রাজধানী জুড়ে আওয়ামী বিলবোর্ড

Billbord* উন্নয়ন বিজ্ঞাপনের আড়ালে নির্বাচনী প্রচার!
* ‘বিলবোর্ড আওয়ামী লীগের নয়, সরকারের’
* বিজ্ঞাপনের নকশা অতি নিচু মানের
* আকর্ষণের বদলে মানুষের বিরক্তি উদ্রেক করছে
*  বিলবোর্ড ভাড়া নেয়া অনেক কোম্পানিরই মাথায় হাত  
তোফাজ্জল হোসেন কামাল : নগরজুড়ে সরকারের “উন্নয়ন চিত্রের” বিলবোর্ডে ঢাকা পড়েছে অনেক সংস্থার বিজ্ঞাপন, আর এতে বিপাকে পড়েছে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো। ঈদের আগে গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে স্থাপিত বিলবোর্ডগুলোতে শোভা পাচ্ছে মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরের উন্নয়নচিত্র। এই বিজ্ঞাপনগুলো যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই লাগানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য কোন বিল পাবে না সিটি  কর্পোরেশন দুটি। রাজস্বও আদায় হবে না তাদের।
‘উন্নয়নের অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতা দরকার’ বলে আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় পাঠাতে জনগণের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছে এগুলোতে। বিলবোর্ডে এই প্রচারের সমালোচনা করে বিরোধী দলের নেতারা বলছেন, এতে লাভ হবে না।
আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দলের উদ্যোগেই এই বিলবোর্ডগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভাড়া নিয়ে এগুলো বসানো হয়েছে কি না- সে বিষয়ে দলের নেতাদের কোনো বক্তব্য যেমন পাওয়া যায়নি; তেমনি বিষয়টি ‘অজানা’ বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর নেতাদেরও।
একজন প্রচারণা বিশেষজ্ঞ বলেন, “এই ধরনের প্রচারণা হিতে বিপরীত হবে। যাদের উদ্দেশ্য করে এই তথ্যগুলো প্রচার করা হয়েছে তারা এরকম দাপ্তরিক ভাষা বোঝেন না। তাছাড়া এসব বিজ্ঞাপনের নকশা অতি নিচু মানের। আকর্ষণের বদলে মানুষের বিরক্তি উদ্রেক করছে।” “অক্ষর, ছবি ও রংয়ের ব্যবহারও চরম অপেশাদারি। সমস্যা হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলছেন না”- নাম প্রকাশ করতে চাননি এই বিশেষজ্ঞও।
ঢাকায় সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক বিলবোর্ড রয়েছে। বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইজারা নিয়ে বিজ্ঞাপনের জন্য এগুলো ভাড়া নিয়ে থাকে। আওয়ামী লীগের বিজ্ঞাপনের কারণে নতুন পণ্য বাজারে ছেড়ে বিজ্ঞাপনের জন্য বিলবোর্ড ভাড়া নেয়া অনেক কোম্পানিরই মাথায় হাত পড়েছে।
প্রচার বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নতুন পণ্য বাণিজ্যিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নেপচুন অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা বলেন, তাদের ইজারা নেয়া ৯০ ভাগ বিলবোর্ডে সরকারের উন্নয়নচিত্র বসানো হয়েছে। “আমাদের বিজ্ঞাপনের ওপরেই তা বসিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকে ঈদকে সামনে রেখে ভাড়া নিয়েছিল। ক্লায়েন্টরা অভিযোগ করা শুরু করেছেন। কী যে করব? আমরাও নিরূপায়,” নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন তিনি।
খাদ্য নিরাপত্তা, কূটনৈতিক অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র্য বিমোচন, যুগান্তকারী পরিবর্তন, বিশুদ্ধ খাবার পানি, শিক্ষিত সমাজ, উন্নত জাতি, সবার জন্য শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থার অগ্রগতি, ডিজিটাল বাংলাদেশ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা-  ইত্যাদি শিরোনাম এখন বিলবোর্ডগুলোতে।
আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল বলেন, গত শুক্রবার থেকে বিলবোর্ডে সরকারের উন্নয়নের প্রচারশুরু হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিলবোর্ডে এই প্রচার চালানো হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে তিনি দলের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে বলেন, “উনিই বিষয়টি ডিল করছেন।”
এই বিষয়ে কথা বলতে পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে অনেকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এসএমএস পাঠিয়েও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্ণধার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “উন্নয়নের প্রচারণা তো ঈদের পরও করা যেত। এখন সবাই ঈদ উপলক্ষে পণ্য ডিসপ্লে করবে, সেটা বন্ধ হয়ে গেল।“আচ্ছা দিল, আমাদেরকে একবার জিজ্ঞেসও করল না। আমরা তো সরকারকে ট্যাক্স দিই।”
বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোর সমিতি অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি রামেন্দু মজুমদার মনে করেন, যে কোনো ধরনের প্রচার নিয়ম মেনেই হওয়া উচিত। তিনি বলেন, “তবে তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে চুক্তি করে টাকা দিয়ে এটা করেছে কি না, তা আমি জানি না।”
আওয়ামী লীগের এই প্রচারের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রোববার বলেন, জনগণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ‘উন্নয়নের’ ফিরিস্তি দিয়ে কোনো লাভ নেই।  গতকাল  সোমবার বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া ও এম একে আনোয়ারও বলেন একই কথা।
গত চার বছরে দেশের কোনো উন্নয়ন আওয়ামী লীগ করতে পারেনি দাবি করে রফিকুল ইসলাম বলেন, “এখন তারা বিলবোর্ড দিয়ে বলছে, সমস্ত দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে।”
এম কে আনোয়ার বলেন, “গত সাড়ে চার বছরে সরকারের অপশাসন, দুর্নীতি ও ব্যর্থতার চিত্র জনগণ দেখেছে। তারা কোনো উন্নয়ন করেনি। এখন বিলবোর্ডের মাধ্যমে উন্নয়নের ঢোল বাজাচ্ছে।”
উন্নয়ন বিজ্ঞাপনের আড়ালে নির্বাচনী প্রচার!
হঠাৎ করেই সরকারের উন্নয়ন কর্মকা- প্রচারের জন্য রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন আয়তনের বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। এ সরকারের আমলে যেসব উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে তার সবই শোভা পাচ্ছে এসব বিলবোর্ডে। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- জনগণকে মনে করিয়ে দিতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
কিন্তু এই বিলবোর্ড প্রচারণার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ৪ বছরের উন্নয়ন কর্মকা-ের ফিরিস্তির আড়ালে গুরুত্ব পাচ্ছে নির্বাচনী প্রচার। কারণ বিলবোর্ডগুলোতে শুধু সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের বিজ্ঞাপনই নয়, একই সঙ্গে স্থান পেয়েছে বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলের নেতিবাচক কর্মকা-ের তথ্য।
প্রতিটি বিলবোর্ডেই রয়েছে ‘উন্নয়নের অঙ্গীকার ধারাবাহিকতা দরকার’ এই লাইনটি। এরই মাধ্যমে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটকে পুননির্বাচিত করার ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে।
তবে এই বিলবোর্ডগুলো দলীয় খরচে না কি সরকারি উদ্যোগে তা পরিষ্কার নয়। বিলবোর্ডেও নেই কোনো তথ্য। এমনকি এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কাছেও কোনো তথ্য নেই। পূর্বে বিভিন্ন প্রচারণায় দল কিংবা সরকারের বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও এই বিলবোর্ডগুলোতে তা নেই।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ উল আলম লেনিন বলেন, ‘এই বিলবোর্ডগুলো সরকারি উদ্যাগেও হতে পারে আবার দলীয়ভাবে হতে পারে। এ বিষয়ে আমি ঠিক ভালো জানি না। এতদিন অনেকেই আমাদের কাছে অভিযোগ করেছে আওয়ামী লীগের প্রচার দুর্বল। তাই আওয়ামী লীগ তাদের উন্নয়ন কর্মকা- তুলে ধরতে পারছে না। এখন এমনও হতে পারে দল নতুন উদ্যমে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছে।’
প্রচার দলীয় উদ্যোগে কি না এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অসীম কুমার উকিল বলেন, ‘এই সমস্ত কাজ তো মূলত দলীয় উদ্যোগেই হয়ে থাকে। আমি এ বিষয়ে এর বেশি কিছু জানি না এবং বলতেও চাচ্ছি না। বেশি কিছু জানতে হলে আপনি আমাদের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
এদিকে বিলবোর্ডে ক্ষমতাসীন দলের উন্নয়নের নানা ফিরিস্তির পাশাপাশি বিএনপি আমলের নেতিবাচক তথ্য উপস্থাপন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এভাবে সরকারের হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। সরকার দুর্নীতি এবং ব্যর্থতা ঢাকতে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
প্রচারণার বিষয়ে মুখ খোলেননি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না। আমি এখন চুপ আছি। আমার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য নেই।’
বিলবোর্ডগুলোতে সরকার বা দলের নাম না থাকলেও আছে প্রধানমন্ত্রী ছবি। একই সঙ্গে আছে বঙ্গবন্ধু ছবিও। বিলবোর্ডগুলোতে তুলে ধরা হয়েছে জঙ্গি দমন, খাদ্য নিরপত্তা, কৃষি উন্নয়ন, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, শিক্ষা, অবাধ তথ্য প্রবাহ, নতুন টেলিভিশন চ্যানেল, কমিউনিটি রেডিও, এফএম রেডিও প্রচারের অনুমোদন, যোগাযোগ ব্যবস্থায় অগ্রগতি, সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন তথ্য।
সরকারের উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরতে দীর্ঘদিন যাবৎ জোট নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন শরীক দলের নেতারা এবং দলীয় হাইকমান্ড। সম্প্রতি পাঁচ সিটি নির্বাচনে মোহাজোট প্রার্থীদের পরাজয়ের পর মহাজোটের সাড়ে চার বছরের সাফল্য প্রচারের কথা বলে আসছিলেন জোটের নেতারা।
বিলবোর্ডগুলো কার উদ্যাগে করা হয়েছে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর আরেক সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, ‘সরকারি নয়, এটা দলীয় উদ্যাগেই হচ্ছে। রাজধানীসহ পর্যায়ক্রমে সারাদেশে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে। ভোটারদের সরকারের উন্নয়ন স্মরণ করিয়ে দিতেই এই উদ্যাগ। অনেকেই আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের প্রচার-প্রচারণা দুর্বল, সেই ঘাটতি পূরণ করতেই এ উদ্যোগ।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘ব্যক্তি উদ্যাগ বা দলীয় উদ্যাগ অথবা অতি উৎসাহী কারো উদ্যাগে হতে পারে। বিলবোর্ডের প্রচারিত তথ্যগুলো সত্য কি না? যদি সত্য হয়ে থাকে তা নিয়ে কাজ করুন।’
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকারের শেষ সময়ে সরকারি অর্থায়নে যদি এই প্রচারণা হয় তবে তা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে আইন মেনে দলীয় খরচে প্রচারণা হলে দোষের কিছু নয়।
‘বিলবোর্ড আওয়ামী লীগের নয়, সরকারের’
স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, “সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় তাদের নিজস্ব উন্নয়ন কাজের কথা জনগণে জানাতে চায়। এজন্যই বিলবোর্ডের মাধ্যমে এটা প্রচার করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাতে উন্নয়নের প্রচারে যে বিলবোর্ড রয়েছে তা সরকারের।” গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে শেখ কামালের ৬৪তম আলোচনা সভায় শেষে সাংবাদিকদের ‘রাজধানী ঢাকাতে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ের তথ্য নিয়ে যে বিলবোর্ড রয়েছে সেগুলো আওয়ামী লীগের না সরকারের’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button