আরব গণতন্ত্রের প্রতি আঘাত

abdul bariড. মুহাম্মদ আবদুল বারী:
মিসরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির উৎখাতের ঘটনায় আরব বিশ্বের উচিত শোকাহত হওয়া, আর পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক বিশ্বের উচিত এর নিন্দা করা। এটা কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়, এটা প্রতিষ্ঠানের প্রশ্ন। মনে রাখতে হবে, আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির প্রতিনিধিত্ব করতে নির্বাচিত হয়েছিলেন মুরসি। অদূরদর্শী বিরোধীদের সমর্থনপুষ্ট মোবারকপন্থী জেনারেলরা এখন দেশকে বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত করেছেন। মিসরের গণতন্ত্রকে রক্ষার বদলে জেনারেলরা দেশের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করার অভিলাষে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিরোধীদের সাথে তাল মিলিয়েছেন। প্রতিবেশী দেশ আলজেরিয়ার জেনারেলরাও মাত্র ২০ বছর আগে প্রায় একই কাজ করেছিলেন। ইসলামি গ্রুপকে ক্ষমতায় আনার সম্ভাবনা সৃষ্টিকারী নির্বাচন তারা বাতিল করে দিয়েছিলেন। ফরাসি সমর্থনপুষ্ট আলজেরীয় জেনারেলদের পক্ষে গণরায় হজম করা সম্ভব ছিল না। তাই তারা জনগণের বিরুদ্ধে বন্দুক তাক করেছিলেন। এর ফল ছিল সহিংস চরমপন্থীদের মৃত্যু ও ধ্বংস, যা কেবল সামরিক বাহিনীর সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। আলজেরিয়াকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ছিনতাই করে নিয়েছিল কালো রাজনীতি। ঐতিহাসিক জাতি হিসেবে আরব ও মুসলিম বিশ্বের কাছে মিসর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মিসরের সামরিক বাহিনী ৩ জুলাই যে বিপজ্জনক পদক্ষেপটি নিয়েছে, তার পরিণাম হতে পারে মারাত্মক। মিসর অন্ধকার যুগে ফিরে যাক তা সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষেই কামনা করা সম্ভব নয়। মোহাম্মদ মুরসি মাত্র এক বছর আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার নতুন প্রাপ্ত ক্ষমতা সম্পর্কে তার ধারণা ছিল না। সেই সাথে মিসরের সামরিক বাহিনী ও বিচার বিভাগ তার এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস বাধাগ্রস্ত করছিল। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হয়েছিল তাকে। তার সামনে আসা সব সমস্যাই ছিল বিশাল ও জটিল। মিসরের সামরিক বাহিনী বিপুল রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। জাতীয় বাজেটের ৪০ শতাংশই ব্যয় হয় তাদের পেছনে। অথচ মিসরীয় জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলেও সে দিকে তাদের কোনোভ্রƒক্ষেপ নেই। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বাজেট, অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি কিংবা সেনাবাহিনী প্রশ্নে মুরসিকে তার প্রাপ্য ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে আসছিল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিষদ (এসসিএএফ)। অনেক পর্যবেক্ষক এটাকে সামরিক বাহিনীর সাংবিধানিক অভ্যুত্থান হিসেবে অভিহিত করে আসছিলেন। আর কোনো উপায় না দেখে কিংবা খুব সম্ভবত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার অভাবে মুরসি তার প্রেসিডেন্টীয় কর্তৃত্ব প্রয়োগের লক্ষ্যে গত বছর পুরনো আমলের প্রহরীদের এক পাশে সরিয়ে দিয়েছিলেন। বলাই বাহুল্য, এটা তার বিরোধীদের ুব্ধ করেছিল, রাজনৈতিক বিভাজনে আরো বেশি মেরুকরণ ঘটেছিল। মিসরের অসহিষ্ণু সেকুলার গ্রুপগুলো এবং মোবারক সমর্থকদের নিয়ে গঠিত শিথিল জোট ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট (এনএসএফ) তখন দেশজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ শুরু করে। মুরসিবিরোধী বিক্ষোভ সহিংসতায় নিমজ্জিত হয়, মুসলিম ব্রাদারহুডের কয়েকটি অফিসও জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মুরসি দৃশ্যত আপসরফার কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিরোধীরা কঠোরভাবে তাকে প্রত্যাখ্যান করে। মোহাম্মদ আল বারাদি, যিনি বেশির ভাগ সময় পাশ্চাত্যে বাস করতে পছন্দ করেন এবং গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন, মুরসিকে ‘নতুন ফেরাউন’ হিসেবে অভিহিত করেন। ‘ইসলামপন্থী’ প্রেসিডেন্টের প্রতি সেকুলার রাজনীতিবিদদের অপছন্দের মাত্রাটা এমনই। মিসরের এই অভ্যুত্থানে আরব ও মুসলিম বিশ্বে কী পরিণাম সৃষ্টি হবে কিংবা বৈশ্বিক শান্তিতে কী প্রভাব ফেলবে তা বলার সময় এখনো হয়নি। তবে যা-ই হোক না কেন, ২০১৩ সালের ৩ জুলাই কালো দিবস হিসেবেই বিরাজ করবে। মিসরের সামরিক শাসকেরা ইসলামপন্থী, বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুডের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার, নির্যাতন, হত্যা, নির্বাসিত করেছে। কারাগারে কেউ কেউ সহিংস চরমপন্থীতে পরিণত হয়েছিলেন। আরব বিশ্বের ধর্মীয়-রাজনৈতিক কার্যক্রমের সূচনাকারী আন্দোলন ব্রাদারহুড ইতিহাসের নানা পর্যায় অতিবাহিত করেছে। তবে ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক পন্থাই গ্রহণ করে নিয়েছে, বিভিন্ন আঙ্গিকে অনেকটা পাশ্চাত্যের মডেলই অনুসরণ করছে। বিশ্বের অনেকে, বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে মূলধারার মুসলিম ব্যক্তিত্বরা এটাকে খুবই ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। গত বছর মুরসির বিজয়কে সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্রায়নের দুর্দান্ত বিজয় বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু এখন সেটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। মুরসি এবং তার দল যে বেশ কিছু ভুল করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মিসর ও বহির্বিশ্বের মিডিয়া সেসব কিছু নিয়ে অতিরঞ্জন করেছে। ব্রাদারহুডের প্রতি সামরিক বাহিনীর বিদ্বেষের বিষয়টি খাটো করে দেখা তার উচিত হয়নি। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি যে পতনোন্মুখ অর্থনীতি হাতে পেয়েছিলেন, সেটা ঠিক পথে চালিত করতে তার আরো শক্তি ব্যয় করা উচিত ছিল। তার দরকার ছিল চাকরি সৃষ্টি, বেকারত্ব দূর করা, বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানো, পর্যটন শিল্পকে চাঙ্গা করা, জ্বালানিসঙ্কট মোকাবেলা করাসহ বিভিন্ন কাজে আরো সময় দেয়া। কিন্তু রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস অনেক ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছে। মিসরের বিরোধী দল হয়তো এখন অপরিণতভাবে তার অপসারণে সন্তুষ্ট হয়েছে, কিন্তু আসন্ন বাস্তবতা তাদের ভয়াবহভাবে আঘাত হানবে। দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, দুর্নীতি, রাজনৈতিক সহিংসতা ও দাসত্বমূলক পররাষ্ট্রনীতির পর ‘আরব বসন্ত’ মধ্যপ্রাচ্যে আশার আলো দেখিয়েছিল। কিন্তু এখন তা আবারো অনিশ্চিত গন্তব্যে প্রবেশ করছে। সিরিয়া এখন ছায়াযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত; উপসাগরীয় দেশগুলোতে মানবাধিকার পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। এমন এক সময়েই মিসরের সামরিক বাহিনী দেশটিকে আরেকটি রাজনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে ফেলল। আমরা এখন কেবল এই আশাবাদ ব্যক্ত ও প্রার্থনা করতে পারি যে মিসর এই ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে।
-(শিক্ষাবিদ, লেখক ও ফ্রিল্যান্স প্যারেন্টিং কনসালট্যান্ট ড. মুহাম্মদ আবদুল বারী মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের সাবেক মহাসচিব (২০০৬-১০) তিনি এলওসিওজি বোর্ডেরও অনির্বাহী সদস্য ছিলেন)
অনুবাদ : হাসান শরীফ

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button