হিজাব পরতে মার্কিন নারীর দীর্ঘ সংগ্রাম

Johraজোহরা সীমা পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ও আমেরিকা প্রবাসী একজন মুসলিম আইনজীবী। হিজাব পরার কারণে তাকেও অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। কিন্তু হিজাব পরার ব্যাপারে কারো সঙ্গে কোনো আপস করেননি। শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হয়েছেন।
তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘সমস্যার শুরু হয় কোনো চাকরির সাক্ষাৎকার বা আদালতে কোনো মামলা লড়তে যাওয়ার আগের রাতে। জোহরা তার রঙিন হিজাব ও লম্বা হাতাওয়ালা জামার দিকে তাকিয়ে ভাবেন এবং নিজেকে প্রশ্ন করেন, চাকরি পেতে আমার কি এই হিজাব পরা ছেড়ে দেয়া উচিত?
‘এই সময়টাতেই আমি খুব চাপের মধ্যে পড়ে যাই’ বলেন জোহরা। জোহরা বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় সর্বদা হিজাব পরেন।
জোহরার ভাবনা এই একটাই যে, তার আমেরিকান স্টাইলের লম্বা স্কার্ট নাকি তার পছন্দের অধিক রক্ষণশীল ‘আবায়া’ পরা উচিত? অবশ্য কর্মস্থলে যোগ দেয়া একজন পরহেজগার মুসলিম নারীর জন্য এমন প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই।
২৫ বছর বয়সি জোহরা সীমা বলেন, প্রত্যেকবার যখন আমি কোনো সাক্ষাৎকার দিতে কক্ষের দিকে অগ্রসর হই অথবা আদালতে কোনো মামলা লড়তে যাই, আমার প্রথম চিন্তা হচ্ছে, ‘আমি একজন মুসলিম’। আর সবসময় আমার আশঙ্কা হয় যে, ‘হিজাব পরার কারণে আমার মেধা ও অন্য সব গুণ না আড়ালে পড়ে যায়’।
জোহরা তার হিজাব পরা নিয়ে বেশ গর্বিত। তিনি মনে করেন, হিজাব মুসলিম নারীদের সামাজিক মর্যাদাকে ঊর্ধে তুলে ধরে। কেননা নানা চ্যালেঞ্জ স্বত্ত্বেও তারা একটি বিশেষ বিশ্বাসের চিহ্ন হিসেবে তাদের মাথা ও শরীর আবৃত করার সিদ্ধান্ত অটল থাকে।
জোহরাও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে অবশেষে সফল হয়েছেন। ল’ স্কুল থেকে ল’ ফার্মে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করা পর্যন্ত এই দীর্ঘ যাত্রায় তাকে নানা অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। জোহরা বলেন, ‘এই যাত্রায় নিজেকে খুব মনে হতে পারে’।
তিনি সাদাদের শহর লং আইল্যান্ডের একটি সেক্যুলার পরিবারে বড় হয়েছেন। কলেজে যখন তিনি নতুন ভর্তি হন, তখন থেকেই তিনি হিজাব পরার সিদ্ধান্ত নেন। তার সেক্যুলার বাবা-মাও এটাকে ভালোভাবে নেয়নি।
বাবা-মার উদ্বেগ ও তাদেরকে ভুল প্রমাণ করে দেয়ার তার আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে জোহরা বলেন, ‘আমার বাবা-মা এমন যে, তারা বলতেন- কে তোমাকে চাকরি দিতে যাচ্ছে?’
জোহরা পড়াশুনা করেছেন সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক ল’ স্কুলে। তিনি জানান, মুষ্টিমেয় যে কয়জন মেয়ে হিজাব পরতেন, তিনি তাদের একজন ছিলেন।
পড়াশুনা শেষ করার পর তিনি যখন চাকরি খোজা শুরু করলেন, তখন তিনি আবিষ্কার করলেন যে, হিজাব পরা মেয়েদের পক্ষে চাকরি পাওয়া আসলেই বেশ কঠিন।
সামাজিক সংগঠন বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে নিজেকে যুক্ত করতে গেলেও অনেক ভাবতে হতো। মুসলিম ল’ স্টুডেন্টস আসোসিয়েশনের সদস্য হবেন কিনা তা নিয়েও তাকে তার নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়েছিল। তার আশঙ্কা, পাছে নিয়োগকর্তারা তাকে সাক্ষাৎকারের জন্য আদৌ না ডাকে।
আর সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুক বা লিঙ্কডইনে তার হিজাব পরা ছবি দেখে যদি নিয়োগকর্তারা তাকে সাক্ষাৎকারের জন্য না ডাকে, এই আশঙ্কায় ছবি ছাড়াই চলে তার ফেসবুক ও লিঙ্কডইন।
জোহরা দুঃখের সঙ্গে জানান, ‘যখন লিঙ্কডইন ও ফেসবুক পেজ থেকে ছবি সরিয়ে ফেরলাম, তখন আমি সাক্ষাৎকারের ডাক পেলাম। তা নাহলে আমি ডাক পেতাম না’।
জোহরার একজন এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মারিয়ানা ডিক্রিসেনজো যিনি জোহরাকে অনেকদিন ধরে চেনেন, তিনি বলেন- জোহরা এত বাজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেলেও কখনো এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করেননি।
জোহরা বলেন, চাকরির খোঁজ তাকে এক বেদনাদায়ক শিক্ষা দিয়েছে। কিছু নিয়োগকর্তা আছেন এমন, যারা কোনো হিজাব পরা মেয়েকে তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিতে চান না। এমনকি এক সময় তিনি তার আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন ত্যাগ করার চিন্তা-ভাবনাও করেন। কিন্তু তিনি বলেন, তিনি তার বিশ্বাসের মাঝে শান্তি ও সাহস খুজে পেয়েছিলেন।
অবশেষে গত বছরের আগস্ট মাসে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আশিষ কাপুর চালিত একটি ল’ ফার্মে জোহরা চাকরি পান। জোহরার হিজাব নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তিনি মনে করেন, জোহরা যদি হিজাব পরে ক্লায়েন্টদের সাথে কাজ করতে সাচ্ছন্দ বোধ করেন এবং আদালতে আসতে পারেন তাহলে কোনো সমস্যা নেই।
জোহরা দ্রুততম সময়ে নিজেকে দক্ষ আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। আশিষ কাপুর বলেন, জোহরা বেশ আত্মবিশ্বাসী।
চলতি মাসে জোহরা সীমা বাবা-মা ও আশিষ কাপুরের সহযোগিতায় নিজেই অভিবাসন ও পারিবারি আইন বিষয়ক একটি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন।
জোহরা জানেন, এটা কোনো সহজ কোনো কাজ নয়। তবে তিনিও ছাড় দেয়ার পাত্র নন।
‘হয়তো মাঝেমাঝে এটাকে অশান্তির বলে মনে হবে। কিন্তু আমি সেই ঝুঁকিই নিতে যাচ্ছি’ বলে আত্মপ্রত্যয়ী জোহরা সীমা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button