ঐতিহ্যে অবিচল কসাইটুলির ‘চিনির টুকরা মসজিদ’
শতবর্ষ পেরিয়েও নান্দনিকতায় যার জৌলুস কমেনি
মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: রাজধানীর বংশাল রোড দিয়ে কিছুটা পশ্চিম দিকে এগোতেই কসাইটুলির লেনের মুখ। কিন্তু সে গলি এতটাই সরু যে তার মধ্য দিয়ে কোন ধরনের যানবাহন চলাচলের সুযোগ নেই। পায়ে হেঁটে যাওয়াও অনেকটা কষ্টকর। কিন্তু সেই গলির মাথায়ই নান্দনিক এক স্থাপনা। স্থানীয়দের কাছে ‘চিনিটুকরা মসজিদ’ হিসেবে পরিচিত কসাইটুলি লেনের কেপি ঘোষ স্ট্রিটের এ মসজিদটির বয়স শতবর্ষ পেরিয়েছে। নান্দনিকতায় যার জৌলুস কমেনি। ঐতিহ্যে অবিচল কসাইটুলির ‘চিনির টুকরা মসজিদ’।
মসজিদটির ইতিহাস: ১৯১৯ সালে আবদুল বারী বেপারী কসাইটুলিতে আয়তকার তিন গম্বুজের এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। গম্বুজ তিনটি আটকোণা ড্রাম স্ট্রাকচারের উপর স্থাপিত তরমুজের মতো খাঁজকাটা। পুরান ঢাকার কসাইটুলির কে পি ঘোষ রোডে মসজিদটির অবস্থান। সামনের অংশে লেখা আছে ‘কাস্বাবটুলি জামে মসজিদ’। তবে এলাকাবাসীর মুখে মুখে নাম হয়ে গেছে ‘চিনির টুকরা মসজিদ’। চিনির টুকরা মসজিদ নাম হলো কেন? স্থানীয়রা জানালেন, মসজিদের গায়ে চিনামাটির সাদা টুকরাগুলো দেখতে চিনির দানার মতো। স্থানীয় বাসিন্দারা তাই এ নামেই মসজিদটিকে ডাকে এবং চেনে। মূল মসজিদটির ভবনে সমতল কোন ছাদ নেই। ছাদবিহীন মসজিদের প্রতিটি পিলারের মাথায় রয়েছে গম্বুজ। মূল অংশের ছাদে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। তিনটি গম্বুজের মাঝের গম্বুজটি বড় আর দুপাশের দুটির আকার মাঝারি। এছাড়া চার কোণায় রয়েছে চারটি বুরুজ, চারটির কারুকাজ একই ধরনের। হিজরি ১৩৩৮ সনে তৈরি মসজিদটির বয়স ১০০ বছর পেরিয়েছে। এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ঢাকা কোষ থেকে জানা যায়, জনৈক ব্যবসায়ী আবদুল বারি এটি তৈরি করেন। আয়তকার কাস্বাবটুলি জামে মসজিদের ছাদে তিনটি গম্বুজ। চার কোনায় চারটি বুরুজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। গম্বুজ আর বুরুজগুলোর মাথায় পদ্মফুলের নকশা করা তির। ছাদের চারদিক ঘিরে আছে অনেকগুলো টারেট, যা মসজিদের নকশাকে আরও জমকালো করে তুলেছে। তবে মসজিদটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো ‘চিনিটিকরির কারুকাজ’। ভেতর-বাইরের দেয়ালে চিনিটিকরি পদ্ধতির মোজাইকে নকশা করা। চিনামাটির ভাঙা টুকরা আর রঙিন কাচ দিয়ে গোলাপের ঝাড়, আঙুরের থোকা, ফুলদানির ছবি ফুটে উঠেছে মসজিদের দেয়ালে-খিলানে। ভেতরের মিহরাব (কিবলামুখী কুলুঙ্গি) ও এর আশপাশের নকশা সবচেয়ে রঙিন ও জমকালো।
মসজিদের জায়গার সম্প্রসারণ: মসজিদটির মূল বৈশিষ্ট্য হল এতে করা ‘চিনিটিকরির কারুকাজ’। এই কারুকাজ মুঘল স্থাপত্য রীতি। একতলা মূল মসজিদটি প্রায় দুই কাঠা জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। পরে পেছনে তিনতলা পর্যন্ত এর সম্প্রসারণ হয়েছে। মসজিদ কমিটি জানান, পুরোনো মসজিদে মুসল্লিদের স্থানসংকুলান না হওয়ায় ধাপে ধাপে এর আকার বাড়ানো হয়েছে। তবে মূল মসজিদের কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। এখন প্রায় বারো’শ মুসল্লি একসঙ্গে এখানে নামাজ পড়তে পারেন। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, মসজিদের আর আগের জৌলুস নেই। আমদের শৈশবের এই মসজিদ আরও ঝকঝক করতো। এখন আর তেমন নাই। আজ থেকে প্রায় একশ’ বছর আগে পুরান ঢাকায় ছিল না এত ঘনবসতি। ফলে ছোট হলেও তখন পূরণ হতো মুসল্লিদের চাহিদা। ধীরে ধীরে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে মসজিদের ধারণক্ষমতা কমে যায়। এ কারণে ১৯৭৯ সালে কারুকার্যে কোনো পরিবর্তন না করে মসজিদ সংস্কার করা হয়। ফলে মূল ভবনের ভেতরটা আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এলাকাবাসীর সহায়তায় কয়েক বছর আগে মূল মসজিদের পূর্ব ও উত্তরে সম্প্রসারণ করা হয়। মূল মসজিদটি একতলা হলেও বর্ধিত অংশটি হয় তিনতলা। বর্তমানে এটি প্রায় পাঁচ কাঠা জায়গায় অবস্থিত। নতুন অংশের পুরোটাই উন্নতমানের টাইলস দ্বারা ঢেকে রাখা হয়েছে।
এক সময় পুরনো ঐতিহ্যবাহী ‘চিনির টুকরো’ মসজিদের আশপাশে তেমন বাড়িঘর ও দোকানপাট ছিল না। শুরু থেকে আশির দশকের শেষ দিকেও অনেক বিদেশি পর্যটক আসতেন এই মসজিদ দেখতে। শুধু তা-ই নয়, ৩০ বছর ধরে বিটিভির আজানের সময় এ মসজিদের দৃশ্য দেখানো হতো।
মসজিদের কারুকার্য: শতবর্ষী মসজিদের দেয়ালের কিছু অংশে মোজাইক উঠে গিয়ে ভেতরের লাল ইট উঁকি দিচ্ছে। কোথাও কোথাও ফিকে হয়ে গেছে কাচের নীল-সবুজ রং। তবে পুরনো আমলের কাঠের দরজায় ও বারান্দার ছাদের কাঠের চেহারা সহজেই মনে করিয়ে দেয় পুরনো স্মৃতি। এক সময় পুরনো ঐতিহ্যবাহী ‘চিনির টুকরো’ মসজিদের আশপাশে তেমন বাড়িঘর ও দোকানপাট ছিল না। শুরু থেকে আশির দশকের শেষ দিকেও অনেক বিদেশি পর্যটক আসতেন এই মসজিদ দেখতে। শুধু তা-ই নয়, ৩০ বছর ধরে বিটিভির আজানের সময় এ মসজিদের দৃশ্য দেখানো হতো। সে সঙ্গে ‘কাস্বাবটুলী মসজিদ’-এর ছবি দিয়ে বের হয়েছে ‘ভিউকার্ড’। ফলে এর সুনাম অক্ষুণ রয়েছে। এলাকাবাসীর একান্ত চেষ্টায় ওয়াক্ফ সম্পত্তির ওপর গড়ে ওঠা মসজিদটি ধরে রেখেছে এর ঐতিহ্য। এছাড়া মসজিদটির ছয়টি ছোট ও দুটি জোড়া পিলারের দুটি গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজগুলোর উচ্চতা ৫-১২ ফুট। মসজিদটির মূল বৈশিষ্ট্য হলো এতে করা ‘চিনিটিকরির কারুকাজ’। মূল ভবনের ভেতরে ও বাইরের দেয়ালসহ সম্পূর্ণ জায়গায় চিনিটিকরি পদ্ধতির মোজাইক দিয়ে নকশা করা হয়েছে। চিনামাটির ভাঙা টুকরা আর রঙিন কাচ দিয়ে গোলাপ ঝাড়, আঙুরের থোকা, ফুলদানির ছবি মসজিদের দেয়ালে-খিলানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মসজিদের ভেতরের মিহরাব ও মিহরাবের আশপাশের নকশাগুলি হচ্ছে সবচেয়ে’ রঙিন ও জমকালো।
মসজিদ পরিচালনা: কসাইটুলি পঞ্চায়েত ও মসজিদ কমিটি মিলে এ মসজিদের দেখভাল করে। কমিটির কয়েকজন সদস্য জানান, এক ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত খরচে সাত-আট বছর আগে ভেতরের অংশের সংস্কার করা হয়েছে। তবে বাইরের অংশের সংস্কার সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, ‘বিটিভির আজানের যে কণ্ঠ এই মসজিদের মোয়াজ্জিন ছিলেন। মসজিদটি দেখতে এখনো দেশী-বিদেশী পর্যটক ও ভ্রমণ পিপাসুরা ভীড় জমায়। সরকার যদি সহায়তা করে তাহলে মসজিদের এই ঐতিহ্য টিকবে। কেননা পুরা মসজিদ সংস্কারের অর্থ তো পঞ্চায়েতের নাই। এ জন্য এই এলাকার মুসল্লিরা মসজিদটির ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহায়তা কামনা করেছেন। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মসজিদটি সকাল থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্তই জমজমাট থাকে। মুসল্লীরা নামাজ আদায় ছাড়াও বসে জিকির বিভিন্ন আমল করেন, বয়ান শোনেন। তবে কমিটির নিষেধাজ্ঞা থাকায় রাত সাড়ে দশটার পর থেকে মসজিদের কর্মচারী ছাড়া আর কেউ থাকতে পারেন না। মসজিদটির স্থায়ী কর্মচারী হিসেবে এক জন ইমাম, এক জন মুয়াজ্জিন এবং তিনজন খাদেম। তাদের বেতন মসজিদ পরিচালনা কমিটির মাধ্যমেই দেওয়া হয় বলে জানালেন মসজিদটির মুয়াজ্জিন। মসজিদে টাঙানো বোর্ড থেকে জানা যায়, মসজিদটি পরিচালনায় ২১ সদস্যের কমিটি রয়েছে। ইমাম-মুয়াজ্জিন-খাদেমের বেতনসহ মসজিদ পরিচালনার সমস্ত ব্যয় এই কমিটির মাধ্যমেই নির্বাহ করা হয়।