৭৯ বছরের বৃদ্ধ বাদশাহ যেভাবে মধ্যপ্রাচ্য কাঁপাচ্ছেন

Salman৭৯ বছরের এক বয়োবৃদ্ধ লোক। সাথে আছে মারাত্মক অসুস্থ্যতা। প্রায়ই স্মৃতিবিভ্রাট ঘটে। এ বছরের জানুয়ারিতে যখন মুসলিম বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী দেশ সৌদি আরবের ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন, তখন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের শাসনে নতুন তেমন কিছু দেখার আশা খুব কম লোকই করেছেন।
দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর ধরে রিয়াদের গভর্নর থাকা অবস্থায় নিজেকে একজন সক্ষম প্রশাসক হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন সালমান। তবে তিনি যে বাদশাহ হওয়ার পর দেশটির নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোতে খুব বেশি পরিবর্তন আনবেন তা বুঝা যায়নি।
কিন্তু গত জানুয়ারিতে রাজমুকুট পরার পর একের পর এক মধ্যপ্রাচ্যকে কাঁপিয়ে যাচ্ছেন এই বৃদ্ধ। সৌদির বিদেশনীতি এবং রাজপরিবারের উত্তরসূরী নির্ধারণে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন।
ইয়েমেনে ইরানের মদদপুষ্ট হুতি বিদ্রোহীদের দমনে সৌদি আরবের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিমান অভিযান শুরু করেছেন সালমান। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে লড়া যোদ্ধাদের প্রতি বাড়িয়েছেন সমর্থন। এসবের মাধ্যমে তেলসমৃদ্ধ এবং এতদিন ধরে নিজের নিরাপত্তার জন্য পুরানো বন্ধু আমেরিকার উপর নির্ভরশীল থাকা সৌদি আরব নতুন কিছুর ইঙ্গিত দিতে চায়। বিশ্লেষকদের মতে, সালমানের লক্ষ্য হচ্ছে এই অঞ্চলে সুন্নীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা করা।
সৌদি রয়াল কৌর্টের সাবেক উপদেষ্টা এবং বর্তমানে হার্ভার্ডের বেলফার সেন্টার অব সায়েন্স এন্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ফেলো নওয়াফ ওবায়েদ বলেন, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদির দিন চলছে।
ওবায়েদ আরো বলেন, দেশটির আরব মিত্ররা বর্তমানে সমস্যাগ্রস্থ মিশরের চেয়ে সৌদি আরবকে বেশি যোগ্য ও সক্ষম নেতৃত্ব হিসেবে বিবেচনা করছেন। কয়েক বছর আগে ওবায়েদ যখন সালমানের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন তখনকার অভিজ্ঞতা স্বরণ করে তিনি বলেন, ‘তখন তিনি (সালমান) বলেছিলেন, যদি আমরা আমাদের অবস্থান জানান না দেই, তাহলে অন্য কেউ এটা করবেই।’
বাদশাহ সালমানের মনোভাব হচ্ছে, ‘আপনাকে নিজের পারিপারির্শ্বকতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যথায় পারিপার্শ্বিকতাই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।’
ইসলামের পবিত্রতম দুই জায়গা- মক্কা এবং মদীনার- অভিভাবক হিসেবে সৌদি নেতারা তাদেরকে সুন্নীদের স্বার্থের রক্ষক হিসেবে দেখে থাকেন। মূলত, ইরাকে এবং সিরিয়ায় মিলিশিয়াদেরকে অস্ত্র এবং টাকা দিয়ে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এই অঞ্চলে শিয়াশাসিত ইরানের অব্যাহত প্রভাব বৃদ্ধিই সৌদি আরবকে আরো বেশি আগ্রাসী করে তুলেছে।
সৌদি আরব প্রকৃতপক্ষে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সম্প্রতি ইরানের সাথে মার্কিনিদের দহরম মহরমে সৌদি শাসকদের মধ্যে সন্দেহ দানা বেধেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সৌদি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান আগের মতোই আছে বলে বারবার বলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ওয়াশিংটনে সাবেক সৌদি কূটনীতিক ফাহাদ নাজার বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের গোলযোগ থেকে ইরানের সুবিধা নেয়ার যে সম্ভাবনা আছে মূলত তা-ই সৌদি আরবকে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে আরো বেশি অস্থির করে তুলেছে। ইরান-যুক্তরাষ্ট্র নতুন সম্পর্কই সৌদির মধ্যে তাড়াহুড়ো ভাব জাগিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালে রিয়াদ প্রদেশের গভর্নর হন সালমান। এরপর তার অধীনে রিয়াদ একটি মরুভূমি থেকে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় শহরে পরিণত হয়েছে। গভর্নর থাকাকালীন তিনি দূর্নীতি বিরোধী অবস্থান, গোত্রীয় দ্বন্দ্ব নিরসন এবং অবোকাঠামোগত উন্নয়নে সুনাম অর্জন করেন। এছাড়া রাজপরিবারে দ্বন্দ্ব সমাধানেও তিনি ছিলেন অগ্রগন্য। নাজার বলেন, মানুষের প্রয়োজন এবং সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ছিলেন সালমান। অনেক সময় বিভিন্ন পক্ষের সাথে সামনাসামনি বসে সমস্যা সমাধানে আগ্রহী ছিলেন তিনি।
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ক্ষমতারোহনের পর দেশটির মিডিয়ায় সালমানকে যুদ্ধকালীন বীর হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের দমনে সৌদির বিমান অভিযান দেশটির জনগনের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এর মাধ্যমে সাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ হয়েছে। মানুষজন বাদশাহ পক্ষে মিছিল করেছেন।
এরই মধ্যে সালমান রাজপরিবারের ক্ষমতায় ব্যাপক রদবদল নিয়ে এসেছেন। অপেক্ষাকৃত নতুন প্রজন্মকে ক্ষমতার ধারাবাহিকতায় তুলে আনা এবং তরুণদেরকে মন্ত্রী সভায় স্থান দেয়া এর অন্যতম। ক্রাউন প্রিন্স মুকরীন বিন আব্দুল আজিজকে সরিয়ে নিয়োগ দেন মোহাম্মদ বিন নায়েফকে। এর মাধ্যমে সৌদি রাজপরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের হাতে রাজদণ্ড হস্তান্তরের পথ পরিস্কার হল।
সালমান এই ধারাবাহিকতায় তার ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকেও ক্ষমতার কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। একই সাথে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং রয়াল কৌর্টের প্রধান হয়েছে মোহাম্মদ বিন সালমান। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে ক্যাম্প ডেভিডে বৈঠকেও উপস্থিত ছিলেন মোহাম্মদ।
সৌদি বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, ক্ষমতায় তরুণদের নিয়ে আসার মাধ্যমে দেশটির আরো বেশি উদারবাদী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং বাদশাহ সালমান অপেক্ষকৃত রক্ষণশীলদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। দেশটির একটি কর্তৃপক্ষের সংস্কারবাদী প্রধানকে পরিবর্তন করে পশ্চিমা পোশাকের ব্যাপারে কট্টর নেতিবাচক মনোভাব পোষণকারী একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এছাড়া এ বছরের অর্ধেক সময়ের মধ্যে গত বছরের মোট মৃত্যুদণ্ডের সমান সংখ্যক দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
বিশ্লেষক ওবায়েদ বলেন, সালমানের ব্যাপারে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, তিনি সৌদির বিভিন্ন ধরনের নীতিকে নতুনভাবে সাজাতে চান। কিন্তু সেটা কোনো দ্রুত নেয়া সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নয় যাতে ওয়াশিংটনের সাথে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
তিনি আরো বলেন, তার পেছনে হয়তো এমন অনেকে আছেন যারা তার চিন্তার দ্রুত বাস্তবায়ন চাইতে পারেন। কিন্তু দ্রুত আগানোতে এটা ঝুঁকি রয়েছে। আমার বিশ্বাস সালমান সেটা ভালই বুঝেন। এটা খুব জঠিল একটি বিষয়। সাহসী সিদ্ধান্ত নিন। কিন্তু যে ক্ষেত্রে দেশের কোনো স্বার্থ নেই সেখানে সাহস দেখানোর প্রয়োজন নেই।
Washington Post এর How Saudi Arabia’s 79-year-old King Salman is shaking up the Middle East শীর্ষক নিবন্ধের সংক্ষেপিত অনুবাদ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button