বাদশাহ আব্দুল আযীয : ব্যক্তিত্ব ও সাফল্য

Abdul Azizআধুনিক সউদী আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আব্দুল আযীয বিন আব্দুর রহমান বিন ফয়সাল বিন তুর্কী বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আল সউদ ১২৯৩ হিজরীর ১৯ শে যিলহজ্জ রাতে (১৪.০১.১৮৭৬ ঈসায়ী) রিয়াদের রাজ প্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা তাঁকে সঠিক ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। ৬ বছর বয়সে তিনি বিখ্যাত শাইখ আব্দুল্লাহ আল-খুরাইজির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১১ বছর বয়সেই কুরআন হিফজ সমাপ্ত করেন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন আলেমের কাছ থেকে তাফসীর, হাদীস, ফিক্বাহ, তাওহীদ, আরবী ভাষা, সীরাতুন্নাবী ও ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি অধ্যয়ন করেন।
লেখাপড়ার পাশাপাশি আব্দুল আযীয তাঁর পিতার সাথে বিভিন্ন সভা-সমিতি, বৈঠক ও সফরে যেতেন ও সেখানে বিভিন্ন বৈষয়িক বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। সাথে সাথে অশ্ব চালানো ও যুদ্ধ কৌশলও রপ্ত করেন। তাঁর পিতার সাথে কুয়েতে অবস্থানকালে তৎকালীন কুয়েতের রাজা মুবারক আছছবাহর (১৩০৯ হি.) কর্মকাণ্ড, শাসনকার্য ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।
পরবর্তীতে তিনি শাইখ আব্দুল্লাহ আব্দুল লতিফ আল-আশ-শায়েখের নিকট থেকে ইসলামী ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। তাঁর পরিবার কুয়েত থেকে ফেরার পথে মুররাহ উপজাতির সাথে অবস্থান করার সময় প্রায় সাত মাস অশ্ব চালানো শিখেন। সেখানে তিনি ১০ বছর অবস্থান করেন। সউদী আরব নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তিনি অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দেন। রাজ্যগুলো একত্র করণে তিনি ছিলেন আদর্শ ব্যক্তি। সেটির জন্য তিনি অব্যাহতভাবে সংগ্রাম করেন।
তাঁর বিপ্লবের পর লুণ্ঠণ, ছিনতাই, মহাসড়কে ডাকাতি ইত্যাদি দূর হয়ে যায়। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মন্ত্রিপরিষদ, মজলিসে শূরা, ট্রাস্টি পরিষদ ও অন্যান্য প্রশাসনিক দফতর গঠন করেন। বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করেন। যা ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। নিকটতম আরব রাষ্ট্র ইরাক, ইয়েমেন, মিসরসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ থেকে তিনি তাঁর রাজ্য চালনায় দৃঢ় সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন।
বাদশাহ আব্দুল আযীয যুদ্ধ ক্ষেত্র অত্যন্ত ধার্মিকতা ও বদান্যতার পরিচয় দেন। বিধায় তিনি শক্রদের পরাজিত করতে সক্ষম হন। তাদের বের করে দেয়ার পরিবর্তে তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেন। হিজাযের অধিবাসীদের তিনি স্বাধীনতা ও নিজস্ব বিষয়ে শাসন করার ক্ষমতা প্রদান করেছেন। একজন বুদ্ধিমান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি প্রথম সউদী রাষ্ট্রের ভুলগুলো বুঝতে পারেন। এ কারণে তাঁর রাজ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যয় ঝুঁকি নিতে হয়নি।
সউদী আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আযীয বিন আবদুর রহমান আল সাউদ যখন ১৩৪৩ হিজরীতে হিজায তথা বর্তমান মক্কায় প্রবেশ করেন, তখন তিনি দেখলেন যে হারামে মাক্কীতে কয়েকটি সালাতের জামাত হয়। প্রথম জামাতে ইমামতি করেন শাফিঈ মাযহাবের ইমাম। দ্বিতীয় জামাতে ইমামতি করেন হানাফী মাযহাবের ইমাম। তৃতীয় জামাতে ইমামতি করেন মালিকী মাযহাবের ইমাম এবং চতুর্থ জামাতে ইমামতি করেন হাম্বলী মাযহাবের ইমাম। এরপর ১৩৪৫ হিজরীর ২০ রবিউল আখির নাজদ ও হিজাযের ওলামাদের একটি দলের সাথে বৈঠক করেন। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, এখন থেকে মসজিদে হারামে শুধু একটি জামাত হবে। প্রতি মাযহাব থেকে তিনজন ও হাম্বলী মাযহাব থেকে দুজন ইমাম নির্বাচন করেন। যারা পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের ইমামতি করবেন। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতীক কাবাকে হিফাজত করেছেন।
দ্বিতীয় সউদী রাষ্ট্রের ধ্বংস থেকে তিনি অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ধারাবাহিকভাবে তিনি তাঁর পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করেন এবং বিরোধী জোটের আল-আসিখ পরিবারের সাথে স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপন করেন। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। তাঁর পুত্র যুবরাজ সালমান তাঁর পিতা সম্পর্কে বলেন যে, রাত্র যতই গভীর হোক না কেন, রাজ্যের প্রতিটি অংশের প্রতিবেদন শোনা ও তা পড়া ব্যতীত তিনি কখনো বিশ্রাম গ্রহণ বা ঘুমাতে যাননি।
বাদশাহ আব্দুল আযীয এবং তৈল যুগ : ঊনবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের শুরুর দিকে সউদী রাষ্ট্রের অর্থনীতি কঠিন অবস্থার দিকে গিয়েছিল। সেটি কয়েক বছর স্থায়ী ছিল। ব্যক্তিগত আয় ছিল নিম্নমানের এবং রাষ্ট্রের আয় ছিল স্বল্প। সরকার ঋণী হয়ে পড়েছিল। এমনকি সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন দেয়া সম্ভব ছিল না। আব্দুল আযীয এবং তাঁর উপদেষ্টাগণ এটা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং এ সঙ্কটের সমাধান খুঁজছিলেন। তারা খনিজসম্পদ ও তেল অনুসন্ধানের চিন্তা করলেন।
ঠিক এ সময়ে চার্লস আর ক্রেন নামে আমেরিকান এক সম্পদশালী ব্যক্তি বাদশাহ আব্দুল আযীযের সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। সউদী সরকার তাকে স্বাগত জানায়। মিঃ ক্রেন বাদশাহ আব্দুল আযীযের সাথে কার্ল উইসেল নামে অভিজ্ঞ তৈল অনুসন্ধানকারীর প্রস্তাব করলে তিনি ছয় মাস অনুসন্ধান চালিয়ে সউদী আরবের পূর্বাঞ্চলে অনেক তৈলের সন্ধান পেলেন। তখন এ সংবাদ পৃথিবীতে দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্তর্জাতিক তৈল কোম্পানিগুলো সউদী আরবে তেল অনুসন্ধান, উত্তোলন ও উৎপাদন করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠে। এ সুযোগের জন্য তখন তিনটি কোম্পানি প্রতিযোগিতা করে। (১) দি ইস্টার্ন এবং জেনারেল সিন্ডিকেট, (২) দি ইরাক পেট্রোলিয়াম কোম্পানি ও (৩) ক্যালিফোর্নিয়া স্টান্ডার্ড তৈল কোম্পানি।
দীর্ঘ সময়ব্যাপী অভিজ্ঞ লোকজনদের সাথে আলোচনার পর ১৯৩৩ সালে সউদী সরকার ক্যালিফোর্নিয়া স্টান্ডার্ড অয়েল কোম্পানির সাথে প্রায় ৪,৯৫,৫০০ বর্গমাইল এলাকার তৈল অনুসন্ধান ও উৎপাদনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন। রাজ্যের পূর্ব উপকূল থেকে তৈল অনুসন্ধান কার্য শুরু হয়। ১৯৩৪ সালে দাহরান এলাকার সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক তৈল ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। প্রথম অপরিশোধিত তৈল জাহাজের মাধ্যমে বাহরাইনে রফতানি করা হয় এবং ১৯৩৯ সালে বাদশাহ আব্দুল আযীযের উপস্থিতিতে রাস তান্নুরা বন্দর থেকে তৈল ট্যাঙ্কারে করে রফতানি করা হয়। এ আবিষ্কার ছিল জমিন এবং সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার প্রাকৃতিক গ্যাস আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে ১৯৪৪ সালে পূর্বের নাম পরিবর্তন করে এরাবিয়ান আমেরিকান তৈল কোম্পানি করা হয়।
বাদশাহ আব্দুল আযীয তাঁর বদান্যতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এ সম্পর্কে ডা. সাইয়্যিদ আল মোল্লাই নিচের গল্পটি লিখেছেন-
বাদশাহ আব্দুল আযীয পবিত্র হজ্জ সম্পাদনের জন্য মক্কার পথে ছিলেন। হঠাৎ সরকারি গাড়ির একটি টায়ার ছিদ্র হয়ে গেল। তারপর বাদশাহ গাড়ি থেকে নামলেন এবং বালির ওপর বসে অপেক্ষায় ছিলেন ছিদ্র হওয়া টায়ার পুনরায় স্থাপনের জন্য। তখন তাঁর নিকট দিয়ে একজন আরব বেদুইন অতিক্রম করে এবং জিজ্ঞাসা করে যে, কখন বাদশাহ আব্দুল আযীয এ পথ অতিক্রম করবে? বাদশাহ লোকটিকে প্রশ্ন করলেন, কেন আপনি এটা জিজ্ঞাসা করলেন? বেদুইন উত্তর দিল, আমি জানি যে আব্দুল আযীয মক্কার পথে এখান দিয়ে যাবে। সুতরাং আমি ইচ্ছা করছিলাম যে, আমি তাঁর কাছে কিছু অর্থ সাহায্য চাইব যাতে আমিও মক্কায় পবিত্র হজ্জ পালন করতে পারি। তখন আব্দুল আযীয স্বর্ণমুদ্রার থলে খুললেন এবং তা থেকে লোকটির হাত ভর্তি করে দান করলেন। বেদুইন হতবাক হয়ে স্বর্ণমুদ্রা ও রাজার চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল এবং বলল ধন্যবাদ, হে আব্দুল আযীয! আপনাকে আমি সর্বপ্রথম দেখলাম আর কখনো আপনার চেহারা ভুলব না। কিন্ত আমি জানি আপনার বদান্যতা কত বিশাল!
রাজ্য শাসনের মূলনীতি : তিনি ৭টি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রাজ্য শাসন করতেনÑ ১. আল্লাহর কিতাব ও নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা, ২. বিদআত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, ৩. পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির চেষ্টাকারী, পাপাচারী অপরাধীকে শাস্তি প্রদান, ৪. জনগণের সামাজিক দায়-দায়িত্ব গ্রহণ, ৫. জনগণের সম্মানজনক জীবন যাত্রার পথ সহজীকরণ, ৬. অভ্যন্তরীণ ও বহিঃনিরাপত্তা সংরক্ষণ ও ৭. কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনুপ্রবেশ না করা।
বিভিন্ন দেশে বাদশাহ আব্দুল আযীযের সফর : বাদশাহ আব্দুল আযীয তার জীবদ্দশায় দুইবার বাহরাইনে, একবার ইরাকে ও দুইবার মিসরে সফর করেন। তার রাজত্ব কালে যে সমস্ত দেশের রাজা-বাদশাহরা সউদী আরব সফর করেছেন তারা হলেন- বাহরাইনের আমীর হামদ বিন ঈসা আল খলীফা, কাতারের শাসক আশশাইখ আলী আল ছানী, কুয়েতের আমীর আহমাদ আছছবাহ, জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন হুসাইন ও তালাল বিন আব্দুল্লাহ আল হুসাইন ও হুসাইন বিন তালাল, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট শুকরী আল কুতলী, লেবাননের প্রেসিডেন্ট কামিল শামউন, মিসরের বাদশাহ ফারুক বিন ফুয়াদ দুইবার ও বাদশাহ মুহাম্মাদ নাজীব, আফগানিস্তানের বাদশাহ মুহাম্মাদ জহির শাহ এবং পাকিস্তানের শাসক গোলাম মুহাম্মাদ।
বাদশাহ আব্দুল আযীযের সন্তানাদি ৬৩ জন। তার মধ্যে পুত্রসন্তান ৩৬ এবং কন্যাসন্তান ২৭ জন। তাঁর পুত্রসন্তানগণ হলেন- ১. তুর্কী প্রথম, ২. সাউদ, ৩. ফায়সাল, ৪. মুহাম্মাদ, ৫. খালিদ, ৬. সা’দ, ৭. নাছির, ৮. মানছুর, ৯. ফাহাদ, ১০. আবদুল্লাহ, ১১. বন্দর, ১২. মুসাইদ, ১৩. আবদুল মুহসিন, ১৪. মিশআল, ১৫. সুলতান, ১৬. আবদুর রহমান, ১৭. মুতইব, ১৮. তালাল, ১৯. মাশারী, ২০. বদর, ২১. তুর্কী দ্বিতীয়, ২২. নাওয়াফ, ২৩. নায়েফ, ২৪. ফাওয়াজ, ২৫. সালমান, ২৬. মাজিদ, ২৭. ছামাব, ২৮. মাহমুদ, ২৯. আবদুল ইলাহ, ৩০. সাত্তাম, ৩১. আহমাদ, ৩২. আবদুল মাজিদ, ৩৩. মাশহুর, ৩৪. হাছলুল, ৩৫. মুকরিন ও ৩৬. হামুদ এবং তাঁর কন্যাসন্তানগণ হলেনÑ ১. মুনীরাহ, ২. নাওরাহ প্রথম, ৩. সারাহ, ৪. শাইখাহ, ৫. আল আনুদ, ৬. আল জাওহারাহ প্রথম, ৭. দালাইল, ৮. মুধী, ৯. হুসাহ, ১০. আল বানদারী, ১১. গামাশাহ, ১২. নুফ, ১৩. সীতাহ, ১৪. হায়া, ১৫. সুলতানাহ, ১৬. নাওরাহ দ্বিতীয়, ১৭. মাছীল, ১৮. মাধাবী, ১৯. জাওযা, ২০. লু’লুআহ, ২১. লাতিফাহ, ২২. জাওয়াহিব, ২৩. আল জাওহারাহ দ্বিতীয়, ২৪. আবতা, ২৫. শাইআহ, ২৬. ফালওয়াহ ও ২৭. তরফাহ।
মৃত্যু : বিশ্ব কাঁপানো আরব বাজপাখি নামেখ্যাত ইতিহাস সৃষ্টিকারী বাদশাহ আব্দুল আযীয ১৩৭৩ হিজরী সালের ২ রবিউল আউয়াল মুতাবিক ১৯৫৩ সালের ৯ নভেম্বর সোমবার সকাল ৯:৪০ মিনিটে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তায়েফস্থ তার প্রাসাদে ইন্তিকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী এক হৃদয়বিদারক অবস্থার সৃষ্টি হয়। তৎকালীন বিশ্ব গণমাধ্যমসমূহ তাঁর খবরের পাশাপাশি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন দিকের ওপর সবিস্তারে আলোকপাত করে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button