ব্রিটিশ মুসলিম ডেটিং অ্যাপ এখন বাংলাদেশে
বিবিসির সাপ্তাহিক ‘দ্যা বস’ অনুষ্ঠানের বিষয় ব্যবসা জগতের নেতাদের কাহিনী। চলতি সপ্তাহে বিবিসি কথা বলেছে শাহজাদ ইউনাসের সঙ্গে, যিনি মুসলিম ডেটিং ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ ‘মুজম্যাচ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। শাহজাদ ইউনাস যখন স্টেজে এলেন, তখন তিনি বেশ নার্ভাসই ছিলেন। এটা ছিলো দু’বছর আগের ঘটনা। সেই সময়ে এই ব্রিটিশ উদ্যোক্তার বয়স ছিলো ৩২ বছর। সেদিন তিনি স্যান ফ্রান্সিকোতে একদল সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীর সামনে লন্ডন-ভিত্তিক ‘মুজম্যাচ’ নিয়ে কথা বলছিলেন। তাঁর বক্তৃতার শুরু ছিলো এ রকম: “মুসলমানরা ডেট করে না, তারা বিয়ে করে”। শাহজাদ এবং তাঁর ব্যবসার অংশীদার রায়ান ব্রডি সেখানে গিয়েছিলেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে।
সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াই কমবিনেটর’ জয়ীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেবে, এটাই ছিলো প্রতিযোগিতার পুরস্কার। মার্কিন এই কোম্পানিটি বেশ কয়েকটি স্টার্ট-আপকে প্রতিবছর আর্থিক ও প্রয়োগিক সহায়তা দিয়ে থাকে। মুজম্যাচ যে বছর আবেদন করে, তখন মোট আবেদনের সংখ্যা ছিলো ১৩,০০০। আর মুজম্যাচ সহ ৮০০ স্টার্ট-আপের প্রতিষ্ঠাতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় তাদের উদ্যোগ নিয়ে কথা বলতে।
শাহজাদ যখন তাঁর বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন মাঝেমধ্যেই বিনিয়োগকারীরা হাসিতে ফেটে পড়ছিলেন – কারণ তিনি একবারে খোলামেলা কথা বলছিলেন। এরপর মুজম্যাচকে দেয়া হলো ১৫ লক্ষ ডলার – ২০১৭ সালে যে ১০০ স্টার্ট-আপ সহায়তা পেয়েছিল, তারা ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম।
আজ দ্রুত বেড়ে ওঠা এই কোম্পানি বলছে, যুক্তরাজ্য এবং আরও ৯০টি দেশে তাদের ১০ লক্ষেরও বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে। কিন্তু ২০১৩ সালে ফিরে গেলে এক ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। সে বছর বিনিয়োগকারী নয়, শাহজাদকে বরং নিজেকেই রাজী করাতে হয়েছিলো। ওই সময়ে তিনি লন্ডনে একটি ব্যাংকে কাজ করতেন। তিনি কাজটিকে ভালোবাসতেন। কিন্তু একই সাথে এটাও বুঝতে পারছিলেন যেসব মুসলমান নিজেদের ধর্মীয় গোষ্ঠীর ভেতর থেকেই সঙ্গী খুঁজছেন, তাদের জন্য ভালো কোন ডেটিং অ্যাপ বাজারে নেই।
“সে সময়ে মুসলমানদের জন্য হয় খুব সাধারণ ধরণের ওয়েবসাইট ছিলো, অথবা ছিলো বড় বড় ডেটিং অ্যাপ যেগুলো ঠিক আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ার মতো ছিলো না,” ম্যানচেস্টার শহরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা শাহজাদ বলছিলেন। “মুসলিম সম্প্রদায়ে আমরা (স্ত্রী বা স্বামী খুঁজতে) ঘটকদের ওপর নির্ভর করতাম।
এখনো অনেকে তাই করেন। এঁরা মূলত আমাদের ‘আন্টি’, যারা সবাইকে চেনেন এবং এক বাড়ির ছেলের সঙ্গে আরেক বাড়ির মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন”।
তাঁর আইডিয়া ছিলো একটি ডিজিটাল ম্যাচমেকার অ্যাপের – সেই সব মুসলমানদের জন্য, যারা বিয়ে করতে পাত্র-পাত্রী খুঁজছে। ভাগ্যেরও এক নিষ্ঠুর পরিহাস – ২০১৩ সালে চাকুরী হারালেন শাহজাদ। আর তখনই তিনি ঠিক করলেন এই অ্যাপ নিয়ে তিনি এবারে মাঠে নামবেন।
“আমি প্রতিদিন সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠতাম আর ঘুমাতে যেতাম রাত ২টায়,” বলছিলেন তিনি। “আমি বাড়িতে শোবার ঘরে বসেই কাজ করতাম। কীভাবে অ্যাপ বানাতে হয়, তা আমি একেবারে শূণ্য থেকে শিখেছি”।
“কিন্তু আমি জানতাম আমাকে ভালো একটি অ্যাপ বানাতে হবে। সুযোগটি বিশাল – পুরো দুনিয়াতে ১৮০ কোটি মুসলমান রয়েছে, কিন্তু এটা স্পষ্ট কেউ তাদের প্রয়োজনের কথা ভাবছে না।”
শাহজাদ ২০১৪ সালে খুব অনাড়ম্বরভাবে অ্যাপটি শুরু করেন। বড় বড় ডেটিং অ্যাপগুলো থেকে তাঁর বিপণন কৌশল ছিলো কিছুটা আলাদা।
“আমি শুক্রবার নামাজের পর মসজিদে যেতাম, আর সবাইকে অ্যাপটির কার্ড দিতাম। এরপর যেকোন মুসলিম পারিবারিক অনুষ্ঠানে গিয়ে গাড়ির কাঁচে কার্ড আটকে দিতাম।” যেকোন ব্যবসা গড়ে তোলা বেশ কঠিন। শাহজাদ বলছেন, তাঁর জন্য এটা বেশ যন্ত্রণাদায়কও ছিলো।
“আমার মনে আছে শুরুতে মাস দু’য়েক আমি প্রায়ই গুগল অ্যানালাইটিকস দেখতাম। দেখতাম এটা জানতে যে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক কত মানুষ অ্যাপটি ব্যবহার করছে,” বলছিলেন তিনি। একদিন তিনি দেখলেন মাত্র ১০ জন মুজম্যাচ ব্যবহার করছেন।
তবে সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি বদলেছে। তিনি দেখেছেন হাজার হাজার মানুষ এটি ব্যবহার করেছে, কারণ মানুষের মুখে মুখে কথা ছড়িয়েছে। লোকজন একটা সময় শাহজাদকে বলা শুরু করলো যে ঠিক কীভাবে তাঁরা তাদের ভবিষ্যত স্ত্রী বা স্বামীকে খুঁজে পেয়েছে।
“আমি যখন এসব সাফল্যের কথা শুনতে পেলাম, তখন আমি বুঝতে পারলাম আমি ঠিক পথে আছি,” বলছিলেন শাহজাদ। “আমি নিশ্চিত হলাম অ্যাপটি দাঁড়িয়ে যাবে”। ব্যবসায়ের অংশীদার রায়ান যোগ দিলেন ২০১৬ সালে। বয়স মাত্র ২৫ হলেও অ্যাপ বানাতে তিনি ছিলেন একজন ঝানু লোক। দু’জনে মিলে তাঁরা ‘মুজম্যাচ’কে নতুন করে সাজালেন।
আরও ২২টি প্রোফাইল প্রশ্ন তাঁরা যোগ করলেন – যেমন একজন ব্যবহারকারী কতটা ধার্মিক, অথবা দিনে কয়বার নামাজ পড়েন। এসব প্রশ্ন ব্যবহারকারীদের কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুজম্যাচ এমন সুযোগ দিয়েছিলো যে ব্যবহারকারীরা চাইলে প্রোফাইল ছবি নাও দিতে পারতেন, অথবা খানিকটা অস্পষ্ট করে দিতে পারতেন। অ্যাপে যে চ্যাট হতো, তা তাদের সম্মতিতে বাবা-মায়ের যেকোন একজন কিংবা একজন অভিবাবকের কাছে পাঠানোর অপশনও এতে ছিলো। শাহজাদ বলছেন, একজন মুসলমান না হলেও রায়ান বুঝতে পেরেছিলেন “অ্যাপটি ঠিক কেমন হবে”।
‘উড লাইক টু মেট’ ডেটিং অ্যাপ ও ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা ইডেন ব্ল্যাকম্যান বলছেন, বিশেষ ধরণের ডেটিং অ্যাপগুলোর সামনের কাতারেই রয়েছে মুজম্যাচ। “যদি ধর্ম এবং ডেটিং ঠিক ঠিক ভাবে মিলে যায় … তাহলে তা হওয়া উচিত পবিত্রভাবে।” মুজম্যাচ তাদের দ্বিতীয় অফিসটি খুলেছে বাংলাদেশে।
তাদের বিজনেস মডেলটিকে বলা হচ্ছে “ফ্রিমিয়াম” – অর্থাৎ বেসিক সার্ভিসটি পাওয়া যাবে বিনামূল্যে, কিন্তু এরচেয়ে বেশি চাইলে মাসে ১০ পাউন্ড করে দিতে হবে। অতিরিক্ত সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে যত খুশী সংখ্যক প্রোফাইল দেখা এবং আপনার নিজের প্রোফাইল আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানো। কোম্পানিটি বলছে, তাদের বাৎসরিক আয়ের পরিমাণ ৪৫ লক্ষ পাউন্ড। শাহজাদ বলছেন, অ্যাপটির জনপ্রিয়তা বেড়েই চলছে, কারণ এর সম্ভাব্য ব্যবহারকারী হলো ৪০ কোটি মুসলমান। “আমাদের কারণে হাজার হাজার বিয়ে এবং বাচ্চা হয়েছে। তাদের কথা ভাবলেই মনে হয় আমাদের শুরুর কষ্ট সার্থক হয়েছে।”