গভীর খাদের কিনারে আরব বিশ্ব

আরব বিশ্ব এক গভীর খাদের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় দ্বিগুণ গতিতে এগোচ্ছে। পানির অভাব ২০৫০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। নিরক্ষরতা ও ভেঙে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থা লক্ষ লক্ষ মানুষকে সেই এআই বিপ্লবের জন্য অপ্রস্তুত করে রেখেছে, যে বিপ্লব ইতোমধ্যেই বিশ্বের অন্য অর্থনীতিগুলোকে রূপান্তরিত করছে। এর মধ্যেই আরব নেতারা কোটি কোটি ডলার সুইস ব্যাংকে পাচার করছেন, নিজেদের পরিবারকে নিরাপদ করছেন, কিন্তু জাতিগুলোকে আসন্ন সংকটের মুখে ফেলে রেখেছেন। এটি ভবিষ্যৎ পতনের ভবিষ্যদ্বাণী নয়বরং ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে যাওয়া পতনের বিবরণ। জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা নিশ্চিত করতে এবং নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জিডিপি’র ৪ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়, কিন্তু দুর্নীতি নিশ্চিত করে যে এ অর্থ কখনোই নিজের গন্তব্যে পৌঁছায় না। এর ফলে কৃষি উৎপাদন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে পারে এবং খাদ্যব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে যেতে পারে।
নিয়তির মতো জলবায়ু বিপর্যয়:
ইরাকে তাপমাত্রা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় সাত গুণ দ্রুত বাড়ছে। সৌদি আরবে ২০৫০ সালের দিকে বছরে প্রায় ২০টি তাপপ্রবাহ দেখা যাবে, প্রতিটি চলবে গড়ে ১০ দিন। উচ্চ নির্গমন পরিস্থিতিতে সৌদি জিডিপি ২০৫০ সালের মধ্যে ১২ শতাংশের বেশি সংকুচিত হতে পারে। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বসরা পর্যন্ত উপকূলীয় শহরগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হুমকির মুখে, অথচ অভিযোজন প্রকল্পগুলো হয় অর্থের অভাবে পড়ে আছে, নতুবা দুর্নীতির কারণে দেরিতে এগোচ্ছে বা অর্থ আত্মসাৎ হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ এক মিটার বাড়লে ৩.২ শতাংশ মানুষ এবং ১.৪৯ শতাংশ জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ নেতারা গড়ছেন বাহুল্যপূর্ণ প্রকল্প, টাওয়ার, দ্বীপ, স্টেডিয়াম—যেগুলো একদিন ডুবে যাবে সেই জলবায়ুর ঢেউয়ে, যার অস্তিত্ব তারা স্বীকারই করেন না।
এআই’র যুগে নিরক্ষরতা:
এআই বিপ্লব আরব সমাজের অপেক্ষায় নেই। পশ্চিমা অর্থনীতিগুলো লজিস্টিকস, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় এআই একীভূত করে উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে। বিপরীতে আরব বিশ্বে নিরক্ষরতার হার প্রায় ২১ শতাংশ—বিশ্ব গড় ১৩ শতাংশের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষ করে নারী নিরক্ষরতার হার ২৬ শতাংশ, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। নিরক্ষরতা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এআই’র যুগে এটি ভবিষ্যতের ওপর এক স্থায়ী তালা। ভিত্তিগত দক্ষতা ছাড়া তরুণ প্রজন্ম ডিজিটাল অর্থনীতি থেকে বাদ পড়বে, বেকারত্ব বা অনিশ্চিত শ্রমের মধ্যে আটকা পড়বে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বছরে প্রায় ২০ শতাংশ হারে শিশু ও তরুণদের মৌলিক সাক্ষরতা অর্জনের সুযোগ কমছে।
দুর্নীতি এই সংকটকে আরও গভীর করছে। এটি শিক্ষার বাজেট লুট করে, শিক্ষকদের কম বেতন দেয়। এতে বিদ্যালয়গুলো ধসে পড়ে এবং অযোগ্য শিক্ষামন্ত্রীরা জানেনই না কী করতে হবে।
দুর্নীতি- ধ্বংসকে ত্বরান্বিতকারী সবচেয়ে বড় শক্তি:
আরব বিশ্ব দরিদ্র নয়, এটি লুটপাটের শিকার। ২০২৪ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর গড় দুর্নীতি স্কোর ছিল ৩৪। বিশ্ব গড় ৪৩–এর চেয়েও কম। মাত্র পাঁচটি দেশ ৫০–এর উপরে পেয়েছে: ইউএই – ৬৮, কাতার – ৫৯, সৌদি আরব – ৫৯, ওমান – ৫৫, বাহরাইন – ৫৩।
স্বৈরাচারী ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ সরকারি ব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতিকে পরিপুষ্ট করেছে। তেল সম্পদ, বৈদেশিক সাহায্য, উন্নয়ন ঋণ—সবই অদৃশ্য হয়ে যায় অফশোর একাউন্টে।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক বারবার বলেছে, জলবায়ু অর্থায়ন এবং এআই’এ বিনিয়োগ করতে হলে স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা জরুরি। কিন্তু আরব অভিজাতদের কাছে এটাই সবচেয়ে বেশি অনুপস্থিত। সুইস ব্যাংকে লুকিয়ে রাখা বিলিয়ন ডলার দিয়ে তৈরি হতে পারত লবণমুক্তকরণ প্ল্যান্ট, এআই গবেষণা কেন্দ্র বা সাক্ষরতা কর্মসূচি। কিন্তু এসব অর্থ ব্যয় হয় প্রাসাদ, ইয়ট ও বিদেশি সম্পদে।
আসন্ন অভিবাসন সুনামি:
আরব উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত ৯ শতাংশ মানুষ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫ মিটার বা এর চেয়ে কম উচ্চতায় বাস করে। ইরাকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত মারাত্মক খরায় ২৩,৩৬৪টি পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি ও খরায় লক্ষ লক্ষ মানুষ বাধ্য হয়ে ঘর ছাড়বে। তারা কোথায় যাবে? ইউরোপ ইতিমধ্যেই সীমান্ত কঠোর করছে। গালফ রাষ্ট্রগুলো নিজেদের অঞ্চলের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের নেবে না। এভাবে আরব বিশ্ব এক স্থায়ী বাস্তুচ্যুতির অঞ্চলে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
মুক্তির নয়, নির্ভরতার এআই:
নিজস্ব কৌশল ছাড়া আরব রাষ্ট্রগুলো এআই ব্যবহার করবে যেমন তারা তেল প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে: আমদানি নির্ভর, ব্যয়বহুল এবং অন্যের নিয়ন্ত্রণাধীন। পশ্চিমা কোম্পানিগুলো ভাষা মডেল, তথ্য শাসন, কম্পিউট শক্তি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। আরব বিশ্ব হবে ভোক্তা, উৎপাদক নয়। উদ্ভাবন থেমে যাবে, নির্ভরতা বাড়বে ও সার্বভৌমত্ব ক্ষয় হবে।
পরিহাস হলো, যে অঞ্চল একসময় বিশ্বকে বীজগণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও দর্শন দিয়েছিল, সেটিই আজ ডিজিটাল উপনিবেশে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে।
লজ্জার আহ্বান:
আরব নেতাদের সামনে সত্যটি তুলে ধরতে হবে, তাদের দুর্নীতি শুধু নৈতিক ব্যর্থতা নয়, বরং অস্তিত্বগত হুমকি। প্রতিটি চুরি হওয়া ডলার মানে, একটি লবণমুক্তকরণ প্ল্যান্ট কম, একটি সাক্ষরতা প্রকল্প কম, একটি এআই ল্যাব কম।
বিদেশে লুকিয়ে রাখা প্রতিটি বিলিয়ন ডলার সেই শিশুদের থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, যারা উত্তরাধিকারী হবে আরও গরম, আরও কঠিন এবং আরও অস্থিতিশীল এক আরব বিশ্বের।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের উপদেষ্টা বলেছেন, “সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো সামাজিক জবাবদিহিতার মেরুদণ্ড। তাদের শক্তিশালী করা উচিত, দমিয়ে রাখা নয়।” আরব বিশ্বে সম্পদের অভাব নেই, অভাব আছে সততার। সতর্কতার অভাব নেই, অভাব আছে ইচ্ছাশক্তির।
উপসংহার-মিলিয়ে যাওয়া দিগন্ত:
বিশ্ব তাপমাত্রা মাত্র ২° সে. বাড়লে ২০৫০ সালে বৈশ্বিক জিডিপি’র ১০–৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে—আরব বিশ্বে এর প্রভাব হবে সবচেয়ে বেশি।
বর্তমান গতিধারায় চললে এই শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এ অঞ্চল হবে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক দরিদ্র, গরম, ক্ষুধার্ত ও অধিক নির্ভরশীল। নেতারা বিদেশে বিলাসে বসবাস করবে, নিরাপদ সম্পদ নিয়ে,
আর দেশগুলো ভেঙে পড়বে জলবায়ুর আঘাত ও প্রযুক্তিগত বঞ্চনার চাপে। আরব বিশ্বের ভবিষ্যত দিগন্ত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি, নিরক্ষরতা ও জলবায়ুর প্রতি অস্বীকৃতির বিরুদ্ধে এখনই পদক্ষেপ না নিলে এ অঞ্চল শুধু পিছিয়েই পড়বে না, ভেঙে পড়বে। -জাসিম আল-আজ্জাবি এমবিসি, আবুধাবি টিভি এবং আলজাজিরা ইংলিসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। তিনি সংবাদ পাঠক, অনুষ্ঠান উপস্থাপক এবং নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বড় বড় সংঘাতময় ঘটনার সংবাদ কাভার করেছেন, বিশ্বনেতাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং বিভিন্ন মাধ্যমে মিডিয়া–সংক্রান্ত কোর্সও পড়িয়েছেন।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button