মার্কিন-তালেবান ঐতিহাসিক চুক্তি: ১৮ বছরের যুদ্ধের সমাপ্তি

সকল বিদেশী সেনা আফগানিস্তান ছাড়বে ১৪ মাসের মধ্যে

দীর্ঘ দুই বছর আলোচনার পর আজ শনিবার কাতারের রাজধানী দোহায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং তালেবান নেতাদের উপস্থিতিতে এই চুক্তি সই হয়। দোহার স্থানীয় সময় শনিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ২ টায় পাঁচ তারকা হোটেল শেরাটনে চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়। আর চুক্তিটি সম্পন্ন হওয়ার ফলে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ বছরের যুদ্ধের সমাপ্তি হল। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান ছাড়তে হবে মার্কিন ও ন্যাটো সেনাদের। তালেবানদের দেয়া শর্ত মেনেই যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিতে সই করেছে।

চুক্তির জন্য শনিবার সকাল থেকে শেরাটন হোটেলে ভিড় করতে শুরু করেছেন আফগান, মার্কিন, ভারত ও পাকিস্তানের কূটনৈতিকগণ। এছাড়া জাতিসংঘের অন্যান্য সদস্যরা ও তালেবানদের ৩১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পাঁচ তারকা হোটেলটিতে একত্রিত হয়েছেন। আফগান বিষয়ে মার্কিন বিশেষ দূত জালমি খলিলজাদ ও তালেবানদের পক্ষ থেকে সংগঠনটির রাজনৈতিক প্রধান মোল্লা আব্দুল গানি বারাদার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এর আগে চুক্তি নিয়ে শুক্রবার মধ্যরাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বিবৃতিতে জানান, এটি আফগানিস্তানের জন্য একটি বিরাট সুযোগ। এটি কাজে লাগিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে দেশটি।

ট্রাম্প আরও বলেন, ১৮ বছর আগে আফগানিস্তানে জঙ্গিদের মূল উৎপাটন করতে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে পাঠানো হয়েছিল। এরপর থেকে আমরা আফগানিস্তানে দুর্দান্ত অগ্রগতি করেছি। আমাদের সাহসী সেনা সদস্য, মার্কিন করদাতা ও আফগানিস্তানের জনগণদের জন্য এটি সম্ভব হয়েছে।

নিজের শাসন আমলের কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, যখন আমি ক্ষমতায় আসি, আমি মার্কিনীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে আমি আমাদের সেনাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে শুরু করব এবং এই যুদ্ধ শেষ করার চেষ্টা করব। আমি আমার প্রতিজ্ঞা রাখার চেষ্টা করছি।

এদিকে শান্তি চুক্তির সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাইক এস্পার উপস্থিত ছিলেন। চুক্তির পর আফগানিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি যৌথ ঘোষণা দেয়। অনুষ্ঠানে মাইক পম্পেও বলেন, আজ এ চুক্তির মাধ্যমে শান্তির সূচনা হল। আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র সব পক্ষের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করে। আফগান নাগরিকরা নিজ দেশে শান্তিতে বসবাসের অধিকার রাখে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ওয়াশিংটনের ঘোষিত এক সপ্তাহের সহিংসতা হ্রাস করার পরেই এই শান্তি চুক্তিটি সম্পন্ন হল।

চুক্তি মতে, এখন থেকে আফগানিস্তানে আর কোনো হামলা চালাবে না তালেবান। এছাড়া তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে আল-কায়েদাকে কোনো তৎপরতা চালাতে না দেয়ারও অঙ্গীকার করা হয়েছে।  চুক্তি অনুযায়ী, তালেবানরা তাদের গোষ্ঠীর পাঁচ হাজার যোদ্ধাকে আফগানিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করতে দাবি জানিয়েছে। তবে আফগান সরকার এটি মানবে কিনা তা এখনো জানা যায়নি।

আজকের চুক্তিটি নিয়ে অপেক্ষায় ছিলো কয়েক মিলিয়ন উৎসুক আফগান নাগরিক। চুক্তি নিয়ে কাবুলের একটি স্কুলের শিক্ষক জাভেদ হাসান বলেন, শান্তি অত্যন্ত সহজ এবং আমার দেশ এটির প্রাপ্য। আজকের দিনে আমরা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পারব। ২০১৮ সালে তালেবানদের বোমা হামলায় জাভেদ হাসানের সন্তানাদি মারা যায়। এরপর থেকে তিনি বিশ্ব নেতাদের আফগান যুদ্ধের অবসানে চিঠি পাঠানো শুরু করেন।

দোহায় চুক্তি করতে যাওয়া তালেবানরা জানান, চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান সরকার তাদের শর্তগুলো মেনে নিবে। তবে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে তাদের এক সূত্র জানান, তালেবানরা এই মাসের শুরুর দিকে জানিয়েছিল যে, যদি চুক্তি ভেস্তে যায় তাহলে তারা ছয় হাজার যোদ্ধাকে নতুন করে নিয়োগ দিবে। এছাড়া আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীও নিয়োগ দিবে।

উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে প্লেন হামলা চালানো হয়। এতে প্রায় ৩ হাজার লোক নিহত হয়। এর জন্য আল-কায়েদাকে দায়ী করে মার্কিন প্রশাসন। এরপরেই তাদের নির্মূল করতে আফগানিস্তানে সেনা পাঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বিচিত্র সব ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ আছে ওই ঘটনা নিয়ে। যেমন: মার্কিন সরকার বা ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা এ হামলার পেছনে ছিল, ওই আক্রমণে কোন ইহুদি মারা যান নি, আসলে কোন বিমান টুইন টাওয়ারে বা পেন্টাগনে আঘাত করেনি – এই রকম নানা কিছু। আরেকটি বড় তত্ত্ব হচ্ছে – ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দুটি টাওয়ার ধসে পড়েছিল বিমানের আঘাতে নয়, বরং ভবনটির ভেতরে বিস্ফোরক বসিয়ে তা উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।

আজ এত বছর পরও এসব তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক শেষ হয়নি। টুইন টাওয়ারে হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ছড়ায় প্রথম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। ডেভিড রস্টচেক নামের এক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী লিখলেন, “কেউ কি খেয়াল করেছেন যে ওয়ার্ল্ড টেড সেন্টার ভবনটি বিমানের আঘাতে ধ্বংস হয় নি? নাকি শুধু আমিই এটা বুঝেছি?” তার কথা ছিল, ভবন দুটিতে বিমান আঘাত করেছে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এটা ঠিক কথা – কিন্তু যেভাবে টাওয়ার দুটি ভেঙে পড়েছে তার জন্য এর ভেতরে সঠিক জায়গায় বিস্ফোরক বসাতে হতো। এ কাজটা করতে হলে কাউকে অনেক সময় নিয়ে করতে হবে। প্রশ্ন হলো: প্লেনগুলোর তাহলে কী কাজ ছিল?

পরে অবশ্য তদন্ত করে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, বিমানের আঘাতের পর আগুনে টাওয়ার দুটির কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ওপরের তলাগুলো ভেঙে পড়তে থাকলে তার চাপে পুরো ভবনটিই ভেঙে পড়ে যায়। কিন্তু এখনো কিছু লোক আছেন যারা এ কথা বিশ্বাস করেন না। মার্কিন বাহিনীর হামলায় তৎকালীন তালেবান সরকারের পতন ঘটলেও গত দেড় যুগেও তালেবানকে আফগানিস্তান থেকে নির্মূল করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয় আমেরিকা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button