হরতাল সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ ওষ্ঠাগত

Wall Streetঘন ঘন দেশব্যাপী হরতাল আহ্বানকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি বলে মন্তব্য করেছে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। নিউজ করপোরেশনের মালিকানাধীন পত্রিকাটির শনিবারের সংস্করণে বলা হয়, গত এপ্রিলে পোশাক কারখানা ধসের ঘটনায় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া বাংলাদেশের সামনে লাগাতার হরতাল ডাকার সংস্কৃতি নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘কালচার অব মাস স্ট্রাইক্স সাফোকেটস বাংলাদেশেজ ইকোনমি’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, হরতাল নিয়ে অনেক দিন ধরে ধুঁকছে বাংলাদেশ। ভারতকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধী সেই যে হরতাল ডাকা শুরু করেছিলেন, তার পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে হরতাল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে পালিত হচ্ছে। শ্রমিক ও জনস্বার্থবিরোধী মতাদর্শের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, ‘রাজনৈতিক দাবিদাওয়া আদায়ে বা সরকারকে লজ্জায় ফেলতে বাংলাদেশের যেকোনো দল চাইলেই হরতাল ডাকতে পারে।’ ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ বলছে, এ বছর বাংলাদেশ রানা প্লাজা ধস, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দেশটির তৈরি পোশাক খাত সুনাম ফিরিয়ে আনতে হিমশিম খাচ্ছে। আর যুদ্ধাপরাধের বিচারে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় দলটি ইতিমধ্যে কয়েক দফা হরতাল ডেকেছে।আসছে জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। তাই সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের হরতালের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ১৭ দিন এবং শুধু ২০১২ সালে ২৯ দিন হরতাল পালিত হয়েছে। হরতালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ থাকে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ কমে যায় এবং সহিংসতা এড়াতে অনেক মানুষ ঘরে বসে থাকে। এ বছর হরতাল-সংশ্লিষ্ট জটিলতায় কমপক্ষে ৮০ জন মানুষ নিহত হয়েছে। হরতালকারীরা শত শত বাস ও গাড়ি ভাঙচুর করেছে এবং জ্বালিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির (এফবিসিসিআই) বরাত দিয়ে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ বলছে, এ বছর হরতালের কারণে প্রায় ৭০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে, অর্থাত্ দৈনিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ কোটি ডলার। এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ পত্রিকাটিকে বলেন, ‘হরতালের সংস্কৃতি আমাদের সর্বনাশ করছে।’
গ্যাপ ইনকরপোরেশনের মতো বিরাট বিরাট খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পণ্য সরবরাহকারী হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, সম্প্রতি এক হরতালের সময় প্রতিবাদীরা তাঁর কোম্পানির পণ্যবাহী একটি ট্রাকে আগুন লাগিয়ে দিলে প্রায় আড়াই হাজারটি পোশাক পুড়ে যায়।
পত্রিকাটি বলছে, ‘বেশি বেশি হরতাল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আশঙ্কার ব্যাপার। এমনিতে সস্তা শ্রমের দেশটি কারখানার ভঙ্গুর অবকাঠামো ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য যথেষ্ট দুর্নাম কামিয়েছে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, এফবিসিসিআই এর আগে বহুবার সরকারকে হরতাল নিষিদ্ধের অনুরোধ জানালেও নেতারা তাতে রাজি হননি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন তারা ১৭০ দিন হরতাল পালন করেছিল। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, ক্ষমতা হারালে আওয়ামী লীগ আবারও একই সংস্কৃতিতে ফিরে যাবে।
সরকার দলীয় নেতারা মাঝেমধ্যে হরতালের নিন্দা জানাচ্ছেন বটে, কিন্তু সেটির লক্ষ্য শুধু বিরোধী দলকে হরতাল না ডাকার আহ্বানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। হরতাল নিষিদ্ধের কোনো কর্মসূচিই নেই।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর এ বছরের শুরুর দিকে বলেছিলেন, ‘মতপ্রকাশের ও প্রতিবাদ করার অধিকার সংবিধানসম্মত। তাই আমি হরতাল নিষিদ্ধের পক্ষে নই।…তবে শক্তিশালী যুক্তি ও নৈতিক কারণ ছাড়া হরতাল ডাকা উচিত নয়।’
বিরোধী দল মনে করছে, হরতাল নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে সরকার দমন-পীড়ন চালাতে চায়। বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘হরতাল ডাকার পেছনে কোন বিষয়গুলো কাজ করছে তা ব্যবসায়ী নেতাদের ভেবে দেখা উচিত। হরতাল নিষিদ্ধের জন্য আইন প্রণয়নের দাবি না জানিয়ে তাঁদের উচিত সমস্যাগুলো সমাধান বাতলে দেওয়া।’
পত্রিকাটি বলছে, রাজনৈতিক নেতারা অনেক যুক্তি দেখালেও হরতালের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত। শাড়ির দোকানের কর্মচারী সেলিম আহমদ (৩৮) জানান, বেচাবিক্রি কম হলে তাঁরা অবকাশকালীন বোনাস (হলিডে বোনাস) পাবেন না। সাধারণত তাঁরা মাসে ২৫০ ডলারের মতো হলিডে বোনাস পান। হরতাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সমস্যা হলো কেউ ছাড় দিতে চায় না। আমরা দুপক্ষের মাঝে চাপা পড়েছি।’

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button