নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ব্যর্থ বিশ্ব

guterresচলতি মাসের শুরুতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফর করেছেন। সরেজমিন ঘুরে দেখেছেন মিয়ানমারে সেনা নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি। তাদের মুখে শুনেছেন রোমহষর্ক নিযার্তনের বণর্না। ফিরে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে একটি নিবন্ধ লিখেছেন, যার বাংলা ভাষান্তর তুলে ধরা হলো।
ছোট ছোট শিশুদের তাদের বাবা-মায়ের সামনে হত্যা করা হয়েছে। মেয়ে শিশু ও নারীদের দলবেঁধে ধষর্ণ করা হয়েছে; পরিবারের সদস্যদের অত্যাচারের পর হত্যা করা হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক হত্যাকান্ড এবং সহিংসতার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে গত সপ্তাহে হাড় কাপানো যেসব ঘটনা আমি শুনেছি, তার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত থাকা সম্ভব ছিল না। সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য তার বড় ছেলেকে নিজের সামনে গুলি করে হত্যা করার বণর্না দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন, ওই লোকের মাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং তার বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়। তিনি মসজিদে আশ্রয় নিলেও মিয়ানমার সেনারা সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং কোরআন পুড়িয়ে দেয় তারা।
সঠিকভাবেই পরিচিত ‘জাতিগত নিধনের’ শিকার এসব মানুষ এমন যন্ত্রণা ভোগ করছে যা একজন প্রত্যক্ষদশীর্র মধ্যে শুধু বেদনা ও রাগই উসকে দিতে পারে। তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বোঝার অতীত, তবু এটাই ১০ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর জন্য বাস্তবতা। রোহিঙ্গারা এমনি নিযার্তনের শিকার যে নিজ দেশ মিয়ানমারে নাগরিকত্ব থেকে শুরু করে নিতান্ত মৌলিক মানবাধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভেতরে ত্রাস ঢুকিয়ে দিতে গত বছর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী পদ্ধতিগতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল ভয়ংকর দুটি বিকল্প বাছাইয়ে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেয়া; মৃত্যুর ভয় নিয়ে অবস্থান কর নয়তো বেঁচে থাকার জন্য সব কিছু ছেড়ে চলে যাও।
নিরাপত্তার সন্ধানে দুবির্ষহ যাত্রা শেষে এসব উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশের কক্সবাজারে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। এটা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট। সীমিত সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। তারপরও বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের সীমান্ত ও হৃদয় খুলে দিয়েছে, যেখানে বৃহত্তর ও সম্পদশালী দেশগুলো বাইরের মানুষের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের মমত্ববোধ ও উদারতা দেখিয়ে দিয়েছে মানবতার সবোর্চ্চ রূপ এবং হাজারো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। কিন্তু এই সংকটের অবশ্যই বৈশ্বিক সমাধান করতে হবে।
প্রাণ হাতে নিয়ে পালানো মানুষের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশের মতো সামনের সারির দেশগুলো যাতে একা হয়ে না যায় তার জন্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো শরণার্থী বিষয়ে একটি বৈশ্বিক চুক্তি চূড়ান্ত করছে। তবে এখনকার জন্য জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলো পরিস্থিতির উন্নয়নে শরণাথীর্ ও আশ্রয়দাতা দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। কিন্তু দুযোর্গ এড়াতে আরও সম্পদ জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। সেই সঙ্গে শরণার্থী সংকটে বৈশ্বিকভাবে দায়িত্ব ভাগ করে নেয়ার যে নীতি তাকেও আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
১০০ কোটি ডলারের আন্তজাির্তক মানবিক সহায়তার আহ্বানের বিপরীতে মাত্র ২৬ শতাংশ তহবিল জোগাড় হয়েছে। এই ঘাটতির অর্থ শরণার্থী শিবিরে অপুষ্টি বিদ্যমান। এর অথর্ হলো পানি ও স্যানিটেশনের সুযোগ আদশর্ অবস্থা থেকে অনেক দূরে। এর অর্থ আমরা শরণার্থী শিশুদের মৌলিক শিক্ষা দিতে পারছি না। শুধু তাই নয়, বষার্কালের তাৎক্ষণিক ঝুঁকি মোকাবেলায় পদক্ষেপগুলোও অপযার্প্ত। আশ্রয় নেয়া শরণাথীের্দর তাড়াহুড়ো করে তৈরি বস্তিগুলো এখন ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিকল্প জায়গা খুঁজে আরও জোরালো আশ্রয়স্থল নিমার্ণ নিতান্ত জরুরি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অনেক কিছুই করা হয়েছে। তবু মারাত্মক ঝুঁকি রয়ে গেছে, সংকটের সামগ্রিক পরিসরের কারণে।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের সঙ্গে আমি বাংলাদেশ সফর করেছি। রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আশ্রয়দাতাদের সহায়তায় ব্যাংক থেকে ৪৮০ মিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। তারপরও আন্তজাির্তক মহল থেকে অনেক অনেক সহায়তা দরকার। শুধু সংহতি জানালেই হবে না রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন বাস্তব সহায়তা। মিয়ানমারে এতো নিযার্তন সহ্য করার পরও কক্সবাজারে আমার দেখা রোহিঙ্গারা আশা ছেড়ে দেয়নি। ‘আমরা চাই মিয়ানমারে আমাদের নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব দেয়া হোক। আমাদের বোন, কন্যা ও মায়েদের যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তার বিচার আমরা চাই,’ ধষের্ণর ফলে জন্ম নেয়া নিজ শিশুকে বুকে নিয়ে থাকা এক মাকে দেখিয়ে বললেন বিপযর্স্ত কিন্তু দৃঢ়চেতা এক নারী। রাতারাতি এই সমস্যার সমাধান হবে না। একইভাবে এই পরিস্থিতি অনিদির্ষ্টকালের জন্য চলতে দেয়াও যায় না। মিয়ানমারকে অবশ্যই পূর্ণ অধিকার এবং নিরাপদ ও মযার্দাপূর্ণ জীবনের প্রতিশ্রুতিসহ শরণার্থীেদের ফিরে যাওয়ার জন্য উপযোগী পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। এর জন্য দরকার ব্যাপক বিনিয়োগ- এটা শুধু মিয়ানমারের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলের সব জনগোষ্ঠীর জন্য পুন:নিমার্ণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেই নয়, পুনর্মিলন ও মানবাধিকারের জন্য শ্রদ্ধাবোধ ফেরানোর জন্যও দরকার। রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার গোড়ার কারণগুলো খুঁজে বের করে সামগ্রিক সমাধান না করা হলে দুদর্শা ও ঘৃণা সংঘাতে ঘৃতাহুতি দেবেই। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিস্মৃত ভুক্তভোগীতে পরিণত হতে পারেন না। সহায়তার জন্য তাদের জোরালো আবেদনে আমাদের অবশ্যই সাড়া দিয়ে কাজে নামতে হবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button