পর্যটন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত ইকোনমিক করিডোর

Coxbazarবাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী খ্যাত কক্সবাজারের ওপর দিয়ে কলকাতা ও চীনের কুনমিং শহর পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মিত হলে পাল্টে যাবে গোটা কক্সবাজারের চেহারা। ব্যবসায়ীদের ধারণা, এ অঞ্চলের পর্যটন টেকসই রূপ পেলে এখান থেকে আসতে পারে বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। একইসঙ্গে কক্সবাজারের অতি সন্নিকটে সোনাদিয়া ডিপ সিপোর্ট নির্মিত হলে এ অঞ্চল সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ের মতো উন্নত শহরে পরিণত হতে পারে স্বল্পসময়েই। কক্সবাজার পরিণত হবে বন্দর নগরীতে।
ইতিমধ্যেই ইকোনমিক করিডোরে কানেকটিভিটি সড়ক নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।একইসঙ্গে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না হারবার সোনাদিয়ায় প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশকে।
এ ব্যাপারে দুই দেশ ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলেও সূত্রে জানা গেছে। প্রস্তাবিত সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও ইকোনমিক করিডোর স্থাপিত হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
এতে শুধু কক্সবাজার নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে। এতে জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। আর এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন মাত্রা উন্মোচনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। গত ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর কক্সবাজারে চীন, মিয়ানমার, ভারত ও বাংলাদেশ জয়েন্ট স্টাডি গ্রুপের দ্বিতীয় সভায় এ ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ঐ জয়েন্ট স্টাডি গ্রুপের দ্বিতীয় সভায় পাওয়ার পয়েন্ট প্রপেণের মাধ্যমে কলকাতা থেকে যশোর-ঢাকা হয়ে আবার ভারতের আসামের শিলচরে প্রবেশ করে মিয়ানমারের মান্দালয় হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত একটি রুট প্রদর্শন করা হয়।
এই সড়কটির দূরত্ব হবে দুই হাজার ৪৯০ কিলোমিটার এবং এ জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলার। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অবকাঠামো উন্নয়নের স্বার্থে অর্থনৈতিক করিডোর হিসেবে এই রুটটি এই অঞ্চলে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করবে এমন মন্তব্য করেন চার দেশের প্রতিনিধিরা।
তারা আরও জানান, নতুন এই করিডোর স্থাপিত হলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে এটি এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডে পরিণত হবে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটি সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা জানান, চীনের কুনমিং থেকে মান্দালয়, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও যশোর হয়ে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত হলে এই চারটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে আরো বেশি লাভবান হবে। কক্সবাজারে পর্যটন শিল্প বিশ্বব্যাপী বিকাশ ঘটবে। নতুন নতুন বিনোয়োগ সৃষ্টি হবে এই অঞ্চলে।
অপর দিকে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর দ্রুত স্থাপিত হলে এই করিডোরের মধ্য সার্কভুক্ত আটটি দেশকে সংযুক্ত করা যাবে, যা এই রুটের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আরও বেশি গতিশীল করবে এবং এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম জানান, বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ হচ্ছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। এখানে আছে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন, পাহাড়, সাগর, ঝর্ণার নদী বেষ্টিত দর্শনীয় স্থান। তাই এই ইকোনমিক কেরিডোর হতে পারে পর্যটন শিল্প বিকাশের মাধ্যম। এর ফলে শুধু কক্সবাজার পর্যটন শিল্প থেকেই বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পাবে সরকার।
তাঁর মতে, আমাদের দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঠিকমতো ও পরিকল্পিতভাবে করতে পারলে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে পরিচিতি লাভ করবে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স সভাপতি আবদুর শুকুর জানান, এই ইকোনমকি করিডোর খুলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতির দ্বার। এই সড়কটি স্থাপিত হলে প্রস্তাবিত সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর দিয়ে সড়ক পথে মালামাল পরিবহন খরচ পড়বে কম। ফলে এই গভীর সমুদ্রবন্দরের সার্কভুক্ত আটটি দেশসহ পূর্ব-দিগন্তের দেশসহ অবাধ বাণিজ্যিক সুবিধা পাবে। এতে পাল্টে যাবে অর্থনীতির চেহারা।
সী-বিচকে আরও আধুনিক নিরাপত্তায় বেষ্টিত করে পর্যটকদের ভ্রমণ সুবিধা বাড়িয়ে, সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগব্যবস্থাকে ঢেলে সাজালে কক্সবাজার, টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন পাল্টে দিতে পারে পর্যটন শিল্পের চেহারা। তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘সাব রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট প্রিপারটরি ফ্যাসিলিটি প্যাকেজ-২ প্রকল্পের’ আওতায় এটি কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক হয়ে আঞ্চলিক কানেকটিভিটির মাধ্যমে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এই চুক্তি বাস্তাবায়নের প্রক্রিয়ায় এডিবির অর্থায়নে সুইডেনভিত্তিক একটি এবং বাংলাদেশি একটি কনসালট্যান্সি ফার্ম যৌথভাবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার কারিগরি সমীক্ষা জরিপ চালাচ্ছে। কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের প্রাথমিক অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে।
মহাসড়কে প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬টি ব্রিজ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে এই খবর জানা গেছে। সম্প্রতি সড়ক ও জনপদ বিভাগের সহযোগিতায় এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের নিযুক্ত হাইফাব ইন্টারন্যাশনালের পুনর্বাসন কনসালট্যান্ট হাসিনা খাতুন, আর্ন্তজাতিক পরিবেশ কনসালট্যান্ট মি. মিংউইং, হাইফাবের পরিবেশ কনসালট্যান্ট ফারুক আহমদ খানসহ সড়ক ও জনপথ বিভাগের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা একটি সমন্বয় সভা করেছেন।
সভায় এডিবির নিযুক্ত কনসালট্যান্সি ফার্মের প্রকৌশলীরা জানান, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার, কক্সবাজারের লিংক রোড থেকে টেকনাফ পর্যন্ত মহাসড়ক উন্নয়নের লক্ষে বিদেশী পরামর্শকের মাধ্যমে জরিপ কাজ শেষ পর্যায়ে।
কক্সবাজার সড়ক পরিবহন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নূরে-ই আলম বলেন, এডিবির অর্থায়নে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক উন্নয়নের জন্য জরিপকাজ সম্পন্নের পথে। তবে মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কেন্দ্রীয়ভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। দীর্ঘ দিন থেকে এটিকে আঞ্চলিক কানেকটিভিটির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
সেহেতু কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে বিদ্যমান সড়ক উন্নয়ন ও চারটি বড় ব্রিজ, ১২টি ছোট মাঝারি কালভার্ট পুনঃনির্মাণকাজ চলছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, অবশিষ্ট কাজ দ্রুত সম্পন্ন হবে বলে তিনি জানান।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button