ব্রিটেনে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করছে কাতার

Londonশফিকুর রহমান রয়েল: ক্ষুদ্র উপসাগরীয় রাষ্ট্র নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করছে যুক্তরাজ্যে। সে দেশের রাজপরিবার অতিসম্প্রতি লন্ডনের সম্পত্তি বাজারে আরো একটা চমক দেখিয়েছে। ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে নিয়েছে একটি ভিক্টোরিয়ান টাউন হাউজ। তারাই এর আগে বিনিয়োগ ঘটিয়েছিল হ্যারডস, শার্ড, সেইনসবারিস, বার্কলেস ও স্টক এক্সচেঞ্জে। কানারি হোয়ার্ফ-এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে কাতার। দেশটির বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও হুমড়ি খেয়ে পড়ছে লন্ডনে এবং ক্লারিজস, কোনাট ও বার্কলেজ-এর অধিকাংশ শেয়ারের মালিক হতে যাচ্ছে।
এসব বিনিয়োগ ঘটার একটা বড় কারণ হচ্ছে, যুক্তরাজ্য ব্যতিক্রমধর্মীভাবে বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানাচ্ছে, সাথে হালকা নিয়ন্ত্রণী আবহ এবং প্রতিশ্রুতি দেয় বিনিয়োগের উপর ব্যাপক মুনাফার; কিন্তু কাতারের বিনিয়োগগুলোর পেছনে ভিন্ন একটা দিকও রয়েছে। কাতার আশা করে যে, প্রভাবশালী দেশগুলোর ব্যবসায়িক দৃশ্যপটে ভাল অবস্থান তার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে, যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয় ওই স্বনামধন্য রাষ্ট্রগুলো। আয়তনে ক্ষুদ্র, জনসংখ্যাও মাত্র আড়াই লাখ। সেই সাথে এটিও অজানা নয় যে, কাতার যৌক্তিকভাবে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না এবং নির্ভর করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সহিত অংশীদারিত্ব ও আন্তর্জাতিক জোটগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ওপর।
অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য একই হুমকিগুলোর অধিকাংশই মোকাবেলা করছে কাতার: বর্ধিষ্ণু ইরানী প্রভাব, রাষ্ট্রের ভেতর ও বাইরের জিহাদী উপাদানসমূহ এবং সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকের যুদ্ধ থেকে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ার হুমকি; কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তার প্রশ্নে কাতারকে অন্য কারও সঙ্গে একেবারেই মেলানো যায় না। উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদে সৌদি আরবের নেতাসুলভ ভূমিকাকে প্রতিহত করতে ব্যাকুল; যৌথ নিরাপত্তা প্রকল্পগুলোয় তাদের অংশগ্রহণ নামেমাত্র। ইতিমধ্যে সম্ভাব্য হুমকি মোকাবেলার চেষ্টা করেছে ঐতিহ্যগতভাবে আইসিসির দ্বারা উপেক্ষিত আন্তর্জাতিক খেলুড়েদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে। উদাহরণস্বরূপ ইরানের সঙ্গে রয়েছে চমত্কার সম্পর্ক; প্রকাশ্যে দেশটির সমালোচনা করা বন্ধ রেখেছে। বিশ্বের সর্ববৃহত্ গ্যাস ক্ষেত্রটি নিয়ে রয়েছে এই দুই দেশের অংশীদারিত্ব। ২০১০ সালে কাতার ইরানের সঙ্গে একটি এমওইউতে স্বাক্ষর করেছিল, যেটি বৃদ্ধি করেছিল সন্ত্রাস-বিরোধী সহযোগিতা এবং সূচনা ঘটিয়েছিল কিছু ক্ষুদ্র পরিসরের যৌথ নৌটহলের। কাতার মনে করে, দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক থাকায় ইরানের কাছ থেকে সরাসরি হুমকি কমেছে।
২০০৮ সালে গাজার উপর ইসরাইলি আগ্রাসনের আগ পর্যন্ত কাতার ইসরায়েলের সঙ্গে পর্যন্ত দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। উপসাগরীয় অঞ্চলে একমাত্র ইসরায়েলি ট্রেড মিশনকে স্বাগত জানিয়েছিল কাতার এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও হামাস উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও প্ররোচিত করেছিল ইসরায়েলি বিনিয়োগকে। বিশ্বব্যাপী বর্ধিষ্ণু ইসলামী আন্দোলনগুলোর সঙ্গেও তার বন্ধন দৃঢ় করেছে, বিশেষত মুসলিম ব্রাদারহুড। অধিকাংশ আরব ও মুসলিম বিশ্বের এসব আন্দোলনের প্রতি ব্যাপক সহানুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি কাতার ব্যাকুল হয়ে রয়েছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত্ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে।
কাতারের জটিল পররাষ্ট্র নীতি ও মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তাদের সমর্থন দেখে সৌদি আরব দারুণ হতাশ। যে কারণে জিসিসি দেশগুলোর অপ্রত্যাশিত তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল, যার পরিণতিতে দোহা থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। ব্রাদারহুড উপসাগরীয় সরকারগুলোর ধর্মীয় বৈধতাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে। এমন যুক্তি হাস্যকর নয় যে, মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন করার মাধ্যমে কাতারি রাজপরিবার জনপ্রিয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। তার সাথে ওইসব লোকের সমর্থন আদায় করে নিয়েছে, যারা মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন করে।
কৌশলগত ব্যবসায়িক বিনিয়োগ এবং সম্পর্কের পরিসর বৃদ্ধির চেষ্টা ছাড়াও কাতার ‘ন্যাশনাল ব্র্যান্ড’-এর উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আল-জাজিরা নিউজ নেটওয়ার্কে পাহাড়সম বিনিয়োগ স্বাধীন সাংবাদিকতার কেন্দ্র হিসেবে কাতারকে ব্র্যান্ড করার প্রচেষ্টা হয়ে রয়েছে, যদিও মধ্যপ্রাচ্যের সরকারগুলোর সমালোচনার বিষয়ে এই চ্যানেলটির সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। বাহরাইনের আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের দমন-পীড়ন ইস্যুতে তাদের নিরবতাই এর বড় প্রমাণ। ইংরেজি ও আরবী সার্ভিসের মূল্যবোধ একই রকম নয়। এক হলে চ্যানেলটির গ্রহণযোগ্যতা নিঃসন্দেহে আরো বাড়ত।
অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এবং প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর এক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদস্য রূপেও কাতার নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বাগতিক দৌড়ে চমক দেখিয়ে জিতে যাওয়াটা সে কৌশলেরই অংশ, যদিও এ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, কাতারে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকরা, বিশেষত যারা নির্মাণ শিল্পে কাজ করে, তারা নিয়োগকারীদের কর্তৃক শোষণের শিকার হচ্ছে। প্রায়ই তাদের পাসপোর্ট ও মজুরি আটকে রাখা হয়; কাজ করতে হয় অনিরাপদ পরিবেশে আর বসবাস করতে হয় অস্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে।
পশ্চিমা বিশ্বের কাছে কাতার যদি গ্রহণযোগ্য শক্তি ও সঙ্গী হিসেবে প্রমাণ করতে চায়, তাহলে অভিবাসী ইস্যু ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে আরো অনেক কিছু করতে হবে। রাজতন্ত্র বহাল রেখেই রাজনৈকিভাবে প্রগতিশীল শক্তি হিসেবে বিশ্বে আবির্ভূত হওয়ার ইচ্ছে থাকলে অনেক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে; প্রতিষ্ঠা করতে হবে স্বচ্ছ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ, যাতে ওই দেশে বসবাসরত সকলের অধিকারগুলো সুরক্ষিত থাকে, শুধু কাতারে জন্মগ্রহণকারীদের নয়। আধুনিক রাষ্ট্র হতে গেলে এসব শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হয়। -ফরেন পলিসি অনুসরণে

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button