অস্তিত্ব সংকটে পুঁজিবাজারের ৯০ শতাংশ বিনিয়োগকারী

DSEএইচএম আকতার: তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছে না দেশের প্রধান দুই পুঁজিবাজার। দীর্ঘদিনের বাজার মন্দা, ঘন ঘন নতুন কোম্পানির আইপিও অনুমোদন, চক্রবৃদ্ধির সুদসহ মার্জিন ঋণ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অর্থ আটকে যাওয়ার কারণে তারল্য সংকটে দীর্ঘ হচ্ছে। ফোর্সসেল (জোরপূর্বক বিক্রি) করেও বাজারে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে না সিকিউরিটিজ হাউজগুলো। এতে করে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে ৯০ শতাংশ বিনিয়োগকারী।
একদিকে মার্জিন ঋণের যাঁতাকলে বিনিয়োগকারীরা আটকে রয়েছে অন্যদিকে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারের নিজস্ব বিনিয়োগ ও প্রদত্ত মার্জিন ঋণ আদায় করতে হিমশিম খাচ্ছে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না বলে মনে করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে একটানা দরপতনে সহস্রাধিক বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও ফোর্স সেলের স্ট্যাটাসে চলে এসেছে। আর এ অবস্থায় সিকিউরিটিজ হাউজগুলো ফোর্সসেল করা শুরু করলে একসঙ্গে নিঃস্ব হয়ে যাবেন শেয়ারবাজারের প্রায় ৯০ শতাংশ বিনিয়োগকারী। অন্যদিকে বাজারের এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে হাউজগুলো ফোর্সসেল না করলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে না। তাই ফোর্সসেল নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে হাউজ এবং বিনিয়োগকারীরা। এ অবস্থায় পর্যাপ্ত অর্থের তহবিলের জোগান দেয়া হলে বিনিয়োগকারী ও হাউজ কর্তৃপক্ষ উভয়ই টিকে থাকতে পারবেন বলে মনে করছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, পুঁজিবাজারে বর্তমানে ২ হাজার গ্রাহককে ১৫ হাজার কোটি টাকার মার্জিন ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘন করে ৩০ থেকে ৫০ জন গ্রাহককে ৩০ থেকে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোর দেয়া মার্জিন ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। মার্চেন্ট ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত মার্জিন ঋণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকেই দেশের দুই পুঁজিবাজারে ক্রান্তিকাল চলছে। ইতোমধ্যে ৪ বছর অতিবাহিত হলেও বাজার স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ডিএসই’র সাধারণ সূচক ছিল ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্ট। অন্যদিকে বর্তমান বাজারের সূচক ৪ হাজারের মধ্যে উঠানামা করছে। অথচ এর মধ্যে অনেক তালিকাভুক্ত কোম্পানি স্টক ডিভিডেন্ড ও রাইট শেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আবার বিপুল পরিমাণ নতুন কোম্পানির শেয়ারও যুক্ত হয়েছে।
জানা যায়, ডিসেম্বর ২০১০ থেকে এ পর্যন্ত বাজারে উত্থান-পতনের ব্যবধান বেশি না হলেও পরিমাণের দিক দিয়ে সূচক কমেছে ৫ হাজারের বেশি। এর মধ্যে বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণ পুঁজি হারিয়েছেন। যখনই বাজার একটু ঊর্ধ্বমুখী থাকে তখনই বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকে পড়েন বাজারে। কিন্তু বিনিয়োগ করার পরপরই আবার বাজারে ঘটে দরপতন। যার ফলে নতুন-পুরনো অধিকাংশ বিনিয়োগকারীই লোকসানে রয়েছেন। এর মধ্যে মার্জিন ঋণ নেয়া বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওতে সুদের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ইক্যুইটি মাইনাসে চলে এসেছে। সহস্রাধিক বিনিয়োগকারীর বর্তমান পোর্টফোলিওতে ফোর্সসেল স্ট্যাটাস লেখা রয়েছে। হাতেগোনা কয়েকটি হাউজ ইতোমধ্যে বেশকিছু বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার ফোর্সসেল (জোরপূর্বক) করে পথে বসিয়ে দিয়েছে। তবে বেশিরভাগ হাউজে ফোর্সসেলের বিনিয়োগকারী থাকলেও হাউজগুলো মানবিক দিক বিবেচনায় তা করছে না। অন্যদিকে হাউজে বিনিয়োগকারীদের যে পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। এ অবস্থায় ফোর্সসেল না করলে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়তে হবে বলে জানা গেছে। এমতাবস্থায় হাউজ ও বিনিয়োগকারী উভয়ই যেন বাজারে টিকে থাকতে পারে সেজন্য পর্যাপ্ত নগদ তহবিলের ব্যবস্থা জরুরি বলে মনে করেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।
অবশ্য পুঁজিবাজারে দরপতনের বিষয়টি প্রায়ই বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকেও (বিএসইসি) ভাবিয়ে তুলছে। দরপতনের পেছনে কোনো কারসাজি রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে শুরুও করেছে। এতে কেউ অভিযুক্ত প্রমাণিত হলে দ্রততম সময়ের মধ্যে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে কমিশনের পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানানোও হয়েছে। তবে বাজারে কিছুটা গতি ফিরে আসার পর স্বল্পসময়ের ব্যবধানেই আর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে পুঁজিবাজারে ধস শুরু হওয়ার পর থেকে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বারবার কেন একই ঘটনা ঘটছে এ বিষয়ে একটি পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন অনেকেই।
তাদের মতে, দীর্ঘ মন্দা ও মার্জিন লোন আটকে থাকা পোর্টফোলিওগুলো সক্রিয় করতে তারল্য প্রবাহ বাড়ানো না গেলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও স্থিতিশীল বাজার সৃষ্টি করা কঠিন হয়ে পড়বে। চার বছরেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারের ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছে না। এর মূল কারণ সাধারণ বিনিয়োগকারী, মার্চেন্ট ব্যাংক, সিকিউরিটিজ হাউস, আইসিবির প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা মার্জিন লোনের জালে আটকে রয়েছে। এসব পোর্টফোলিওগুলো সক্রিয় না হলে পুঁজিবাজার তার স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরে আসা খুবই দুরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় সরকার কিংবা বাজারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের কর্তারা যত কথাই বলুক না তাতে কোনো সুরাহা হবে না। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে তারল্য সরবরাহ সৃষ্টি করতে হবে। এটি করতে হলে মার্জিন ঋণে আটকে থাকা শেয়ারের বিপরীতে প্রতিষ্ঠনগুলোকে তিন কিংবা পাঁচ বছরের জন্য প্রভিশনিং সুবিধা দিতে হবে। এজন্য সরকার, প্রাইভেট কোম্পানি কিংবা বড় উদ্যোক্তাদের অবশ্যই এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তারা বলেন, পুঁজিবাজার থেকে যেহেতু সরকার শত শত কোটি টাকা রাজস্ব পেয়ে থাকে, সেহেতু বাজারের চলমান ক্রান্তিলগ্নে সরকারকেই বাজারে সার্বিক সহায়তা দিতে এগিয়ে আসতে হবে।
এ বিষয়ে একাধিক সিকিউরিটিজ হাউজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বাজারে মূল সমস্যা মার্জিন ঋণ। কারণ ২০১০ সালে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজার ও আবাসন খাতে মাত্রাতিরিক্ত বিনিয়োগ করেছিল। পরে ব্যাংকগুলো তাদের বিনিয়োগ ঘোষণা দিয়ে বাজার থেকে বের করে নিলে বাজার তার ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং সকল বিনিয়োগকারী বড় ধরনের ঋণের জালে আটকে যায়। তারা জানান, মার্চেন্ট ব্যাংক, সিকিউরিটিজ হাউজ ও আইসিবিসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের জালে আটকা পড়ে আছে। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে বিকল্প কৌশল নির্ধারণ করে সরকার, প্রাইভেট কোম্পানি কিংবা ব্যক্তি পর্যায়ের বড় উদ্যোক্তাদের অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘমেয়াদে তিন থেকে ৫ হাজার কোটি টাকার তারল্য সরবরাহ করার মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেয়ারে সুবিধাজনক প্রভিশনিং রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বাজার ধীরে ধীরে ঋণের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে বলে তারা মনে করছেন।
এ প্রসঙ্গে শাহজাহান সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান আলী খান বলেন, এখন বাজারে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীরা আইপিওর প্রতি বেশি বিনিয়োগ করছে। এতে করে বাজারের অর্থ ওই দিকে চলে যাচ্ছে তাই বাজারের লেনদেন এমন নিম্নমুখী বলে আমার ধারণা। তিনি মনে করেন, আইপিওর মাধ্যমে বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগের ফলে বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকা নগদ অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে করে বারবার বাজার ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া চাহিদা ও জোগানের এ বাজারে অবমূল্যায়িত হচ্ছে অধিকাংশ শেয়ার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসি’র এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১০ সালে ব্যাংকগুলো বাজারে ঝড়ের বেগে বিনিয়োগ করেছিল। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এর পেছনে ছুটেছিল। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকগুলো তাদের বিনিয়োগ বাজার থেকে বের করে নিলে নেতিবাচক পরিস্থিতির মুখে পড়ে যায়। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজার যে অবস্থানের মধ্যে রয়েছে এখান থেকে টেনে তুলতে সরকারকে শর্ট-টার্মের জন্য বিশেষ ফান্ড গঠনের মাধ্যমে তারল্য সরবরাহের ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button