মাত্র ৬৭ শব্দের চিঠিতে মুসলিমদের দেশটা ইহুদিদের হয়ে গেল

balfourসেমন্তী ঘোষ: এই কিছু দিন আগে লন্ডনে সিনেমাটির প্রথম শো হয়ে গেল, যাকে বলে ‘প্রিমিয়ার’। দর্শকরা সকলে অভিভূত। বিস্মিতও। এত সাংঘাতিক কথাটা যে এত সহজ ভাবে বলা যায়, কেউ কল্পনা করেননি। সিনেমায় দেখা গেল একটি ব্রিটিশ পরিবারের কাহিনি, যাঁদের পদবি ‘জনি’। জনি-দের কাছে এক সকালে সরকারের নোটিস এসে পৌঁছল যে, তাঁদের বাড়ি তাঁদের ছেড়ে দিতে হবে, এ বার থেকে বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে তাঁদের থাকতে হবে, ওই বাড়িটির বাসিন্দা হবেন স্মিথ পরিবার। সরকারি আদেশক্রমে স্মিথেরা এসেও গেলেন যথাসময়ে, জনিরা বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে মাথা গুঁজলেন। ক্রমে দেখা গেল, জনি পরিবারের জন্য কারও কোনও মাথাব্যথা নেই, রাষ্ট্রিয়, সামাজিক কিছুমাত্র বন্দোবস্ত নেই, তাঁরা খাবার-দাবার পান না, স্কুলকলেজ যেতে পারেন না, অসুখ হলে ওষুধবিষুধও পান না, সব রকম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। কাউকে কিছু বলার জায়গাও নেই, কেননা তাঁদের নাগরিকত্বই নেই। ব্রিটেনের সঙ্গে পুরো দুনিয়া মেনে নিয়েছে, এ ভাবেই তাঁদের জীবন কাটাতে হবে, আর তাঁদের এত দিনের সাধের ঘরবাড়ি জুড়ে বিলাসে ব্যসনে বাস করবেন স্মিথেরা। সিনেমাটির নাম? ‘ব্যালফর রোড’।
পৃথিবীর অন্যতম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ‘ব্যালফর ডিক্লারেশন’ ও ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সমস্যার উৎসকে এই ভাবে একটা পাশের বাড়ির গল্পের মধ্য দিয়ে তুলে ধরাটা সত্যিই অসাধারণ। ব্যালফর ডিক্লারেশনের শতবর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবেই এই ছবির প্রদর্শন। এ ঘটনা অনেকেই জানি, তবু চেনাশোনা সাহেবসুবোর নাম দিয়ে ঘটনাটা বর্ণনা না করলে আমাদের মাথায় ব্যাপারটা ঠিকমত ঢোকে না। ‘আমাদের’ তো এটাই মুশকিল। বিপদটা ‘আমাদের’ না হয়ে ‘ওদের’ হলে বিপদের চরিত্র বা গুরুত্ব আমরা কিছুতেই বুঝতে পারি না!
সে দিন ওই ফিল্মের দর্শকরা সকলেই মনেপ্রাণে ইজরায়েল-বিরোধী, প্যালেস্তাইনের সমর্থক, না হলে ফিল্ম শো-টির ধারও মাড়াতেন না তাঁরা। ঠিক যেমন, আজ, ব্যালফর ডিক্লারেশনের শতবর্ষ পালনে যখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে-র ডাকা ডিনারে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু এবং অন্যান্য অভ্যাগতরা ঘর আলো করবেন, গোটা শহর তখন ফেটে প়ড়বে আন্দোলনে বিক্ষোভে। দাবি উঠবে, ডিনার না খেয়ে ব্যালফরের হয়ে ক্ষমা চাক ব্রিটেন। বিরোধী লেবার নেতা জেরেমি করবিন ডিনারের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে প্রতিবাদ জানাবেন। আজও এতটাই তীব্র রাজনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক বিভেদ এই বিষয়কে ঘিরে। এতটাই আক্রমণ, এতটাই রক্তক্ষরণ প্যালেস্তাইনের নামে। আর এই সব কিছুরই সূচনা একশো বছর আগে, ২ নভেম্বর ১৯১৭, ব্রিটিশ ফরেন সেক্রেটারি লর্ড আর্থার জেমস ব্যালফরের (সঙ্গে তাঁর ছবি) লেখা চিঠিটি: ব্যালফর ডিক্লারেশন।
ব্রিটিশ জিউইশ কমিউনিটির নেতা লর্ড রথসচাইল্ডকে সম্বোধন করা ওই চিঠিতে ছিল ৬৭টি মাত্র শব্দ। কিন্তু ওই কয়েকটি শব্দই এক পৃথিবী আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট! প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন। অটোমান তুর্কিরা হেরে গেলে মধ্য-পশ্চিম এশিয়ার ভাগাভাগিটা কেমন হবে, বুঝতে না পেরে তখন হিমশিম খাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জের ব্রিটেন, ক্লেমেন্সুর ফ্রান্স আর প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের আমেরিকা। রাশিয়াও দলে আছে, তবে এমনই কপাল, রুশ বাহিনীর অবস্থা সেই সময় সঙ্গিন। তাদের দেশে তখন রুশ বিপ্লবের বিধ্বংসী উত্থান, মাত্র ক’দিন পর ৭ নভেম্বর রচিত হবে দুনিয়া-কাঁপানো ইতিহাস। এরই মধ্যে মনে হল, জায়নবাদী অর্থাৎ ইহুদি গরিমার ধ্বজাধারীদের তুষ্ট করে পশ্চিম এশিয়ায় প্যালেস্তাইন অঞ্চলটা কবজা করলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রভূত লাভের সম্ভাবনা। সুতরাং, আর দেরি নয়। ইহুদিদের ‘বঞ্চনা’র প্রতিকারে যাঁরা ইহুদি বাসভূমি চাইতেন, সেই জায়নবাদীদের ‘হোমল্যান্ড’ দাবি মেটাতে এ বার তাঁরা উঠে-পড়ে লাগলেন। উদ্ব্যস্ত দ্রুততায় তৈরি হল পরিকল্পনা: তারই প্রথম রূপ মিলল ব্যালফরের চিঠিতে।
ইহুদি হোমল্যান্ড? কোথায় সেটা? কেন, বাইবেল-কথিত ‘হোলি ল্যান্ড’ অর্থাৎ জেরুসালেম -এর চেয়ে ভাল জায়গা আর কী? যদিও তখন তার নাম প্যালেস্তাইন, যদিও তখন সেখানে একগাদা অন্য ধর্মের মানুষ, তাতে কী, সেখানেই হোক ‘ন্যাশনাল হোম ফর দ্য জিউইশ পিপল’! যদিও অন্য লোকগুলো সংখ্যায় বহু বেশি, মোট অধিবাসীর ৯০ শতাংশ, তাতেই বা কী! ব্যালফর বলে দিলেন, ইহুদি বসবাসের ঢালাও ব্যবস্থা হোক, শুধু ‘অ-ইহুদি’গুলির বেশি ঝামেলা না হলেই হল।
না, ঝামেলা আর কিসের! শুরু হল হোমল্যান্ড তৈরির ‘ঝামেলাহীন’ পদ্ধতি, ব্রিটিশ সেনার বন্দুক-বেয়নেটের খোঁচায় ৯০ শতাংশকে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে উৎখাত হতে হল ১০ শতাংশের জন্য, স্মিথদের জন্য জনিদের যেমন করতে হয়েছিল। যুদ্ধ নয়, জাতিদাঙ্গা নয়, কেবল ঠান্ডা মাথার ঔপনিবেশিক ছক নিজ ভূমি থেকে উচ্ছিন্ন হল কয়েক লক্ষ প্যালেস্তিনীয় মুসলমান। দলে দলে ইহুদিরা আসতে শুরু করল নানা দেশ থেকে। নাত্সি ভয়ংকরতার পর বেড়ে গেল নববাসিন্দাদের ঢল, বেড়ে গেল ইহুদিদের প্রতি বিশ্বজোড়া সহমর্মিতা। ইহুদি-অনুকম্পাপ্রবাহের মধ্যে সর্বৈব চাপা পড়ে গেল প্যালেস্তিনীয়দের অবর্ণনীয় দুরবস্থা, তাঁরা যেন ইতিহাসের বলিপ্রদত্ত। ‘ওয়ান নেশন সলেম্নলি প্রমিসড্ টু আ সেকেন্ড নেশন দ্য কান্ট্রি অব আ থার্ড’: ব্যালফর নথি নিয়ে আর্থার কোয়েসলারের অবিস্মরণীয় সেই উক্তি। অসামান্য আত্মদম্ভে ভরপুর এক রাষ্ট্র জন্ম নিল ক্রমে, ১৯৪৮ সালে, যার নাম ইজরায়েল, জাতিবিদ্বেষ যার পরতে পরতে প্রোথিত। প্যালেস্তিনীয়দের জন্য পড়ে রইল কেবল নির্যাতনের বাস্তব, বাস্তবের প্রতিবাদ, প্রতিবাদের সংগ্রাম, সংগ্রামের সন্ত্রাস প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
এক দিক দিয়ে দেখলে ব্যালফর নিমিত্তমাত্র, ইহুদি হোমল্যান্ড তৈরি বৃহত্তর ইতিহাসেরই এক আবশ্যিক ফল। তবু, অন্য দিকটা, মানে, ব্যালফরের চিঠি ও ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকাটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার কুৎসিততম অধ্যায় এই ব্যালফর ডিক্লারেশন। যে অমিত স্পর্ধা আর অলজ্জিত জাতিবিদ্বেষ এই একটি ঘটনার পিছনে রয়েছে, তাতে বলাই যায় যে এমন সচেতন সুপরিকল্পিত অন্যায় মানব-সভ্যতার ইতিহাসে বেশি ঘটেনি। ব্যালফর-এর চিঠির খোঁচায় অত বড় একটা মুসলিম সভ্যতা ‘অ-ইহুদি’ অভিধার অসম্মানজনক কোটরে নির্বাসিত হয়ে গেল, মানুষগুলি আর কোনও দিন ‘পিপল’ বলে স্বীকৃত হতে পারল না, কেননা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভাষায় ইজরায়েল হল, ‘আ ল্যান্ড উইদাউট আ পিপল ফর আ পিপল উইদাউট আ ল্যান্ড।’ ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭, ১৯৬৭ থেকে ২০১৭: হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, নয়তো অলক্ষ্য আগ্রাসনÍ ইজরায়েল ক্রমে নিজেকে বিশ্বের অন্যতম মহাশক্তিধর দেশ হিসেবে মেলে ধরল। তার পিছনে আশ্বাস ও আশ্রয়ের পাখা মেলে দাঁড়িয়ে রইল খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। কার সাধ্য ইজরায়েলকে চটায়! আজও তাই হাতে-গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া কেউ প্যালেস্তাইনের অস্তিত্বটুকু মানতে রাজি নয়। ব্রিটেন তো নয়ই।
ব্যালফর বন্দোবস্তের লকলকে শিখায় আজও পুড়ে খাক হচ্ছে সিরিয়া থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ ভূমি, তার গনগনে আঁচ ছড়িয়ে পড়ছে অস্ত্রের শাণিত ঝলকে, আজীবন প্রতিশোধের রক্তাক্ত শপথে।
টেরেসা মে-রা অবশ্যই এ সব কথা ভুলে গিয়ে আজ রাতে ডিনার খাবেন। হাজার হোক, সাদা সভ্যতার ঔপনিবেশিক দন্ড চালনার মহামুহূর্তের শতবার্ষিকী ডিনার: যে-সে ব্যাপার নয়!
লেখক: ভারতীয় কলামিস্ট।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button