৩০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন দরে বিক্রি হয়েছে চামড়া

# সরকার নির্ধারিত মূল্য মানেনি কেউ # হাজার কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত গরীব-এতিমরা

এইচ এম আকতার: কুরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার দাম এ বছর একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও কম দামে চামড়া কেনা-বেচা হচ্ছে। গত ৩০ বছরের মধ্যে এবারই সর্বনিম্ন দামে বেচাকেনা হয়েছে পশুর চামড়া। ফড়িয়া বা মওসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর আগে কখনও এত কম দামে চামড়া কিনতে পারেননি তারা। ট্যানারি মালিকরাও বলছেন, গত তিন দশকে চামড়ার দাম এত কমেনি।

চামড়া শিল্পের এ অবস্থার জন্য কে দায়ী? গত দশ বছর আগেও একটি গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২২০০-২৫০০ টাকা। তা এ বছর বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩০০-৫০০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশী-বিদেশীচক্র এ শিল্পকে ধ্বংস করছে। সরকার গায়ের জোরে সাভারে ট্যানারিশিল্প স্থানান্তর করলেও এখনও তা প্রস্তুত নয়। ১৫২টি কারখানার মধ্যে পুরোপুরি উৎপাদনে সক্ষম মাত্র ১০/১২টি ট্যানারি। আর ৪০টির মত কারখানা রয়েছে যারা এখন শুধু ওয়েট-ব্লু’র কাজ করছে। আর এ কারণে ট্যানারি মালিকরা চামড়া কিনছে না।

ব্যাংক থেকে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েও তারা চামড়া কিনতে পারছে না। কারণ কারখানা এখনও উৎপাদনে সক্ষম নয়। আর এ কারণেই ফড়িয়া এবং মধ্য স¦ত্বভোগীরা চামড়া কিনে বিপাকে পড়েছে।

ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, চামড়ার দাম এত কম এর আগে কখনও হয়নি। বিগত তিন দশক পর এখন চামড়ার দাম সর্বনিম্ন। এ অবস্থার জন্য তিনি রফতানি পরিস্থিতিকে দায়ী করেন।

সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, একদিকে এখান থেকে বিদেশী ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বিশেষ করে চীনের ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। অন্যদিকে চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজারও ভালো নয়।’

জানা গেছে, ঢাকায় কুরবানির গরুর প্রতিটি ২০ থেকে ৩৫ বর্গফুট চামড়া লবণ দেয়ার পরে ৯০০ থেকে এক হাজার ৭৫০ টাকায় কেনার কথা ট্যানারি মালিকদের। তবে রাজধানী ঘুরে দেখা গেছে, এবার ফড়িয়া বা মওসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা গড়ে ৫০০ টাকায় চামড়া কিনেছেন। আর রাজধানীর বাইরে দেশের অন্যান্য স্থানে চামড়া কেনা-বেচা হয়েছে গড়ে ৪০০ টাকায়।

রাজধানীর ফড়িয়া বা মওসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদের ১২ থেকে ২৫ বর্গফুটের প্রতিটি চামড়া ৭০০ থেকে দেড় হাজার টাকার মধ্যে কিনতে পরামর্শ দিয়েছেন ট্যানারি মালিকরা। আর ঢাকার বাইরে ১২ থেকে ২৫ বর্গফুটের চামড়া ৩০০ থেকে ৯০০ টাকার মধ্যে কেনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

মওসুমী চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের এক হাজার ২০০ টাকায় যে চামড়া কিনতে হয়েছে, এবারের ঈদে তার চেয়ে বড় ও ভালো মানের চামড়া পাওয়া গেছে ৫০০ টাকায়।

দেড় লাখ টাকায় কেনা কুরবানির গরুর চামড়া বেচা হয়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায়। আর এক লাখ টাকা দিয়ে কেনা গরুর চামড়া ৫০০ টাকাতেও বেচতে দেখা গেছে।

রাজধানীর মানিক নগর এলাকার মওসুমী চামড়া ব্যবসায়ী রোকন বলেন, গড়ে সাড়ে ৫০০ টাকায় আমরা চামড়া কিনছি। তিনি ২৫৬টি পশুর চামড়া কিনে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে নিয়ে যান।

পাবনার ভাঙ্গুড়ার মওসুমী চামড়া ব্যবসায়ী রইচ উদ্দিন বলেন, ঢাকার বাইরেও চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। এখানেও সবচেয়ে ভালো চামড়া ৫০০ টাকারও কম দামে কেনা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, ৩০ বছর আগে ১৯৮৯ সালে কুরবানির ঈদে পশুর মালিকরা ৭০০ টাকায় চামড়া বেচেছেন। এবার সেই মানের চামড়া কেনা সম্ভব হয়েছে ৫০০ টাকারও কম দামে।

২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম ধরা হয়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। এ বছর সেই চামড়া সর্বোচ্চ ৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে দাম ধরা হয়েছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মওসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের ঈদে সবচেয়ে ভালো চামড়া সংগ্রহ করা গেছে ৪০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। তারা বেশির ভাগ চামড়া কিনেছে ৫০০ টাকারও কম দামে।

সরকারের বেঁধে দেয়া দাম অনুযায়ী, ট্যানারি ব্যবসায়ীরা এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনবেন ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় এবং ঢাকার বাইরে এর দাম হবে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। এছাড়া সারাদেশে খাসির চামড়া ১৮-২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকায় সংগ্রহ করবেন ব্যবসায়ীরা।

কিন্তু সরকার নির্ধারিত মূল্যে কোথায়ও চামড়া বিক্রি করতে পারেনি কুরবানি দাতারা। এতে করে গরিব ও এতিমরা তাদের হক থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এ চামড়ার টাকা সারা বছর এমিতদের খাবার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা হয়ে থাকে। এ বছর প্রতিষ্ঠান চালানো তাদের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য হবে।

গত বছর প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা ও লবণজাত চামড়ার দাম ঢাকায় ৫০-৫৫ টাকা ধরা হয়। ঢাকার বাইরে সারাদেশে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয় ৪০-৪৫ টাকা। এছাড়া মহিষের প্রতি বর্গফুট চামড়া ৪০ টাকা, খাসির ২০-২২ টাকা এবং ছাগল ও ভেড়ার ১৫-১৭ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়।

জানা গেছে, পাইকারি চামড়া ব্যবসায়ীরা লবণসহ সব ধরনের খরচ মেটানোর পর কাঁচা চামড়া আড়তদারদের কাছে পৌঁছান। ট্যানারিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই চামড়া মূলত আড়তদারদের কাছে সংরক্ষিত থাকে। আড়তদার প্রতিপিস ৩৫ টাকা লাভ রেখে ট্যানারিতে চামড়া পৌঁছান। যদিও ট্যানারি পর্যন্ত পৌঁছানোর খরচও বহন করতে হয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের। ট্যানারির মালিকরা সেই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিভিন্ন পণ্য বানান। এসব পণ্য বিদেশেও রফতানি করা হয়।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে সারাদেশ থেকে কমবেশি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এর অর্ধেকের বেশি আসে কুরবানির ঈদের সময়।

বাংলাদেশ হাইড এন্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি হাজী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, গত কয়েক বছরে চামড়ার দাম এত কম দেখিনি। নির্ধারিত দামের চেয়েও কম দামে বেচাকেনা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এটা অস্বীকার করার মত নয় যে, গত তিন দশকে কাঁচা চামড়ায় দাম এত কম দেখিনি। তবে দাম হওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো, কয় মাস পরই জাতীয় নির্বাচন। তাই প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় ভোটারদের তুষ্ট করতে পশু কুরবানি দিয়েছে। গত বছরের চেয়ে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ পশু বেশি জবাই হয়েছে।

লক্ষীপুরের মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী সেলিম উদ্দিন বলেন, গ্রামে দাম একেবারেই কম। বড় বড় চামড়া ৪শ থেকে ৫শ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে। তিনি বলেন, গত ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এত কম দামে চামড়া কিনতে পারিনি।

তবে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, কুরবানির সময় চামড়া ও এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা সিন্ডিকেট করে দাম কমান। গত দুই তিন মাসে চামড়ার দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কুরবানির চামড়ার প্রকৃত দাবিদার দেশের এতিম-মিসকিনরা। কিন্তু সিন্ডিকেট করে এতিম-মিসকিনদের বঞ্চিত করা হলো।

গত বছর প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা ও লবণজাত চামড়ার দাম ঢাকায় ৫০-৫৫ টাকা ধরা হয়। ঢাকার বাইরে সারাদেশে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয় ৪০-৪৫ টাকা। এছাড়া মহিষের প্রতি বর্গফুট চামড়া ৪০ টাকা, খাসির ২০-২২ টাকা এবং ছাগল ও ভেড়ার ১৫-১৭ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়।

প্রসঙ্গত, কুরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে সারাদেশে কয়েক লাখ মওসুমী ব্যবসায়ী চামড়া কেনেন। কয়েক হাজার পাইকারি ব্যবসায়ী এই চামড়া তাদের কাছ থেকে কিনে আড়ৎদারদের কাছে জমা রাখেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button