোধের এক অস্ত্র হিসেবে ধরে রাখার আহ্বান, এবং বিশ্বের জন্য এক নৈতিক দিকনির্দেশক। গাজার নৃশংসতা — মানব অস্তিত্বের পরিকল্পিত ধ্বংস — বিশ্বের যৌথ চেতনায় খোদাই করা উচিত, ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর অধ্যায় হিসেবে।
এর অর্থ হলো ইসরায়েলের অপরাধকে যুক্তি দিয়ে বা স্বাভাবিক করে তোলার সব প্রচেষ্টা ভেঙে ফেলা। এটি একই সাথে আন্তর্জাতিক আদালতগুলির প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন প্রয়োজন, যাতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধগুলো রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা সুরক্ষিত না থাকে — এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ ও মান বজায় থাকে।
গাজার গণহত্যার দুই বছর পর আমরা মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে পৌঁছেছি। এখন আমাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব হলো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা, যাতে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলির অযাচিত প্রভাব দূর করা যায়। ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তির অধিকার অবিচ্ছেদ্য, আপস-অযোগ্য এবং বিশ্বের অন্য সব জাতির অধিকারের সমান মর্যাদাসম্পন্ন।
গাজার শারীরিক পুনর্গঠনের বাইরেও, বিশ্বের উচিত এই গণহত্যার স্মৃতি কখনও মুছে না যাওয়ার অঙ্গীকার করা — যাতে ভবিষ্যতে পৃথিবীর কোথাও কোনো জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এমন অপরাধ আর না ঘটে। শান্তির পথ শুরু হয় সর্বাত্মক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে, দখলদারিত্বের অবসান এবং একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তবেই বিশ্ব নিশ্চিত হতে পারবে যে গাজার আর্তনাদ বৃথা যায়নি, এবং এর নিরীহ বেসামরিক ভুক্তভোগীরা কেবল ঠান্ডা পরিসংখ্যান নয়, বরং মানবতার ন্যায়বিচারের অনুসন্ধানে এক তীক্ষ্ণ বিবেকের আর্তচিৎকার। -তালাল আহমদ আবু রুকব গাজাভিত্তিক একজন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক গবেষক এবং আল-শাবাকা (The Palestinian Policy Network)-এর নীতিবিষয়ক বিশ্লেষক। তিনি গাজার আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং তাসামোহ (সহনশীলতা) ম্যাগাজিনের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



