ফজিলতের দিন আশুরা

মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার:
আশুরা আরবি শব্দ। আশির বা আশরুন শব্দ থেকে উত্পত্তি হয়েছে, যার অর্থ দশম। কোনো কোনো ওলামায়ে কেরামদের মতে মহররম মাসের দশ তারিখে আল্লাহতায়ালা তাঁর দশজন প্রিয় পয়গম্বরকে দশটি অনুগ্রহ দান করেছিলেন, এ কারণেই এর নামকরণ হয়েছে আশুরা।
বর্তমানকালে আশুরার গুরুত্ব কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর শাহাদাত বরণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হলেও ইসলামের ইতিহাসে পবিত্র আশুরার অসংখ্য তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা উজ্জ্বল হয়ে আছে। যেমন এই পৃথিবীর সৃষ্টি, হযরত আইয়ুব (আ.)-এর কঠিন পীড়া থেকে মুক্তি, হযরত ঈসা (আ.)-এর আসমানে জীবিতাবস্থায় উত্থিত হওয়া এবং হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা ঝড়-তুফানের কবল থেকে মুক্তি পাওয়াসহ অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে মহররমের দশ তারিখ অর্থাত্ ইয়াওমে আশুরা একটি মর্যাদাপূর্ণ দিন হিসেবে অবিস্মরণীয় এবং মহিমান্বিত। সর্বোপরি এই পৃথিবীর মহাপ্রলয় বা কেয়ামত মহররমের দশ তারিখে ঘটবে বলে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।
সমসাময়িককালে বিশ্বের মুসলমান কারবালার ঐতিহাসিক শোকাবহ ঘটনাকে স্মরণ করে পবিত্র আশুরার এই দিনটিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করলেও মূলত দিবসটির যথাযথ মূল্যায়ণে আমরা যে অপারগ তাই প্রমাণ করে। অথচ কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা ও উপরোল্লিখিত ঘটনাবলি ছাড়াও হযরত রাসুলে করীম (সা.) এ দিনটিকে উদযাপন করতেন অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে। এই দিনের গুরুত্ব সম্পর্কে বিশেষভাবে তিনি আদেশ করেছেন। নিজেও রোজা রাখতেন—ইহুদিরা তাদের অন্যান্য উত্সবের ন্যায় আশুরার দিনটিও পালন করতো এবং রোজা রাখত। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বর্ণনা মতে নবী করীম (সা.) ইহুদিদেরকে আশুরার দিনে রোজা পালন করতে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কি উদ্দেশ্যে তোমরা এই রোজা রাখছো? তারা জবাবে বললো—দিনটি অত্যন্ত বরকতের। আল্লাহপাক বনী ইসরাইলকে এই দিনে ফেরাউনের কবল থেকে মক্তি দেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর বর্ণনা মতে জানা যায় যে, হযরত রাসুলে করীম (সা.) আশুরার দিন এবং রমজানের রোজাকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন অন্য কোনোদিন বা মাসকে এতটা গুরুত্ব দেননি।
ইবাদত বন্দেগির জন্য এ মুবারক আশুরার দিনটি যে কত ফজিলতপূর্ণ তা বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। হযরত নবী করীম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী বছরের সকল গুনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। যে আশুরার দিন রোজা রাখা হযরত আদম (আ.) ও অন্যান্য নবী পয়গম্বরদের ওপর ফরজ ছিল। এই পবিত্র দিনে দুই হাজার পয়গম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং এই মহান দিনে তাদের ফরিয়াদও আল্লাহপাক কবুল করে নেন। পবিত্র হাদিস শরিফে আরও উল্লেখ রয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরার রাতে খাঁটি অন্তরে নফল নামাজ আদায় করবে, আল্লাহপাক তার সমুদয় গুনাহ মাফ এবং অশেষ রহমত বর্ষণ করবেন। দুনিয়ার যাবতীয় বিপদ-আপন, রোগ-শোক এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত রাখবেন। রুজি-রোজগার বৃদ্ধি করেন এবং এই মহান দিনে তাদের ফরিয়াদও আল্লাহপাক কবুল করে নেন।
পবিত্র হাদিস শরিফে আরও উল্লেখ রয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরার রাতে খাঁটি অন্তরে নফল নামাজ আদায় করবে, আল্লাহপাক তার সমুদয় গুনাহ মাফ এবং অশেষ রহমত বর্ষণ করবেন। দুনিয়ার যাবতীয় বিপদ-আপদ, রোগ-শোক এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্ত রাখবেন। রুজি-রোজগার ও আয়-উন্নতিতে বরকত দান করবেন।
ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে শহীদ হযরত ইমাম হোসেন (রা.) সেদিন মিথ্যা ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণের পথ বেছে না নিয়ে সত্যের জন্য তিনি শাহাদত বরণ করেছিলেন। এই সত্য আদর্শ প্রতিষ্ঠার যে মহিমায় ব্যক্তিত্ব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে আমাদের এই মহান দিনে।
আজ এই পবিত্র আশুরার দিনের সত্যিকার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে প্রত্যেক মুমিনের। বিশেষত এই মর্যাদাপূর্ণ দিনে যেহেতু পয়গম্বরবৃন্দ পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে বিশেষ রহমত ও দয়া লাভ করেছিলেন, অনেক মুসিবত থেকে মুক্তি পেয়েছেন সেহেতু কারবালার জন্য দিনটি শুধু শোকের নয় বরং কৃতজ্ঞতারও। ইয়াওমে আশুরাকে হযরত রাসুলে করীম (সা.) যেভাবে এবং যে দৃষ্টিতে উদযাপন করেছেন, তার উম্মতে মোহাম্মদী হিসেবে সবারই সেভাবে পালনে এগিয়ে আসা উচিত।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ সীরাত মিশন, ঢাকা, বাংলাদেশ

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button