জাকাতভিত্তিক সমাজ গড়তে দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা

Zakatজাকাত হচ্ছে ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার। ইসলাম ধর্মে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বে জাকাত প্রদান ফরজ করা হয়েছে। জাকাতব্যবস্থা হচ্ছে সমাজে দারিদ্র্যবিমোচনের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। বক্তারা বলেন, মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে জাকাত আদায়কে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করা ও জেলা-উপজেলায় প্রচারণা চালাতে হবে। জাকাতভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়তে হলে সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। এখনো অনেক লোক জাকাত সম্পর্কে বেশি জানে না। তাই জাকাত সম্পর্কে ব্যাপকভিত্তিক প্রচারণা চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকেও উদ্যোগ নিতে হবে। গতকাল এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেয়া আলোচকেরা এ কথা বলেন। বক্তারা নৈতিকতা ও বিশ্বস্ততার সাথে জাকাত আদায় ও সুষ্ঠু বণ্টনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। গতকাল দুপুরে নয়া দিগন্ত ও ক্যাম্পেইন ফর জাকাতের যৌথ উদ্যোগে ‘জাকাত ব্যবস্থাপনায় প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নয়া দিগন্ত কার্যালয়ের বোর্ডরুমে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন। এস এম রাশেদুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ। আরো বক্তব্য রাখেন সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজম্যান্টের প্রধান নির্বাহী ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক মুজাহিদুল ইসলাম, কবির আহসান (ইউএসএ), সামাজিক জাগরণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শামসুর রহমান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, ক্রিয়েটিভ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান নূরুল আমিন বাগমার, ইসলামিক এইড বাংলাদেশের বরকত উল্লাহ, রিসডা বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক হেমায়েত হোসেন, চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ আসগর আলী, আবদার রহমান, কামরুজ্জামান, সিএসবি চেয়ারম্যান আবুল বাশার, আনওয়ারুজ্জামান রতন, দরপন প্রোপার্টিজের পরিচালক মবিনুল ইসলাম, মসজিদ কাউন্সিলের পরিচালক শাহ আব্দুল বাতেন, ওবায়দুল হক, রইস উদ্দিন আহম্মদ, ইসলামিক ট্রাস্টের মফিজ উদ্দিন, চাষী কল্যাণ সমিতির জিল্লুর রহমান, ইন্টিমেন্ট প্রোপার্টিজের রাশেদ নেওয়াজ নাছির, আলফা সফটওয়ারের আমজাদ হোসেন, শহিদুল আলম, ডিটারমাইন্ড প্রোপার্টিজের খলিলুর রহমান প্রমুখ। প্রধান অতিথি বিচারপতি আব্দুর রউফ বলেন, মানুষ সম্পদকে নিজের মনে করে। যে কারণে সম্পদের প্রতি মানুষের মোহ বেশি। এ জন্য সম্পদের জাকাত দিতে মানুষের কষ্ট হয়। কিন্তু বুঝতে হবে মানুষ সম্পদের মালিক নয়। আল্লাহতায়ালা মানুষকে সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছেন মাত্র। সম্পদ থেকে মানুষের মোহ ভাঙানোর জন্যই আল্লাহ নিসাব পরিমাণ সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ করেছেন। তিনি বলেন, জাকাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন দরকার। আর প্রাপ্য ব্যক্তিকেই জাকাত দেয়ার ব্যাপারে ইসলামি শরিয়তে নির্দেশনা আছে। আল্লাহ জাকাত আদায়ের জন্য মুসলমানদের নির্ধারণ করেছেন। এর মানে মুসলমান ছাড়া অন্যদের জাকাত দেয়া যাবে না এটা ঠিক নয়। বিচারপতি আব্দুর রউফ আরো বলেন, আমাদের দেশে জাকাত সম্পর্কে খুব বেশি সভা-সেমিনার করা হয় না। সে জন্য জনগণও জাকাত সম্পর্কে ভালোভাবে জানে না। জাকাতভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে আরো গবেষণা ও প্রচারণা প্রয়োজন। সবচেয়ে প্রয়োজন হচ্ছে গবেষণার লক্ষ্যে কর্মপরিধি নির্ধারণ করা। ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব বলেন, আমাদের সমাজে জ্ঞান ও সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। কারণ কখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাতব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ফলে জাকাতের সৌন্দর্য আমরা দেখতে পাইনি। তিনি বলেন, বর্তমান সমাজে জাকাত আদায় ও বণ্টন যেন একটি সিন্ডিকেটের মধ্যেই আটকে আছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, এনজিও কওমি মাদরাসা ও অন্যান্য ইনস্টিটিউশনের কথা বলেন। শাড়ি আর লুঙ্গি দিয়েই জাকাত আদায়ের চেষ্টা করেন অনেকে। অথচ এটা ঠিক নয়। বাংলাদেশে জাকাতব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার পেছনের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের দেশে জাকাতের ওপর বিশেষ কোনো বই নেই। জাকাতদানকারী ব্যক্তির স্পষ্ট কোনো পরিসংখ্যান ও গবেষণা নেই, যা হতাশাব্যঞ্জক। তিনি বলেন, কত মানুষ হালাল আয় করেন? কতজন জাকাত দেন এর হিসাব থাকা দরকার। জাকাতদাতাদের একটি ফোরামের মধ্যে আনার আহ্বান জানিয়ে একে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার কথা বলেন ড. আইয়ুব। অধ্যাপক মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, জাকাতের অর্থ আটকে রাখা যাবে না। নিসাব পরিমাণ সম্পদের সাথে সাথে জাকাত আদায় করা জরুরি। জাকাত শুধু রমজান মাসে দিতে হবে এটা ঠিক নয়। জাকাত অগ্রিম সংগ্রহ করে তা সারা বছর ব্যবহার করা যায়। দেশে জাকাত আদায়কারীর সংখ্যা নির্ধারণে সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। এ ছাড়া দেশের সব মসজিদের ইমামকে জাকাত আদায় ও বণ্টনের ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর কথা বলেন অধ্যাপক মুজাহিদুল ইসলাম। সঞ্চালক আলমগীর মহিউদ্দিন বলেন, জাকাত আদায়ে টার্গেট নিয়ে কাজ করা দরকার, না হলে কোনো উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন হবে না। তিনি বলেন, ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার এ ব্যবস্থা ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্মে নেই। শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে নৈতিকতার অবক্ষয় চলছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। কবির হাসান বলেন, জাকাতব্যবস্থাকে সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে হবে। ধনী-দরিদ্র্যের বৈষম্য কমাতে সুদমুক্ত ও জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা এবং শ্রমমুখী শিল্পকারখানা গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। এ ছাড়া ওয়াকফ বোর্ডকে আরো গতিশীল করতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দেশের মানুষ জাকাতব্যবস্থা সম্পর্কে বেশি জানতে আগ্রহী। তারা জাকাত দিতেও আগ্রহী বলে জানান কবির হাসান। ড. আবু ইউসুফ বলেন, জাকাতের ব্যাপক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষের দোর গোড়ায় জাকাতের গুরুত্ব ও এর সুফল পৌঁছে দিতে হবে। রফিকুল ইসলাম বলেন, আস্থার অভাবে মানুষ সরকারের জাকাত ফান্ডে জাকাত দিচ্ছে না। বেসরকারি সংস্থাগুলোও আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তাই সমন্বয় করে জাতীয়ভাবে জাকাত প্রতিষ্ঠার কথা বলেন তিনি। আবুল বাশার বলেন, জাকাত ভিক্ষা বা দান নয়। এটা ধনীর সম্পদের ওপর গরিবের অধিকার। ড. শামসুর রহমান যোগ্য ব্যক্তিকে জাকাত দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। নূরুল আমিন বাগমার বলেন, মানুষ জাকাত দেয়ার চেষ্টা করছে। বিদেশ থেকেও অনেক সাহায্য আসছে। এগুলোর সুষ্ঠু ও সমবণ্টন করতে হবে। হেমায়েত হোসেন বলেন, জাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনে সরকারের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button